আবরার ফাহাদ হত্যাকাণ্ডে উপাচার্যের পদত্যাগ দাবি করায় বুয়েট অ্যালামনাইয়ের সভাপতি অধ্যাপক ড. জামিলুর রেজা চৌধুরীর ওপর চটেছেন বিশ্ববিদ্যালয়টির উপাচার্য ড. সাইফুল ইসলাম।
ভারতের সঙ্গে চুক্তি নিয়ে ফেসুবকে স্ট্যাটাস দেয়ার জেরে ছাত্রলীগের হাতে নির্মমভাবে খুন আবরার। হত্যাকাণ্ডের বিচারসহ ১০ দফা দাবিতে আন্দোলন করছেন বুয়েট শিক্ষার্থীরা।
একই সঙ্গে উপাচার্যের পদত্যাগসহ সাত দফা জানান বুয়েটের সাবেক শিক্ষক ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিকের বর্তমান উপাচার্য ও বুয়েট অ্যালামনাইয়ের সভাপতি অধ্যাপক ড. জামিলুর রেজা চৌধুরী।
এ প্রসঙ্গে ভয়েস অব আমেরিকাকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে উপাচার্য সাইফুল ইসলাম বলেন, অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী দাবিকে যুক্তিযুক্ত মনে করি না।
জামিলুর রেজা চৌধুরী সম্পর্কে উপাচার্য সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘উনি আরেক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য। ওখানে কাজ ফেলে এখানে এসে আমার সঙ্গে কথা না বলে আমার পদত্যাগ চাইলেন কী করে? এটা এথিক্যাল হলো না। উনি সম্মানিত ব্যক্তি, আমি সবসময় সম্মান করে কথা বলি উনাকে। উনাকে অনেকসময় টেলিফোনও করি। কালকে আমি কুষ্টিয়া গেলাম, উনি এখানে এসে এ কথা বললেন। এটা তো যুক্তিযুক্ত কথা হলো না। একটা ঘটনা ঘটেছে, পূর্বাপর না জেনে কয়েকজনকে নিয়ে এ কথা বললেন। উনি এতবড় জ্ঞানী পণ্ডিত হয়ে এটা কীভাবে বললেন? আমি দুঃখিত ও মর্মাহত হয়েছি।’
আবরার ফাহাদ হত্যাকাণ্ড ও বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্তমান পরিস্থিতিতে নিজের ব্যর্থতা দেখছেন না বলেও জানিয়েছেন বুয়েট উপাচার্য ড. সাইফুল ইসলাম।
পদত্যাগ করবেন কিনা প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘প্রশ্নই ওঠে না। কারণ আমার এখানে কোনো অন্যায় নেই। আমি আমার ডিউটি পালন করেছি।’
উপাচার্য বলেন, আমার ব্যর্থতা কী করে হবে? আমি চেষ্টার কোনো ত্রুটি করিনি। আমি তো আইডেন্টিফাই করতে পেরেছি আগেই।
খুনের ঘটনায় নিজের ব্যর্থতা আছে কিনা প্রশ্নে তিনি বলেন, না আমার ব্যর্থতা কী করে হবে? আমি চেষ্টার কোনো ত্রুটি করিনি। আমি তো আইডেন্টিফাই করতে পেরেছি আগেই। ডিএসডব্লিউ (ছাত্রকল্যাণ পরিচালক) চেঞ্জ করলাম।
ভবিষ্যতে যেন এ ধরনের ঘটনা না ঘটে সে জন্য কী ধরনের ব্যবস্থার কথা ভাবছেন প্রশ্নে সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘আমাকে এখন কড়া ডিএসডব্লিউ নিয়োগ দিতে হবে। এই কাজটি তো কেউই করতে চায় না। তদন্ত কমিটি যেটি করলাম, করে শেষ করিনি ইমেইলে বলছে- এ দায়িত্ব পালন করতে পারবে না। কাকে দিলে চলবে কাকে দিলে চলবে না আমাকে খুঁজতে হয়। এ করতে করতে মাথার চুল আর থাকে না।’
ছাত্ররা যে ১০ দফা দাবি জানিয়েছেন তার মধ্যে অন্যতম দাবি বুয়েটের শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদকে যারা হত্যা করেছে বলে অভিযুক্ত তাদের ৭২ ঘণ্টার মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করতে হবে। ফৌজদারি বিচারের ওপর বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই, কোর্টের মাধ্যমে বিচার হবে। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অভিযুক্ত ছাত্র বহিষ্কার করার যে বিষয়টি সেটি তো আপনার নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। ৭২ ঘণ্টা পার হয়ে গেছে।
এ দাবির পরিপ্রেক্ষিতে উপাচার্য হিসেবে আপনি কী পদক্ষেপ নিচ্ছেন জানতে চাইলে ড. সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘যে কোনো জিনিসের প্রসিডিওর আছে। আমাদের নিয়ম তদন্ত কমিটি। সেদিন সঙ্গে সঙ্গেই তদন্ত কমিটি হয়েছে। এবং অবশ্যই এদের বের করে দেয়া হবে। অপরাধীকে কীভাবে রাখব? লিগ্যাল প্রসিডিওর ফলো করতে হয়। সেটি যদি আমরা না করি, এর আগেও কিন্তু কোর্টে গিয়ে আমাদের হাঁটতে হয়েছে।
এই তদন্ত কমিটি কদিনের মধ্যে প্রতিবেদন দেবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘১০ দিনের মধ্যে। আমাদের একটা স্ট্যান্ডার্ড প্রসিডিওর আছে।’
র্যাগিংয়ের নামে বুয়েটে নির্যাতনের ঘটনা হরহামেশাই ঘটে আসছে। ২০১৭ সালে ৩১ মার্চ এ বিষয়ে একটি ওয়েবপেজ খোলা হয়। ২০১৯ সালের ৯ অক্টোবর পর্যন্ত সেখানে ১৬৬টি অভিযোগ জমা পড়েছে। সেখানে দেখা যায়, যেভাবে আবরারকে নির্যাতন করা হয়েছে তেমন ঘটনা এর আগে বহুবার ঘটেছে। আপনি এসব জানতেন কিনা প্রশ্নে উপাচার্য বলেন, ‘একদিন আমি শিক্ষকদের মিটিং থেকে ছাত্রকল্যাণ পরিচালককে ফোন করে বললাম, ‘এ রকম নির্যাতন হচ্ছে, গার্ডিয়ানরা অভিযোগ করছেন, কী তুমি ব্যবস্থা নিচ্ছ না?’ উত্তরে তিনি বলেন, ‘এ রকম কোনো প্রমাণ নেই।’
আমি বললাম, ‘এটা কোনো প্রমাণের দরকার পড়ে না।’ কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে যখন একজন ভিসি হয় তখন সবসময় কাউন্টার পার্ট হয়ে যায়। ভিসি পদটা সুখকর কোনো পদ না। কারও না কারও স্বার্থে লাগে। আরেকটি জিনিসও থাকে, সরিয়ে আরেকজন ভিসি হওয়া যায়।
বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরীণ শিক্ষক রাজনীতির কারণে সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে বলে মনে করছেন কিনা প্রশ্নে বুয়েট ভিসি বলেন, ‘এটা তো একটা পার্ট আছেই। সুনির্দিষ্টভাবে বলা মুশকিল। আমাকে সব মতাবলম্বীকে নিয়েই বিশ্ববিদ্যালয় চালাতে হয়।’
র্যাগিং হয় জানতেন কিনা প্রশ্নে সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘জানার পরেই তো ডিএসডব্লিউকে ফোন করি, তিনি তো সরাসরি অস্বীকার করলেন। নতুন ছাত্রকল্যাণ পরিচালক, তার অবহেলার কারণে এ রকম ঘটনা ঘটল? অবহেলা বলব না, আগের ডিএসডব্লিউ তো অনেক দিন ছিল। তার অবহেলার কারণে যে কাণ্ডটা ঘটেছে সেটি মেকআপ করতে যে সময় লাগে সেটা তো উনি পাননি। ছাত্ররা এ রকম কাণ্ড ঘটিয়ে ফেলবে, এটি আমার আসার আগে আরও খারাপ ছিল।
ডেডবডি ক্যাম্পাসে আনার কথা তাকে কেউ জানায়নি দাবি করে সাক্ষাৎকারে উপাচার্য বলেন, ‘আমি জানি ডেডবডি নিয়ে গেছে। সেদিন কেওয়াটিক পরিস্থিতিতে কোথাকার খবর কোথায় দেয়ার মতো লোকও নেই।’
বেশ কয়েকজন শিক্ষক জানাজায় অংশ নিয়েছেন আপনি তা জানতেন কিনা- এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘এখানে ডেডবডি এসেছে এই খবর আমাকে কেউ বলেনি। এর মধ্যে আমি আবার গিয়েছিলাম মন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে।’
- আরও পড়ুন >> ফেনীতে যুবলীগ নেতাকে বাড়ির দরজায় কুপিয়ে হত্যা
প্রসঙ্গত ভারতের সঙ্গে চুক্তির বিরোধিতা করে শনিবার বিকালে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাস দেন ফাহাদ। এর জের ধরে রোববার রাতে শেরেবাংলা হলের ২০১১ নম্বর কক্ষে ডেকে নিয়ে তাকে পিটিয়ে হত্যা করেন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। পরে তার লাশ সিঁড়িতে ফেলে রাখা হয়।