ভাষণ

মনদীপ ঘরাই

ভাষণ

রিক্ত খুব কাঁদছে আজ। ওর দাদু একাত্তর দেখেছে, ৭ মার্চ দেখেছে, কিন্তু ও কেন দেখলো না?

কে বোঝাবে এই ছয় বছরের বাচ্চাকে? তখন তো ওর বাবারই জন্ম হয় নি!

কেঁদেই চলেছে ছেলেটা। বীর মুক্তিযোদ্ধা দাদুকে গল্প বলতে বললেই সে একাত্তরের গল্প শোনায়, মহান মুক্তিযুদ্ধের গল্প শোনায়। ভাঙ্গা ক্যাসেট প্লেয়ারটায় বাজায় ৭ মার্চের ভাষণ।

কি এক অদ্ভুত কারণে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি দেখলেই “বাবা” বলে চিৎকার করে ওঠে রিক্ত। ছেলেটা নিজের বাবা-মাকে হারিয়েছে গেল বছর। দুর্ঘটনায়। তবু তো জাতির পিতার মাঝে পিতৃত্বকে খুঁজছে অবুঝ শিশুটা।

রিক্তর দাদুর এ নিয়ে খুশির সীমা নেই। যদিও বাবা ডাকটা সে শেখায় নি, চেতনার বীজ বপন হয়েছে এই কতো!

৭ মার্চের ভাষণের অনেকটা রিক্তর মুখস্ত। দাদুর আজকাল অনেক কিছুই মনে থাকে না। তবে ভুলে না কক্ষনো।

দাদু যেমন সকাল সকাল দু এক দানা মুড়ি রিক্তর মুখে তুলে দেন, তেমনি করে একটি দুটি করে ঐতিহাসিক ভাষণের লাইন হৃদয়ে তুলে দিয়েছেন নাতির।

ইংরেজি মিডিয়ামে পড়ে পড়ে ছেলেটার বাংলা চুলোয় যাচ্ছে। তবু আধো বোলে মন্দ লাগে না ভাষণটা। কেমন যেন একাত্তরে নিয়ে যায়।

রিক্তর কান্না থেমেছে। পাড়ার মোড়টাতে মাইকে জোরে বেজে উঠেছে ৭ মার্চের ভাষণ। দৌঁড়ে বারান্দায় গিয়ে শুনছে ও। সাথে সাথে চেনা লাইনগুলো বলার চেষ্টা করছে। আগামীকাল যে ৭ মার্চ। পাশে এসে দাঁড়ায় দাদু। তার চোখটা ঝাপসা হয়ে আসে।

৭ মার্চ সারাদিন অবিরত বাজলো ভাষণ। রিক্ত খুশি। দাদুও।

আজ ৮ মার্চের সকাল। খুব ভোরে মাইক খুলতে লোক এলো। মই দিয়ে মাইক খোলার জোগাড়যন্ত্র চলছে। আবার কেঁদে উঠলো রিক্ত।

“ওদের থামাও দাদু। Speech-টা one more day চলুক। প্লিজ।”

দাদু লাঠিতে ভর দিয়ে নিচে নেমে ওদের অনুরোধ করে। আরেকটা দিন কি রাখা যায়?

মাইকম্যান ছেলেটা হেসে বলে, “সন্ধ্যার গায়ে হলুদের প্রোগ্রামে কি মাইকের বদলে আপনে গাইবেন, নানা?”

রাগ, ক্ষোভ, দুঃখে ওখান থেকে বাসায় চলে আসে দাদু।

রিক্ত এভাবে লজ্জ্বা পেতে দেখেনি কখনও দাদুকে। ওইটুকু ছেলে সান্তনা দেয়ার চেষ্টায় পাগল হয়ে ওঠে।পুরোনো ক্যাসেট প্লেয়ারটায় ছাড়ে ৭ মার্চের ভাষণটা।

দাদুকে ভোলানোর জন্য বলে, ” আমাকে স্বাধীনতা শেখাও দাদু।”

দাদু সব ভুলে রিক্তকে জড়িয়ে ধরে কাঁপা কন্ঠে বলে ওঠে, “এবারের সংগ্রাম,স্বাধীনতার সংগ্রাম।”

শেয়ার করুন

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে