দিশাহারা মেনন ও সময়ের সাবধান বাণী

আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী

আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরী
আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরী। ফাইল ছবি

বাংলাদেশের রাজনীতির দিঘির জল বহুদিন প্রায় নিথর হয়ে ছিল। হঠাৎ রাশেদ খান মেনন তাতে একটা ঢিল ছুড়ে মেরেছেন। তাতে দিঘির জলে কিছুটা ঢেউ সৃষ্টি হয়েছে। এটা স্বাভাবিক। মেননের এই ঢিল ছোড়ায় আর কেউ আনন্দিত না হোক, আনন্দিত হয়েছেন বিএনপি-ঐক্যফ্রন্টের নেতারা—বিশেষ করে ড. কামাল হোসেন। কারণ দেশের রাজনীতিতে এই ঢেউ সৃষ্টি করার ক্ষমতা তাঁদের আর নেই।

বরিশালে তাঁর দলের সভায় রাশেদ খান মেনন বলেছেন, ‘আমি নির্বাচিত হয়েছি। তার পরও আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি, ওই নির্বাচনে (৩০ ডিসেম্বর ২০১৮) জনগণ ভোট দিতে পারেনি। এমনকি পরবর্তী সময়ে উপজেলা এবং ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনেও ভোট দিতে পারেনি দেশের জনগণ।’ তাঁর এই কথায় দেশে একটা হৈচৈ সৃষ্টি হয়েছে অবশ্যই। এই বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরকে মুখ খুলতে হয়েছে। কারণ মেনন তাঁদের ১৪ দলীয় জোটের গত দুই মন্ত্রিসভায় মন্ত্রী ছিলেন। এবারের নির্বাচনেও তিনি জয়ী হয়েছেন; কিন্তু তাঁকে মন্ত্রী করা হয়নি।

ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ঢাকা-৮ আসনে মেনন নৌকা প্রতীক নিয়েই দুই সংসদ নির্বাচনে জয়ী হয়েছেন এবং মন্ত্রী হয়েছেন। এবারের নির্বাচনেও তিনি জয়ী হয়েছেন। কিন্তু তাঁকে মন্ত্রী করা হয়নি। মন্ত্রী হলে কি তিনি এ কথা বলতেন?

মেনন তাঁর বক্তব্যের নানা নিন্দা-প্রশংসার মুখে তার একটা ব্যাখ্যা দিয়েছেন। এই ব্যাখ্যাটি খবরের কাগজে পাঠ করে মনে হয়েছে, তিনি তাঁর বরিশালের বক্তব্য থেকে কিছুটা সরে আসতে চান। সরে আসতে চেয়ে যা বলেছেন, তা রাজনৈতিক আপ্তবাক্য। তার বেশি কিছু নয়। শাক দিয়ে যেমন মাছ ঢাকা যায় না, তেমনি এই ব্যাখ্যা দ্বারাও তিনি বরিশালের বক্তব্য থেকে সরে আসতে পারবেন না।

মেননের ওয়ার্কার্স পার্টির সঙ্গে রয়েছে পশ্চিমবঙ্গের (ভারতের) সিপিএমের নীতিগত ঐক্য। এই সিপিএমের নেতা জ্যোতি বসু বাংলা কংগ্রেসের অজয় মুখার্জির সঙ্গে রাজনৈতিক ঐক্য করেছিলেন। এমনকি ওই সরকারের উপমুখ্যমন্ত্রীও হয়েছিলেন। তারপর কী কারণে এই ঐক্য ভেঙে গিয়েছিল এবং জ্যোতি বসু উপমুখ্যমন্ত্রীর পদ ছেড়ে দিয়েছিলেন, মেনন তা জানেন।

বাংলাদেশে এই সরকার যদি জনগণের ভোটাধিকার হরণ করে থাকে, তাহলে মেননের কী করা উচিত ছিল? ডিসেম্বরের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সংসদের সদস্যপদ ছেড়ে দিয়ে ১৪ দলীয় জোটকে তার প্রতিবাদ জানানো। প্রয়োজনে জোট ছেড়ে দেওয়া। নির্বাচন হয়ে যাওয়ার পর ১০ মাস কেটে গেছে। এই ১০ মাস তিনি একটা কথা বলেননি, সংসদের সদস্য পদ ত্যাগ করা দূরের কথা।

এই নির্বাচনে জনগণ ভোট দিতে পারেনি, এ কথা মেননের বলার অর্থ, তাঁর নির্বাচনী কেন্দ্রেও সঠিক ভোট হয়নি। এ ধরনের অভিযোগ তোলার পর তাঁর তো সংসদীয় সদস্য পদে থাকা উচিত নয়। তাঁর উচিত পদত্যাগ করা এবং তাঁর কেন্দ্রে নতুন নির্বাচনের দাবি জানানো। তিনি যদি তা না করেন, তাহলে সাধারণ মানুষ ভাবতেই পারে, তিনি গত ১০ মাস সংসদের সদস্য পদ আঁকড়ে ধরে আছেন এই আশায় যে প্রধানমন্ত্রী হয়তো শেষ পর্যন্ত আবার মন্ত্রী হতে তাঁকে ডাকবেন। আশায় আশায় দীর্ঘ ১০ মাস কাটিয়ে এখন আশাহারা হয়েই মুখ খুলেছেন। কিন্তু সংসদের সদস্য পদে ইস্তফা দিতে পারেননি। তাতেই বোঝা যায়, তাঁর নিজের অভিযোগেও তাঁর নিজের বিশ্বাস নেই। নিজে যে অভিযোগে তিনি বিশ্বাস করেন না, তা জনগণকে বিশ্বাস করাবেন কী করে?

১৪ দলীয় জোটের শুধু রাশেদ খান মেননকে নয়, জাসদের হাসানুল হক ইনু, জাতীয় পার্টির (মঞ্জু গ্রুপ) আনোয়ার হোসেন মঞ্জুসহ আওয়ামী লীগের প্রবীণ নেতা তোফায়েল আহমেদকে পর্যন্ত এবার মন্ত্রী করা হয়নি। তাতে তাঁরা নৈরাশ্যপীড়িত হননি। কিন্তু মেনন বিএনপি, জামায়াত, বিশেষ করে ড. কামাল হোসেনের বিষোদগারকেও নিজের মুখে তুলে এনেছেন। অথচ তাঁর বরিশালের বক্তৃতায়ও তিনি ড. কামাল হোসেনের ‘পলায়নী রাজনীতির’ কঠোর সমালোচনা করেছেন। তাতে কামাল হোসেন তাঁর ওপর বিন্দুমাত্র রাগ করেননি। বলেছেন, ‘মেরেছ কলসীর কানা, তা বলে কি প্রেম দেব না?’ তিনি মেননের বরিশাল-বক্তৃতার প্রশংসা করেছেন।

আমার মনে এখন অশেষ দুঃখ। মেননের মতো রাজনীতিকও শেষ পর্যন্ত হতাশাপীড়িত ও ব্যর্থ রাজনীতিকদের দলে গিয়ে না মিশলেও তাঁদের অসত্য প্রলাপে কণ্ঠ মেলাবেন তা আশা করিনি। তাঁর কাছ থেকে আরো অনেক ম্যাচিউর রাজনীতি আশা করেছিলাম। মেননকে আমি তাঁর ছাত্রজীবন থেকে চিনি। তাঁর ছাত্রজীবনের রাজনীতির সঙ্গে আমি কখনো সহমত পোষণ করিনি; কিন্তু তাঁর রাজনৈতিক সাহস ও নীতিনিষ্ঠাকে সব সময় সম্মান দেখিয়েছি। তাঁর ওয়ার্কার্স পার্টি মহাজোটে যোগ দেওয়ায় এবং শেখ হাসিনা শেষ পর্যন্ত তাঁকে মন্ত্রিসভায় গ্রহণ করায় খুব খুশি হয়েছিলাম।

দুই বছর আগে আমি যখন লন্ডনের নর্থউইক পার্ক হাসপাতালে নিউমোনিয়া রোগে আক্রান্ত হয়ে শয্যাশায়ী ছিলাম, তখন মেনন আমাকে দেখতে এসেছিলেন। আমি তাঁকে উদ্বিগ্ন স্বরে জিজ্ঞেস করেছিলাম, আসন্ন নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জিতবে তো? তিনি জবাব দিয়েছিলেন, ‘জয়ী তো হতে হবেই।’ তাঁর জবাবের সারমর্ম তখনই আমি বুঝে ফেলেছিলাম। তিনি আরো বলেছিলেন, ‘ভালো হোক, মন্দ হোক—এই মুহূর্তে হাসিনা সরকার ছাড়া আমাদের কোনো বিকল্প নেই। গণতন্ত্রের নামেও এ সরকারকে ক্ষমতা থেকে সরানোর অর্থ হবে দেশে আফগানিস্তানের তালেবানি শাসন ডেকে আনা। তাহলে আমাদের ৪০ বছরের রাজনৈতিক সংগ্রামের সব অর্জন ব্যর্থ হয়ে যাবে।’

এই রাশেদ খান মেনন এখন কোনো নীতির প্রশ্নে নয়, যদি মন্ত্রিত্ব হারানোর দুঃখে কামাল হোসেনদের তোতাপাখি হন, তাহলে আমার মতো অনেকের মনে দুঃখের অন্ত থাকবে না। মেনন ১৪ দলীয় জোটে এসেছিলেন মন্ত্রী হওয়ার জন্য নয়, এসেছিলেন দেশটাকে সাম্প্রদায়িকতা, ধর্মান্ধতার দানবের গ্রাস থেকে বাঁচানোর জন্য। আ স ম আবদুর রবদের মতো একবার এরশাদের গৃহপালিত বিরোধীদলীয় নেতা, একবার হাসিনার মন্ত্রী হওয়া এবং শেষ পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধের বীর সৈনিক হওয়ার সব গৌরব বিসর্জন দিয়ে স্বাধীনতার শত্রুদের মঞ্চে গিয়ে খেমটা নাচ দেখানোর রেকর্ড তাঁর নেই। ১৪ দলীয় জোট আর কিছু না পারুক দেশটাকে সাম্প্রদায়িক ও ধর্মান্ধতার রাষ্ট্র হতে দেয়নি। অন্তত এ জন্যই মেননের উচিত হবে না, ১৪ দলীয় মহাজোটের ক্ষতি হোক—এমন ধরনের কোনো রাজনীতি করা, রাজনৈতিক কথা বলা।

দেশে এখন হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে একটার পর একটা ভয়াবহ চক্রান্ত চলছে। ড. কামাল হোসেন এই বুড়ো বয়সেও তাঁর স্বভাব ত্যাগ করতে পারেননি। সঙ্গে জুটেছে নন্দিভৃঙ্গির দল। ছোট-বড় একটার পর একটা চক্রান্ত চলছে। বুয়েটের আবরার হত্যা থেকে ভোলার বোরহানউদ্দিনে মোল্লাবাদীদের আবার মাথা তোলার চেষ্টা—এর কোনোটাই হাসিনার বিরুদ্ধে দফাওয়ারি চক্রান্ত থেকে বিচ্ছিন্ন নয়। তাই দেশের সব মানুষের কাছে জোড় হাতে অনুরোধ জানাই, দেশে একটার পর একটা কাশিমবাজারের কুঠি গড়ে উঠছে, ঘসেটি বেগম জেলে থাকলেও মীরজাফরপুত্র মীরন মুঙ্গেরে (লন্ডন) বসে একটার পর একটা ষড়যন্ত্রের ছুরিতে শাণ দিচ্ছে। এই সময় স্বাধীনতার মিত্রপক্ষের শক্তিকে আরো ঐক্যবদ্ধ এবং আরো সতর্ক হতে হবে। এ ব্যাপারে শেখ হাসিনাকেও অনুরোধ জানাচ্ছি, তিনি যেন মেননদের মতো মিত্রদের দূরে সরিয়ে না দেন।

শেয়ার করুন

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে