বাংলাদেশের গুম-খুনের সূচনা আওয়ামী লীগ সরকারের হাত ধরে হয়েছে। এ কারণে এই সরকারকে বিচারের মুখোমুখি হতে হবে বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী।
৩০ আগস্ট আন্তর্জাতিক গুম দিবস উপলক্ষে রাজধানীর নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে এ মন্তব্য করেন তিনি।
অ্যান্থনির লেখা ‘বাংলাদেশ এ লিগেসি অব ব্লাড, ইউনাইটেড কিংডম’ বইয়ের উদ্ধৃতি দিয়ে রিজভী বলেন, বাংলাদেশে গুমের ঘটনার সূত্রপাত ঘটে স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশে ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত শেখ মুজিবুর রহমানের শাসনামলে। ওই সময় জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) অসংখ্য কর্মী-সদস্য, সরকারি কর্মকর্তা এবং অন্যান্য বিরোধী রাজনৈতিক দলের অসংখ্য সদস্যকে গুমের শিকার হতে হয় জাতীয় রক্ষী বাহিনীর হাতে, যা তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের এলিট প্যারামিলিটারি ফোর্স ছিল।
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ফের ক্ষমতায় এসে গুমের সংস্কৃতি চালু করেছে দাবি করে বিএনপির এ নেতা বলেন, ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ গঠন করার পর থেকে এখন পর্যন্ত সারা দেশে গুম হওয়া মানুষের সংখ্যা ১২০৯ জন। এর মধ্যে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে গুমের সংখ্যা ৭৮১ জন। এদের মধ্যে রয়েছেন-জনপ্রতিনিধি বিএনপির সাবেক এমপি এম ইলিয়াস আলী, সাইফুল ইসলাম হিরু, কাউন্সিলর চৌধুরী আলম, লাকসাম বিএনপি নেতা হুমায়ুন কবির পারভেজ, সুমন, ছাত্রনেতা জাকির, নিজামুদ্দিন মুন্না, তারিকুল ইসলাম ঝন্টু, আদনান চৌধুরী, মো. সোহেল, খালিদ হোসেন সোহেল, সম্রাট মোল্লা, মাহবুব হাসান সুজনসহ বিএনপি ও অঙ্গ সংগঠনের শত শত নেতাকর্মী।
বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদের নিরুদ্দেশ থাকার কথা উল্লেখ করে রিজভী বলেন, সালাহউদ্দিনকে দুই মাস গুম করে রাখার পর অন্য দেশে ফেলে দিয়ে এসেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। গুমের শিকার পরিবারের সদস্যরা এখনও পথ চেয়ে বসে আছেন। ছোট্ট শিশুরা অপেক্ষা করছে বাবা ফিরে আসবে সেই আশায়, সন্তানের দুশ্চিন্তায় অনেকের বাবা-মা দুনিয়া ছেড়ে চলে গেছেন। নিখোঁজ সুমনের মা চোখের পানি ফেলতে ফেলতে অন্ধ হয়ে গেছেন। গুমের শিকার প্রতিটি পরিবারের কান্না-আহাজারি আর প্রতীক্ষার দিবানিশি শেষ হচ্ছে না।
কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আলজাজিরার একটি প্রতিবেদনের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ২২ জুন একটি পত্রিকার সূত্র ধরে আলজাজিরার প্রতিবেদনে বলা হয় যে, গত কয়েক বছরে যেসব মানুষ নিখোঁজ হয়েছে তার বেশিরভাগই বিরোধী দল বাংলাদেশ বিএনপির সদস্য। এদের মধ্যে আরও আছেন মানবাধিকারকর্মী, যারা ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সমালোচনায় সোচ্চার ছিলেন।
রিজভী বলেন, ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন ফর হিউম্যান রাইটসের প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০০৯ সালের শুরু থেকে ২০১৮ সালের শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে ৫০৭টি জোরপূর্বক গুম প্রামাণ্য দলিল হিসেবে উপস্থাপন করেছে নাগরিক সমাজবিষয়ক গ্রুপগুলো। গুম হয়ে যাওয়া মানুষের মধ্যে ২৮৬ জন জীবিত ফিরেছেন ঘরে। ৬২ জনকে উদ্ধার করা হয়েছে মৃত অবস্থায়। বাকি ১৫৯ জন মানুষ আজও নিখোঁজ। গতকাল (বৃহস্পতিবার) আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) তথ্যমতে, ২০১৪ থেকে ২০১৯ (জুলাই) পর্যন্ত ৩৪৪ জন গুমের শিকার হয়েছেন। এদের মধ্যে পরবর্তী সময়ে ৪৪ জনের লাশ উদ্ধার হয়েছে, ৬০ জনকে গ্রেফতার দেখানো হয়েছে এবং ৩৫ জন ফেরত এসেছে। এসব ঘটনায় অধিকাংশ ক্ষেত্রে পরিবার, স্বজন বা প্রত্যক্ষদর্শীরা দাবি করেছেন যে, বিশেষ বাহিনী-র্যাব, ডিবি পুলিশ ও গোয়েন্দা বিভাগের পরিচয়ে সাদা পোশাকে ব্যক্তি বা ব্যক্তিদের তুলে নেয়া হচ্ছে। বেশিরভাগ গুমের জন্য সন্দেহ করা হয়-পুলিশ, ডিবি পুলিশ ও র্যাবকে।
বাংলাদেশে বর্তমানে গুমের ধারাবাহিকতা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত উল্লেখ করে বিএনপির এ নেতা বলেন, গুমের শুরু হয়েছিল ১৯৭২ থেকে ৭৫ সালে। গণতন্ত্রের অকাল প্রয়াণ ঘটানোর জন্যই গুমের মতো অমানবিক কর্মসূচি হাতে নিয়েছেন ক্ষমতাসীনরা। গণতন্ত্র হত্যায় রাষ্ট্রের এই নিষ্ঠুর চেহারা দেখে জনগণ শোক জানাতেও ভয় পাচ্ছে। গুম একটি ভয়ঙ্কর মানবতাবিরোধী অপরাধ। গুমকে ব্যবহার করা হচ্ছে সুদূরপ্রসারী উদ্দেশ্য নিয়ে, বিরোধী দল ও মতকে নির্মূল করে রাষ্ট্র-সমাজে একমাত্রিকতা, কর্তৃত্ববাদী ও একদলীয় শাসনব্যবস্থাকে দীর্ঘস্থায়ী করাই এর মূল লক্ষ্য। মানুষের কঙ্কাল দিয়েই নিষ্ঠুর একদলীয় শাসন কায়েম হয়। এ কারণেই ভিন্নমত, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, আইনের শাসনসহ রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক বিকাশকে সর্বশক্তি দিয়ে রুদ্ধ করা হয়েছে। চিরদিনের জন্য নিখোঁজ হওয়ার ভয়ে মানুষ বিদ্যমান দুঃশাসনের বিরুদ্ধে যাতে প্রতিবাদী হয়ে উঠতে না পারে, সে জন্য বর্তমান সরকার গুমকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে। গুম আদিম বন্য ব্যবস্থা। এই নিষ্ঠুর কাজের সঙ্গে যারা জড়িত, তারা হিংস্র প্রাণীর সঙ্গেই তুলনীয়।
তিনি বলেন, জোরপূর্বক বা যেকোনো ধরনের গুম বন্ধ করতে সরকারের প্রতি জাতিসংঘ ও হিউম্যান রাইটস ওয়াচসহ বিভিন্ন সংস্থা আহ্বান জানিয়েছে। দুঃখের সঙ্গে বলতে হয়-আওয়ামী লীগ সরকারের নীতিনির্ধারক থেকে শুরু করে প্রথম সারির মন্ত্রীরা পর্যন্ত সেই আহ্বানকে উড়িয়ে দিয়েছে। তারা সবসময়ই গুমের তথ্যপ্রমাণসমূহকে আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে মিথ্যা প্রচারণা বলে এড়িয়ে চলে।
মানবাধিকার বিষয়ক সংগঠন এশিয়ান লিগ্যাল রিসোর্স সেন্টারের(এএলআরসি) একটি প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০০৯ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ২০১৮ সালের ৩১ জুলাইয়ের মধ্যে অন্তত ৪৩৫ জনকে গুম করেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। লোকজনকে তুলে নেয়া ও গুমের সঙ্গে জড়িত হিসেবে ডিবি, গোয়েন্দা বিভাগ, পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট (সিটিটিসিইউ) ও র্যাবের নাম উঠে এসেছে। একই প্রতিবেদনে নাগরিকদের তুলে নেয়া ও গুমের ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগ বারবার অস্বীকার করে আসছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীগুলো।
গত বছরের ৩১ আগস্ট গণমাধ্যমের একটি প্রতিবেদনের কথা উল্লেখ করে রিজভী বলেন, নিখোঁজ হওয়ার কয়েক সপ্তাহ/মাস পর এক-চতুর্থাংশ মানুষকে পাওয়া যাচ্ছে বন্দি অবস্থায় তাদের বিরুদ্ধে আনা হচ্ছে নানা রকম বানোয়াট ফৌজদারি অভিযোগ। বন্দিদশা থেকে মুক্ত হয়ে যারা ঘরে ফিরছেন, তারা ভয়ে কেউ মুখ খুলছেন না।
বিভিন্ন দেশের গুমের ইতিহাস তুলে ধরে রুহুল কবির রিজভী বলেন, মানব সভ্যতার ইতিহাসে সবচেয়ে করুণ কাহিনী হচ্ছে গুমের কাহিনী। কোনো অপরাধই চিরদিনই শাস্তি এড়িয়ে যেতে পারে না, কোনো না কোনো দিন এর বিচার হয়। দায়ী ব্যক্তিদের বিচার না হলে সেই রাষ্ট্র ক্রমে দানব থেকে মহাদানবে পরিণত হয়ে একসময় সার্বিক ধ্বংস অনিবার্য করে তুলে ক্ষতি করে দেশ ও জনগোষ্ঠীর। যেমন-হিসেন হেব্রে প্রায় ৮ বছর আফ্রিকার চাদের রাষ্ট্রপতি ছিলেন। ৮ বছরে হত্যা, নির্যাতন, গুমসহ অসংখ্য অপকর্ম করেছিল, তারও যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়েছিল। আর্জেন্টিনার ক্ষমতাবাদ জেনারেল রেনাল বিগনান যিনি অনেক রক্ত ঝরিয়েছেন তাকেও বিচারের মুখোমুখি হয়ে শাস্তি পেতে হয়েছে। গুয়েতেমালার হত্যা-গুমের হোতা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও বিচারের হাত থেকে রেহাই পাচ্ছে না।
বাংলাদেশে গুমের ইতিহাস সৃষ্টি করেছে আওয়ামী সরকার এমন দাবি করে রিজভী বলেন, রাষ্ট্রীয় মদদ ছাড়া কাউকে গুম করা অসম্ভব। গুম ও ক্রসফায়ারের মতো গুরুতর অপরাধের ঘটনাগুলো সমাজে, সংবাদমাধ্যমে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তোলপাড় সৃষ্টি হলেও তাতে সরকারের টনক নড়ে না। সুতরাং এতেই বোঝা যায়, এতসব গুমের হোতা কারা। গুমের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তি ও তাদের মদদদানকারীরাও বিচারের আওতার বাইরে থাকবে না। প্রতিটি গুমের তদন্ত ও বিচার একদিন হবেই।