ভালোবাসার টানে ব্রাহ্মণ বাবা-মায়ের ঘর ছেড়ে হরিজন সম্প্রদায়ের ছেলে তুষারকে বিয়ে করেছিল সুষ্মিতা দেবনাথ অদিতি। হিন্দুত্বের সেই সাম্প্রদায়িক প্রথা ভেঙে জয় হলো ভালোবাসার।
ভালোবাসার অপরাধে ‘অপরাধী’ হয়ে ১৪ বছরের কারাদণ্ড নিয়ে জেলে থাকা প্রেমিক তুষার আজ বুধবার কারামুক্ত হন। বর্ণ প্রথাকে পায়ে ঠেলে মনের জোরে ভালোবাসাকে জয় করে তুষার-সুষ্মিতার প্রেম নতুন ইতিহাস সৃষ্টি হয়েছে।
হাইকোর্ট থেকে জামিন পাওয়ার ছয়দিনের মাথায় আজ বুধবার গাজীপুরের কাশিমপুর কারাগার থেকে মুক্তি পেয়েছেন তুষার। এ সময় স্ত্রী সুষ্মিতা দেবনাথ অদিতি ও বাবা রঞ্জিত দাস উপস্থিত ছিলেন।
কারামুক্তির পর তুষার সাংবাদিকদের বলেন, আমি খুশি। আমার স্ত্রী আইনি লড়াই করে আমাকে মুক্ত করেছে। আমাদের ভালোবাসার জয় হয়েছে। আমার ভালোবাসা আজ সার্থক।
ভালোবেসে বিয়ে করার পর অদিতির মায়ের (শাশুড়ি) করা মামলায় ১৪ বছরের কারাদণ্ড দিয়ে তুষারকে কারাগারে পাঠান আদালত। এখানে সমস্যা হলো আসামি তুষার দলিত সম্প্রদায়ের আর মেয়ে ব্রাহ্মণ।
আদালত বলেন, এখানে উঁচু-নিচু জাতের একটি বিষয় আছে। ভালোবেসে বিয়েবন্ধনে আবদ্ধ হলেও ধর্ষণ ও অপহরণের অভিযোগে শাশুড়ির করা মামলায় হাইকোর্টে করা আপিলের শুনানিতে গত ১ আগস্ট এমন মন্তব্য করেন আদালত।
তখন আদালত বলেন, এখানে সমস্যা হলো আসামি দলিত সম্প্রদায়ের। আর মেয়ে ব্রাহ্মণ সম্প্রদায়ের। আমাদের সমাজে তো এরকম প্রথা রয়েছে যে উঁচু-নিচু অসম বিয়ের ঘটনা ঘটলে সমাজচ্যুতির ভয় থাকে।
ভালোবাসার টানে ব্রাহ্মণ বাবার ঘর ছেড়ে হরিজন সম্প্রদায়ের ছেলে তুষারকে বিয়ে করে সুষ্মিতা। ধর্মীয় বর্ণ বৈষম্যের শিকার সামাজিক নাটকীয়তার এক পর্যায়ে নিজের স্ত্রীকে অপহরণের দায়ে ১৪ বছরের সাজা মাথায় নিয়ে তুষারকে কারাবরণ করতে হয়।
এরপর গত ১ আগস্ট হাইকোর্ট থেকে জামিন মিলে তুষারের। কিশোর সংশোধনী আর কোর্টের বারান্দা ঘুরে ৮৯ দিনের সন্তানকে কোলে নিয়ে স্বামীর জামিনের পর সেদিন সুষ্মিতার মুখে ফুটেছিল হাসি। এরপর আজ সেই হাসির পূর্ণতা পেল।
এর আগে একদিনে মামলায় সাতজন সাক্ষীর সাক্ষ্যগ্রহণ, আসামির জবানবন্দি, উভয় পক্ষের আইনজীবীদের যুক্তিতর্ক উপস্থাপন এবং পরিশেষে রায় ঘোষণা করেছেন। রায়ে অপহরণের দায়ে আসামি তুষার দাস রাজকে ১৪ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দেয়া হয়।
অথচ ১১ মাস আগে একই বিচারক আসামিকে মামলা থেকে অব্যাহতি দিয়ে আদেশ দিয়েছিলেন। যে মামলায় একবার অব্যাহতি দিলেন, সেই মামলায় আবার কীভাবে সাজা দিলেন তা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন আইনজীবী। একদিনের মধ্যে একটি মামলার বিচার সম্পন্ন করায় হাইকোর্ট বিস্ময় প্রকাশ করেন।
এ সময় আদালত বলেন, একটি নির্দিষ্ট মামলার ব্যাপারে বিচারক সাহেবের এত উৎসাহ কেন? তার কী স্বার্থ? গত ছয় মাসে তার আদালতের পরিসংখ্যান কী তা দেখা দরকার।
আদালত বলেন, তার মতো যদি সারা দেশের বিচারকরা কাজ করতেন তাহলে তো নিম্ন আদালতে মামলার জট থাকতো না।
১৪ বছরের সাজাপ্রাপ্ত তুষার দাস রাজকে জামিন দিয়েছেন হাইকোর্ট। একই সঙ্গে নিম্ন আদালতের করা ২০ হাজার টাকা জরিমানার আদেশও স্থগিত করেছেন আদালত। ১ আগস্ট হাইকোর্টের বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ জামিন মঞ্জুর করে এ আদেশ দেন।
স্বামীর মুক্তিতে অদিতি বলেন, আমি খুব খুশি। ছোট্ট মেয়েটা ওর বাবাকে কাছে পাবে। ভালোবেসে স্বেচ্ছায় তুষারকে বিয়ে করেছি। আমি মনে করি ভালোবাসায় কোনো উঁচু-নিচু বা বর্ণ বিষয় নেই।
আদালতে আসামিপক্ষের আইনজীবী ছিলেন শিশির মোহাম্মদ মনির। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল সারোয়ার হোসেন বাপ্পী।