আইন অনুসারে রোহিঙ্গাদের জন্য মোবাইল ফোন ব্যবহার অবৈধ হলেও তারা প্রশাসনের লোকদের সামনে প্রকাশ্যেই মোবাইল ফোন ব্যবহার করছে।
রোহিঙ্গাদের আগমনের দুই বছর পূর্তি উপলক্ষে কয়েক লাখ রোহিঙ্গা ২৫ আগস্ট হঠাৎ করে জমায়েত হয়ে জনসভা করে।
বাংলাদেশ মুঠোফোন গ্রাহক অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মহিউদ্দিন আহমেদ বলছেন, অবৈধভাবে টেলিযোগাযোগ নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে সংগঠিত হচ্ছে রোহিঙ্গারা।
আজ শনিবার গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে তিনি বলেন, আশ্রয় গ্রহণের সময় টেকনাফের এক শ্রেণীর অসাধু ব্যক্তি ৫০০ থেকে এক হাজার টাকার বিনিময়ে রোহিঙ্গাদের কাছে সিম বিক্রি করে। এর প্রতিবাদে মানববন্ধন করে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণের আহ্বান জানিয়েছিলাম। কিন্তু নিয়ন্ত্রক সংস্থা বা সরকার কর্ণপাত করেন নাই।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দুই বছর আগেও মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের রোহিঙ্গা পরিবারগুলো ছিল পরস্পর বিচ্ছিন্ন। সেখানে সভা-সমাবেশ তো দূরের কথা, গ্রামের বাইরে বের হতেই কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিতে হতো। মিয়ানমার বাহিনীর হামলা থেকে প্রাণে বাঁচতে এ দেশে ছুটে আসে।
গত রোববার সেই রোহিঙ্গারা এক বিশাল সমাবেশে বলেছে, একজন রোহিঙ্গাকেও ফেরত পাঠানোর চেষ্টা করা হলে পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে উঠবে। মিয়ানমারের নাগরিকত্ব ছাড়া তাদের কেউই কখনো ফিরবে না।
প্রশ্ন উঠেছে, যে রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের রাখাইনে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারেনি তারা মাত্র দুই বছরে এখানে এত সংগঠিত কীভাবে হলো? শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত এই জনগোষ্ঠীকে ইংরেজিতে লেখা প্ল্যাকার্ড, ব্যানার কারা সরবরাহ করেছে? বিশাল আকৃতির ব্যানারগুলোই বা তারা কোথায় পেয়েছে?
বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে, ৩৪টি ক্যাম্পে আশ্রিত ৭ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা ব্যবহার করছে মোবাইল ফোন। শরণার্থী আইন অনুসারে উদ্বাস্তুরা অবৈধভাবে মোবাইল ফোন ব্যবহার করতে না পারলেও কয়েকটি এনজিওর কারণে এ পর্যন্ত ক্যাম্পে মোবাইল ফোন উদ্ধারে অভিযান চালানো হয়নি। নানা অপরাধ দমন করতে সরকার রোহিঙ্গা শিবিরে মোবাইল নেটওয়ার্ক বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নিলেও এ পর্যন্ত তা বাস্তবায়ন করতে পারেনি।
নেটওয়ার্ক বন্ধকরণ সিদ্ধান্তের বিরোধিতাকারী কয়েকটি এনজিও’র কারণে ৭ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা ব্যবহার করছে মোবাইল ফোন। রোহিঙ্গাদের হাতে থাকা মোবাইলের নেটওয়ার্ক বন্ধ না হওয়ায় শিবিরে প্রতিনিয়ত নানা অপরাধ বৃদ্ধি পাচ্ছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, আশ্রয় শিবিরে ইতিপূর্বে মোবাইল ফোনে বেআইনি কর্মকাণ্ড ঘটছে মর্মে নিশ্চিত হয়ে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় থেকে মোবাইল অপারেটরগুলোর কাছে প্রস্তাব পাঠানো হয়েছিল।
ওই চিঠিতে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী যেন মোবাইল নেটওয়ার্ক সুবিধা না পায়, সেজন্য অপারেটরগুলোকে ব্যবস্থা নিতে বলেছিল সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।
বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন বিটিআরসি মোবাইল ফোন অপারেটরগুলোকে এ বিষয়ে নির্দেশনা সংক্রান্ত চিঠিও পাঠিয়েছিল। তবে এ পর্যন্ত তারা ওই চিঠির প্রস্তাব বাস্তবায়ন করতে পারেনি।
এছাড়াও বিভিন্ন অপারেটরের ফ্রিকোয়েন্সি সীমান্তের ওপারে বিস্তৃত হওয়ায় এদেশের সিম মোবাইল ফোনে ও ইন্টারনেটে ব্যবহার করছে মিয়ানমারের নাগরিকরা।
এমনকি দেশটির সরকারি বাহিনীর সদস্য অনেকে বাংলাদেশের সিম ব্যবহার করছে। বাংলাদেশের বিভিন্ন অপারেটর কোম্পানির ফ্রিকোয়েন্সি মিয়ানমারের অন্তত ৫ কিলোমিটার ভেতরেও পাওয়া যাচ্ছে। এতে দেশের জাতীয় নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়েছে।
ইতিপূর্বে দেয়া বিটিআরসির চিঠিতে জানানো হয়, বিভিন্ন নিরাপত্তা সংস্থা বর্তমানে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে বিভিন্ন সিম বিক্রি ও অপব্যবহারের তথ্য পেয়েছে। চিঠিতে অপারেটরগুলোকে মোবাইল নেটওয়ার্ক যেন মিয়ানমার পর্যন্ত না পাওয়া যায় এবং রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর মোবাইল নেটওয়ার্ক সুবিধা বন্ধ করে দিতে বলা হয়েছে। কিন্তু অপারেটরগুলো সরকারের ওই নির্দেশ উপেক্ষা করে চলেছে।
২০১৭ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর তৎকালীন ডাক ও টেলিযোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী তারানা হালিম এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, বাংলাদেশে আসা রোহিঙ্গা শরণার্থীদের বাংলাদেশি অপারেটরদের সিম ব্যবহার বন্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেয়া হবে। কিছু বাংলাদেশি নিজেদের বায়োম্যাট্রিক তথ্য ব্যবহার করে নিবন্ধিত সিম রোহিঙ্গাদের মধ্যে বিক্রি করছেন। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়াসহ সিম ব্যবহার বন্ধে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করা হবে।
বাংলাদেশ মুঠোফোন গ্রাহক অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মহিউদ্দিন আহমেদ বলছেন, গত সপ্তাহে রোহিঙ্গা আগমনের দুই বছর পূর্তি উপলক্ষে লক্ষ লক্ষ রোহিঙ্গা হঠাৎ করে জমায়েত হয়ে জনসভা করে। পররাষ্ট্র মন্ত্রীও বলেন সরকার এ বিষয়ে কিছুই জানত না। আমরা গত দুই দিন টেলিভিশনের পর্দায় রোহিঙ্গা নেতা মহিবুল্লাহর সাক্ষাৎকারে দেখলাম তিনি মোবাইল ফোনে বিভিন্ন ভিডিও গণমাধ্যম কর্মীদের দেখাচ্ছিলেন এবং সেই নেতা অনলাইন টেলিভিশনে রোহিঙ্গা ক্যাম্পের খবর প্রচারের কথা স্বীকারও করেন।
জানা যায়, রোহিঙ্গারা কথা বলা ছাড়াও থ্রিজি-ফোরজি সেবা গ্রহণ করছে। সীমান্তের ওপারে নেটওয়ার্ক সম্প্রসারিত থাকায় বিষয়টি উদ্বেগজনক। সরকার যদি দ্রুত এ ব্যাপারে পদক্ষেপ গ্রহণ না করে তাহলে ভবিষ্যতে রোহিঙ্গারা আরও বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে। কারণ ইন্টারনেটের গ্রুপ চ্যাটিংয়ের মাধ্যমে দ্রুতই তারা লক্ষ লক্ষ লোক সমবেত হতে পারে।
এদিকে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণে টেকনাফ উপজেলার জাদিমুরা, শালবন, নয়াপাড়া, আলীখালী ও লেদায় আরও ৩টি নতুন পুলিশ ক্যাম্প স্থাপন করা হচ্ছে।
এ বিষয়ে ইতিমধ্যে প্রাথমিক প্রক্রিয়া চূড়ান্ত হয়েছে। টেকনাফ মডেল থানার আওতাধীন কক্সবাজার জেলা পুলিশ সরাসরি এ ক্যাম্পগুলো নিয়ন্ত্রণ করবে।
- আসামে নাগরিক তালিকায় নাম না থাকায় নারীর আত্মহত্যা
- জামালপুরের ভিডিওটি ছড়ানো নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন সুলতানা কামাল
কক্সবাজারের ভারপ্রাপ্ত পুলিশ সুপার মো. ইকবাল হোসেন বলেন, বিপুল সংখ্যক রোহিঙ্গা নিয়ে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাও উদ্বিগ্ন। একটি স্থানে এত মানুষ একসঙ্গে থাকতে পারে না। তাদের নিয়ন্ত্রণে রাখা আইন প্রয়োগকারি সংস্থার পক্ষে কঠিন হয়ে উঠেছে।
তিনি জানান, রোহিঙ্গা ক্যাম্পে এক হাজারের বেশি পুলিশ সদস্য মোতায়েন রয়েছে। এখানে নতুন তিনটিসহ ১০টি পুলিশ ক্যাম্প স্থাপন করা হয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ নয়টি স্থানে চেকপোস্ট বসানো হয়েছে। রয়েছে পুলিশের ১২টি বিশেষ মোবাইল টিম। ক্যাম্পে নানা সংকট থাকলেও তারা ঝুঁকি নিয়ে কাজ করে চলেছে।