সমৃদ্ধ সুন্দর ভবিষ্যতের জন্য

আবুল কাসেম ফজলুল হক

আবুল কাসেম ফজলুল হক
আবুল কাসেম ফজলুল হক

তথ্য-প্রযুক্তি ও জীব-প্রযুক্তির বিপ্লব (১৯৮০-র দশক) এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের বিলোপ (১৯৯১) দুনিয়াব্যাপী এমন প্রভাব ফেলেছে যে মানবীয় সব কিছুই বদলে যাচ্ছে। ক্ষুধা-তৃষ্ণা, যৌনতাড়না, ঈর্ষা-বিদ্বেষ, ক্ষমতালিপ্সা, খ্যাতিলিপ্সা, হিংসা-প্রতিহিংসা কি পরিবর্তিত হয়েছে? যে ব্যাপারটিকে সভ্যতা বলা হতো—এখনো কেউ কেউ বলেন, তার রূপ ও প্রকৃতি এখন কেমন? বন্যাবস্থা ও বর্বরতা অতিক্রম করে যে মানুষ সভ্যতায় উত্তীর্ণ হয়েছিল, সেই মানুষ কি বর্বরতায় ফিরে যাচ্ছে? বন-জঙ্গলের নিয়মে ফিরে যাচ্ছে? মানুষ কি সভ্যতার যোগ্য হয়নি?

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়ই ইউরোপের কোনো কোনো দার্শনিক-বৈজ্ঞানিক মত প্রকাশ করেছিলেন যে পাশ্চাত্য সভ্যতা গভীর সংকটে পড়েছে। স্পেংলারের Decline of the West, সুয়েটজারের The Decay and Restoration of Civilization প্রভৃতি অসাধারণ গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ। যুদ্ধ শেষ হওয়ার দুই-এক বছরের মধ্যেই জার্মান ভাষায় ও ইংরেজি অনুবাদে প্রকাশিত হয়েছিল। ক্লাইভ বেলের Civilization গ্রন্থটিও ওই পর্বেই প্রকাশিত হয়েছিল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের অভিঘাতে দার্শনিক-বৈজ্ঞানিকরা অনুভব করেছিলেন, কয়েক শতাব্দী ধরে চলে আসা আধুনিক পাশ্চাত্য সভ্যতা শেষ হয়ে যাচ্ছে, নতুন সভ্যতা সৃষ্টি করতে হবে। তাঁরা দায়ী করেছিলেন নৈতিক পতনকে, জোর দিয়েছিলেন নৈতিক উত্থানে।

universel cardiac hospital

ক্লাইভ বেলের বইটি মোতাহের হোসেন চৌধুরী ‘সভ্যতা’ নামে বাংলায় অনুবাদ করেছেন, সেটি বাজারে আছে। সভ্যতা বিষয়ে স্পেংলারের ও সুয়েটজারের বইগুলোও বাংলায় অনূদিত হওয়া দরকার। বাংলাদেশকে গড়ে উঠতে ও উন্নতি করতে হলে সভ্যতার পথ রচনা করতে হবে। এর জন্য প্রয়োজনীয় জ্ঞান ও পরিকল্পনা দরকার। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ২০ বছর পার হতে না হতেই সংঘটিত হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। তখন দার্শনিক-বৈজ্ঞানিকদের মধ্যে ধারণা সৃষ্টি হয়েছিল যে পাশ্চাত্য রাজনীতি অপশক্তির দখলে চলে গেছে এবং তা সভ্যতার ধারায় থাকছে না। রবীন্দ্রনাথ মৃত্যুর ঠিক আগে ১৯৪১ সালে রচনা করেছিলেন ‘সভ্যতার সঙ্কট’ প্রবন্ধটি। Crisis in Civilization নামে এটি তিনি ইংরেজিতেও প্রকাশ করেছিলেন। সভ্যতা নিয়ে যে দার্শনিক-বৈজ্ঞানিকরা উদ্বিগ্ন হয়েছিলেন, তাঁরা সবাই অনুভব করেছিলেন পাঁচ-ছয় শ বছর ধরে রেনেসাঁসের মধ্য দিয়ে বিকশিত ইউরোপের সভ্যতা শেষ হয়ে যাচ্ছে এবং সমৃদ্ধিমান ও উন্নত জ্ঞানবিজ্ঞান নিয়ে মানবজাতি নৈতিক পতনশীলতার কারণে সভ্যতার পথ হারিয়ে বর্বরতায় নিপতিত হচ্ছে। ইউরোপের জ্ঞানীদের প্রতি তাঁরা নতুন রেনেসাঁস ও নতুন সভ্যতা সৃষ্টির উপায় সন্ধানের জন্য তাগিদ দিয়েছিলেন। সবাই জানেন, ওই পর্বে সংকটাপন্ন সভ্যতা নিয়ে চরম কথাটি উচ্চারণ করেছিলেন কবি জীবনানন্দ দাশ বাংলা ভাষায় রচিত একটি ছোট্ট কবিতার মাধ্যমে— ‘অদ্ভুত আঁধার এক এসেছে এ-পৃথিবীতে আজ,/যারা অন্ধ সব চেয়ে বেশি আজ চোখে দেখে তারা;/যাদের হৃদয়ে কোনও প্রেম নেই—প্রীতি নেই—করুণার আলোড়ন নেই/পৃথিবী অচল আজ তাদের সুপরামর্শ ছাড়া।/যাদের গভীর আস্থা আছে আজও মানুষের প্রতি,/এখনও যাদের কাছে স্বাভাবিক ব’লে মনে হয়/মহৎ সত্য বা রীতি, কিংবা শিল্প অথবা সাধনা/শকুন ও শেয়ালের খাদ্য আজ তাদের হৃদয়।’

সংকটের মধ্যে সম্ভাবনার দিকও ছিল। দুনিয়াব্যাপী সাধারণ মানুষ অবস্থার উন্নতি চাইত—প্রগতি চাইত। সংগ্রামী স্পৃহা ও সংগ্রাম ছিল। জার্মানি, ফ্রান্স ও ব্রিটেনের দার্শনিক-বৈজ্ঞানিকরা সংকট থেকে উদ্ধার লাভের উপায় সন্ধান করতে গিয়ে নতুন রেনেসাঁস ও নতুন সভ্যতা সৃষ্টির প্রয়োজন অনুভব করেছিলেন। সংকট কাটানোর জন্য তাঁরা আধুনিক যুগের ভুলত্রুটি ও অন্যায়-অবিচারের অবসান এবং নৈতিক চেতনার উন্নতি চেয়েছিলেন। আইনস্টাইন Moral Re-Armament-এর কথা বলেছিলেন। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সভ্যতা ব্যাপারটি ছিল তখন প্রগতিশীল চিন্তার কেন্দ্রবিন্দুতে। পাশ্চাত্য সভ্যতা সংকটে নিমজ্জিত হওয়া সত্ত্বেও চীন, ভারত, জাপান ও ইরান থেকে নতুন সভ্যতার আত্মপ্রকাশের সম্ভাবনা ছিল। রবীন্দ্রনাথ নতুন সভ্যতার উদ্ভবের সম্ভাবনা দেখেছিলেন প্রাচ্য থেকে, প্রতীচ্য থেকে নয়। সংকট যেহেতু চলমান আছে, তাই সেই সম্ভাবনার ব্যাপারটি তলিয়ে দেখা দরকার। অবক্ষয়ক্লিষ্ট পশ্চিমের অন্ধ অনুসরণ কথিত ‘উন্নয়নশীল জাতি’গুলোর উন্নতির প্রধান অন্তরায়।

এরই মধ্যে নতুন সভ্যতার প্রতিশ্রুতি নিয়ে সামনে এসেছিল মার্ক্সবাদ। সোভিয়েত ইউনিয়নের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে রাশিয়ার চিঠিতে রবীন্দ্রনাথের পরিচ্ছন্ন বক্তব্য আছে। কমিউনিস্ট পার্টির ইশতেহার প্রকাশিত হয়েছিল ১৮৪৮ সালে, রুশ বিপ্লব ও চীন বিপ্লব সংঘটিত হয়েছিল যথাক্রমে ১৯১৭ সালে ও ১৯৪৯ সালে। সোভিয়েত ইউনিয়নের বিলুপ্তির (১৯৯১) সঙ্গে মার্ক্সবাদ অবলম্বন করে নতুন সভ্যতা সৃষ্টির সম্ভাবনা শেষ হয়ে যায়। এখন সংকট গভীরতর রূপ নিয়ে সামনে এসেছে। এই সংকটকে নানা দিক থেকে বোঝার এবং সংকট কাটিয়ে ওঠার উপায় সন্ধান করা দরকার। পশ্চিমের ধনী দেশগুলো থেকে তা হবে বলে মনে হয় না।

ডারউইন, মার্ক্স-অ্যাঙ্গেলস, ফ্রয়েড, স্পেংলার, সুয়েটজার, বার্ট্রান্ড রাসেল, এরিখ ফ্রোম, বিবেকানন্দ, গান্ধী, অরবিন্দ, এম এন রায়, মাও জেদং প্রমুখের চিন্তা ও অভিজ্ঞতার সমন্বয় সাধন করে নতুন সভ্যতার আদর্শ উদ্ভাবন করা দরকার। সমন্বয় সাধনের বেলায় বিজ্ঞানসম্মত দৃষ্টিভঙ্গি অবলম্বন করতে হবে। বাংলাদেশে শেরেবাংলা, ভাসানী ও বঙ্গবন্ধুর চিন্তা ও অভিজ্ঞতাকেও বিবেচনায় ধরতে হবে।

মানবস্বভাবের উন্নতি সম্ভব এবং উন্নতি সাধন করতে হবে। বিবেকবান চিন্তাশীল ব্যক্তিদের অগ্রযাত্রীর ভূমিকা পালন করতে হবে। রাজনৈতিক নেতৃত্ব গড়ে তুলতে হবে। এর জন্য যা কিছু করা দরকার পর্যায়ক্রমে সবই করতে হবে। নৈতিক উন্নতি, সেই সঙ্গে আর্থ-সামাজিক-রাষ্ট্রিক ব্যবস্থার উন্নতি—দুটিই সাধন করতে হবে। অর্থনৈতিক উন্নতিতে যে রকম গুরুত্ব দেওয়া হয়, নৈতিক উন্নতিতেও ঠিক সেই রকম গুরুত্ব দিতে হবে। নৈতিক উন্নতি ও অর্থনৈতিক উন্নতিকে একসঙ্গে পরস্পর সম্পূরকরূপে গ্রহণ করতে হবে। বিশ্বব্যবস্থাকে পুনর্গঠন করতে হবে। বর্তমান জাতিসংঘ ও চলমান বিশ্বায়ন দিয়ে হবে না। প্রতিটি জাতির আর্থ-সামাজিক-রাষ্ট্রিক ব্যবস্থা এবং আন্তর্রাষ্ট্রিক সম্পর্ক বা বিশ্বব্যবস্থা—দুটিকেই উন্নত করতে হবে। প্রতিটি জাতির রাষ্ট্রব্যবস্থাকে নবায়িত করতে হবে।

দুনিয়াব্যাপী বিশ্বব্যাংক অনুসারী অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, মানুষের নৈতিক উন্নতি সম্ভব নয়। তাদের উন্নয়নচিন্তায় নৈতিক উন্নতির বিবেচনা স্থান পায় না। এই দৃষ্টিভঙ্গি ভুল। সম্মিলিত প্রচেষ্টায় মানুষের অর্থনৈতিক উন্নতির সঙ্গে নৈতিক উন্নতি অবশ্যই সম্ভব। রাজনৈতিক দলের ভেতরে নৈতিক বিষয়ে সম্মিলিত অধ্যয়ন-অনুশীলনের কর্মসূচি ও কার্যক্রম থাকতে হবে। নৈতিক উন্নতি কার্যক্রম বাদ দিয়ে যে উন্নয়নচিন্তা তা খণ্ডিত ও আংশিক। অর্থনৈতিক উন্নতির পরিকল্পনায় নৈতিক উন্নতির জন্যও বার্ষিক, পঞ্চবার্ষিক ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা ও কার্যক্রম রাখতে হবে।

প্রতিটি রাষ্ট্রে সর্বজনীন গণতন্ত্রের প্রয়োজনে চলমান নির্বাচনসর্বস্ব গণতন্ত্রের ধারণা ও কার্যক্রম পরিহার করতে হবে। শ্রমিক-কৃষক-মধ্যবিত্তদের ও ন্যায়কামী সবার কল্যাণে গণতন্ত্রকে সর্বজনীন গণতন্ত্র নামে নতুন রূপ ও প্রকৃতি দিতে হবে। সমাজতন্ত্রের ধারণাকে বাস্তবসম্মতভাবে সমন্বিত করে নিতে হবে অভীষ্ট সর্বজনীন গণতন্ত্রে। সর্বজনীন গণতন্ত্রের জন্য রাজনৈতিক দল জনগণের জন্য দীর্ঘমেয়াদি ও স্বল্পমেয়াদি আর্থ-সামাজিক-সাংস্কৃতিক উন্নতির কর্মসূচি প্রচার করে জনমত গঠন করবে এবং নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় গিয়ে কর্মসূচি বাস্তবায়ন করবে। রাজনৈতিক দলে অবলম্বন করতে হবে নবসৃষ্টির ও নতুন রেনেসাঁসের স্পিরিট। শুধু জ্ঞান দিয়ে হবে না, জ্ঞানের সঙ্গে চরিত্রবল ও কাজ লাগবে। শুধু চিন্তা দিয়ে হবে না, চিন্তার সঙ্গে কাজ লাগবে। নতুন রেনেসাঁসের ধারায় নতুন গণজাগরণ সৃষ্টি করতে হবে। গণজাগরণ হুজুগ থেকে ভিন্ন।

প্রতিটি রাষ্ট্রে জাতীয় সংসদ ও মন্ত্রিপরিষদ গঠন করতে হবে দলভিত্তিক আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের দ্বারা। দলকে জনসমর্থন অর্জন করতে হবে জনজীবনের আর্থ-সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক উন্নতির কর্মসূচিভিত্তিক অঙ্গীকার ঘোষণা করে। দলের রাজনৈতিক চরিত্র ধীরগতিতে ক্রমাগত উন্নত করতে হবে। গণতন্ত্রের ধারণা ও অনুশীলনকেও পর্যায়ক্রমে উন্নত করতে হবে। দলের ভেতরে রাষ্ট্র, জাতি ও গণতন্ত্র সম্পর্কে নিয়মিত অধ্যয়ন-অনুশীলন চালু রাখতে হবে। রাজনৈতিক দলের অভ্যন্তরে নৈতিক অনুশীলন ও নৈতিক উন্নতি অপরিহার্য। ব্যক্তিগত অনুশীলনে যা সম্ভব হয় না, দলীয় অনুশীলন দ্বারা তা সম্ভব করতে হবে। বলাই বাহুল্য, নেতাকর্মীদের উন্নত রাজনৈতিক চরিত্র অর্জন করতে হবে দলের ভেতরে অনুশীলনের মাধ্যমে। রাজনীতি সম্পর্কে চলমান ধারণার আমূল পরিবর্তন করতে হবে।

দুনিয়াব্যাপী জাতিরাষ্ট্রগুলোর পুনর্গঠনের পাশাপাশি বিশ্বব্যবস্থাকেও পুনর্গঠন করতে হবে। অবলম্বন করতে হবে জাতীয়তাবাদ ও তার সম্পূরক আন্তর্জাতিকতাবাদ। দুর্বল রাষ্ট্রগুলোকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। প্রতিষ্ঠা করতে হবে আন্তর্রাষ্ট্রিক ফেডারেল বিশ্বসরকার। বিশ্বসরকার হবে জাতীয় সরকারগুলোর ঊর্ধ্বতন এক সরকার। তার কাজ সীমাবদ্ধ থাকবে আর্থ-সামাজিক ও সাংস্কৃতিক দিক দিয়ে আন্তর্রাষ্ট্রিক সহযোগিতা ও সম্প্রীতি বৃদ্ধিতে, বিরোধ মীমাংসায়, যুদ্ধ যাতে না লাগে তার জন্য কাজ করায়, যুদ্ধ যদি লেগে যায়, তাহলে আলোচনার মধ্যমে যুদ্ধ থামানোয় এবং আন্তর্রাষ্ট্রিক শান্তি রক্ষায় ও সহযোগিতা বৃদ্ধিতে। রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ সব কাজ করবে রাষ্ট্রীয় সরকার। বিশ্বশান্তির প্রয়োজনে বিশ্বসরকারের কাজে একটি সেনাবাহিনী রেখে সব রাষ্ট্রের সেনাবাহিনী বিলুপ্ত করতে হবে।

সম্ভব হলে জাতিসংঘকে আন্তর্রাষ্ট্রিক ফেডারেল বিশ্বসরকারে রূপান্তর করতে হবে। তা যদি সম্ভব না হয়, তাহলে আন্তর্রাষ্ট্রিক ফেডারেল বিশ্বসরকার প্রতিষ্ঠার জন্য ভিন্ন ধারায় কাজ করতে হবে।

রাজনৈতিক দলের অভ্যন্তরে এবং জনসাধারণের মধ্যে সবার নৈতিক শক্তিকে জাগ্রত ও কার্যকর করতে হবে। সময়ে সময়ে রাজনৈতিক দলকে নৈতিক উন্নয়নের কর্মসূচি ও কার্যক্রম অবলম্বন করতে হবে। মানুষের প্রতি মানুষের বিশ্বাস পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে হবে। অশুভবুদ্ধিকে পরাজিত ও শুভবুদ্ধিকে বিজয়ী রাখতে হবে। মানুষ যদি তার চিন্তাশক্তি ও কর্মশক্তিকে রাজনৈতিক দল গঠনে এবং রাষ্ট্রব্যবস্থা ও বিশ্বব্যবস্থার পুনর্গঠনে কাজ করে, সেই সঙ্গে উন্নত জীবন প্রতিষ্ঠার কাজে নিয়োজিত করে, তাহলে মাত্র তিন দশকের মধ্যে যে সুফল দেখা দেবে, তা কল্পনা করাও এখন দুঃসাধ্য। মানুষ যদি বিবেককে জাগ্রত ও সক্রিয় রেখে সম্মিলিতভাবে চেষ্টা করে, বিজ্ঞানকে গুরুত্ব দেয়, তাহলে জেনারেশনের পর জেনারেশনের চেষ্টায় সব কিছুই পারবে। যা অসম্ভব, তা সম্ভব হবে, যা অসাধ্য, তা-ও সাধ্যের সীমার মধ্যে আসবে। দুনিয়াটাকেই মানুষ স্বর্গে পরিণত করতে পারবে। মানুষের শক্তি ও সম্ভাবনা অন্তহীন।

মানবপ্রকৃতি এমন যেকোনো শক্তি অন্যায়ের বিরুদ্ধে একবার জয়ী হলে তা চিরকালের বিজয় হয় না; মানুষের সমাজে অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায়ের সংগ্রাম ক্রমাগত চালিয়ে যেতে হবে। ন্যায়, কল্যাণ ও উন্নতির জন্য ঐক্যবদ্ধ হয়ে, নেতৃত্ব সৃষ্টি করে, জেনারেশনের পর জেনারেশন ধরে সাধনা ও সংগ্রাম করে এগিয়ে চলতে হয়। এর জন্য প্রগতিশীল রাজনৈতিক দল অপরিহার্য। দেশ-কালের ব্যবধানে ন্যায়, ইনসাফ, জাস্টিস বিষয়ে ধারণা বদলায়। ঘন ঘন বদলায় না, ঐতিহাসিক কালের ব্যবধানে বদলায়। বলা যায়—eternal vigilance is the price of justice.

দুর্বল জাতিগুলোকে বুঝতে হবে যে গ্রেকো-রোমান-ইউরো-আমেরিকান চিন্তাধারা ও তার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্মধারার সুস্পষ্ট দুটি শাখা আছে। এক শাখায় আছে সর্বজনীন কল্যাণচিন্তা, মহান আবিষ্কার-উদ্ভাবন, প্রগতিশীল দর্শন, বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, ইতিহাস, শিল্পকলা, সাহিত্য ও আদর্শ। এ শাখা সৃষ্টিশীল, প্রগতিশীল, মানবজাতির জন্য কল্যাণকর, সব জাতির জন্যই কোনো কোনোভাবে গ্রহণীয়। অন্য শাখায় আছে কায়েমি-স্বার্থবাদ ও প্রগতির বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়াশীল-উপনিবেশবাদ, ফ্যাসিবাদ, সাম্রাজ্যবাদ বর্ণবৈষম্যবাদ। এ ধারা মানবজাতির জন্য ক্ষতিকর। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের কিছু আগে থেকে প্রধানত এই দ্বিতীয় ধারার চিন্তক ও কর্মীরা আঁকাবাঁকা উঁচু-নিচু পথ ধরে পর্যায়ক্রমে শক্তিশালী হয়েছে এবং জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রায় সব গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রে কর্তৃত্ব দখল করে নিয়েছে। তাতে দেখা দিয়েছে পশ্চিমা সভ্যতায় সংকট। পশ্চিমা বৃহৎ শক্তিগুলোকে অনুসরণ করতে গিয়ে গোটা মানবজাতিই পড়েছে সংকটে। চলমান বাস্তবতায় পশ্চিমের কর্তৃত্বশীল শক্তিগুলোকে বলা যায় অপশক্তি। অত্যুন্নত প্রযুক্তির এই দুনিয়ায় কর্তৃত্বশীল আছে অপশক্তি। পশ্চিমা অপশক্তির কর্তৃত্বে মানবজাতির ভবিষ্যৎ অন্ধকার। এই অপশক্তির বিরুদ্ধে সারা দুনিয়ার জনগণের নৈতিক জাগরণ ও রাজনৈতিক ঐক্য দরকার। পশ্চিমা অপশক্তির ভেতর থেকে নতুন নেতৃত্ব আশা করা সম্পূর্ণ ভুল। বাংলাদেশে রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও বুদ্ধিজীবীদের চিন্তা পশ্চিমা অপশক্তির অনুগত। এখন এমন এক অবস্থা তৈরি হয়েছে যে অবস্থা উন্নত করা যাবে—সৃষ্টি করা যাবে উজ্জ্বল নতুন ভবিষ্যৎ—এ রকম কোনো আশাই খুঁজে পাওয়া যায় না সমাজের কোনো স্তরে। অবস্থা পরিবর্তন করা যাবে। পরিবর্তনের জন্য নতুন চিন্তা, নতুন কর্মধারা ও উন্নত চরিত্রের নেতৃত্ব লাগবে।

লেখক : প্রগতিশীল চিন্তাবিদ

অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

শেয়ার করুন

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে