দুর্নীতি করতে অতিরিক্ত ব্যয়ে প্রকল্প বাস্তবায়ন, সময় মতো প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে না পারা বা দফায় দফায় ব্যয় বাড়ানো; প্রকল্প বাছাইয়ে দুর্বলতা কিংবা কোনো কোনো প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে না পারা বা প্রকল্পের সুফল সবার কাছে পৌঁছে দিতে না পারাসহ সরকারের উন্নয়ন প্রকল্পের নানা অনিয়ম বর্তমান সময়ে বেশ আলোচিত। অনেক প্রকল্পে এসব অনিয়মের শুরু হয় যথাযথভাবে সম্ভাব্যতা যাচাই না করে তা অনুমোদন দেয়ার মাধ্যমে।
সাম্প্রতিক সময়ে ‘বালিশ-কাণ্ড’ নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা হয়। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্পের আবাসিক ভবনের জন্য ১৬৯ কোটি টাকার কেনাকাটায় পদে পদে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে। সেখানকার বিছানা, বালিশ ও আসবাবপত্র কেনায় মালামালের প্রকৃত মূল্য অপেক্ষা ৩৬ কোটি ৪০ লাখ টাকা বেশি দেখানো হয়। ওই ঘটনায় প্রকৌশলী মোহাম্মদ মাসুদুল আলমসহ গণপূর্ত অধিদফতরের ১৬ কর্মকর্তাকে বরখাস্ত করা হয়। সেই সঙ্গে যাচাই-বাছাই ও বিল প্রদানের সঙ্গে জড়িত ১৪ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা করা হয়।
বালিশ-কাণ্ডের পর স্বাস্থ্য অধিদফতরের বিরুদ্ধে সাড়ে পাঁচ হাজার টাকার বই ৮৫ হাজার ৫০০ টাকায় কেনার অভিযোগ ওঠে। মোট ৯৫টি বই কেনার পেছনে খরচ দেখানো হয় ৪০ লাখ ৮৫ হাজার টাকা! এছাড়া মেট্রোরেল, পদ্মা সেতুর মতো মেগা প্রকল্পের ব্যয় বৃদ্ধির বিষয়টি অনেকে ‘দুর্নীতির নতুন নামকরণ’ বলে চিহ্নিত করেছেন। পাশাপাশি প্রকল্প-সংশ্লিষ্টদের অযাচিত সম্মানির বিষয়টিও অনেকে আড় চোখে দেখছেন।
প্রকল্পের এমন অনিয়মে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনার মধ্যে সাম্প্রতিক সময়ে একনেক (জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি) সভায় সম্ভাব্যতা যাচাই ছাড়া যেন প্রকল্প গ্রহণ না করা হয়, সেই নির্দেশনা দেন পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান। তারপরও পরিকল্পনা কমিশনে সম্ভাব্যতা যাচাই ছাড়া আসছে নতুন নতুন প্রকল্প। পরিকল্পনা কমিশনের কর্মকর্তারাও সম্ভাব্যতা যাচাই ছাড়া আসা প্রকল্পগুলোর কাজও দেদারছে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন- এমন অভিযোগও রয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সম্ভাব্যতা যাচাই ছাড়া আসা প্রকল্পের অন্যতম সাধারণ উদ্দেশ্যই থাকে অর্থ আত্মসাৎ। তারা এ-ও বলছেন, যাদের হাতে দেশের উন্নয়ন প্রকল্প প্রণীত ও বাস্তবায়িত হয়, তাদের একটা অংশ উন্নয়ন প্রকল্পকে নিজেদের অর্থ-সম্পত্তি বিকাশের সুযোগ হিসেবে দেখেন। এটা প্রকল্প-সংশ্লিষ্টদের সংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছে। যে কারণে জবাবদিহিহীনতা কিংবা যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ না করে প্রকল্প প্রণীত হচ্ছে।
সম্ভাব্যতা যাচাই ছাড়া সম্প্রতি পরিকল্পনা কমিশনে আসা একটি প্রকল্প ‘ঢাকা-লক্ষ্মীপুর নৌ-পথের লক্ষ্মীপুর প্রান্তে মেঘনা নদী ড্রেজিং নাব্যতা উন্নয়ন’। প্রকল্পের উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলা হয়েছে, ঢাকা-লক্ষ্মীপুর নৌ-পথের সমস্যা-সংকুল এলাকায় খননের মাধ্যমে নদীর নাব্যতা উন্নয়ন করে সারা বছর নৌ-পথ নিরবচ্ছিন্ন নৌযান চলাচলের পথ উন্মুক্ত করা। এমন একটা প্রকল্প নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) সম্ভাব্যতা যাচাই ছাড়াই সবধরনের দাপ্তরিক আনুষ্ঠানিকতা শেষে তা পরিকল্পনা কমিশনে পাঠিয়েছে।
পরিকল্পনা কমিশন বলছে, শুধুমাত্র বিআইডব্লিউটিএ-এর নির্বাহী প্রকৌশলীর নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদলের প্রতিবেদনের আলোকে উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনা (ডিপিপি) প্রণয়ন করা হয়েছে। তা-ই আলোচ্য প্রকল্পের যৌক্তিকতা এবং এ নদী পথের বর্তমান অবস্থা, মালামাল ও যাত্রী পরিবহন সম্পর্কিত তথ্য নিয়ে সন্দেহের অবকাশ রয়েছে।
প্রকল্পটির বিষয়ে পরিকল্পনা কমিশনের মতামত, ‘এর উদ্দেশ্য সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়নি। এটি আর্থিকভাবে অলাভজনক। এছাড়া বছরভিত্তিক ব্যয় প্রাক্কলনের ছক সঠিকভাবে প্রণয়ন করা হয়নি। পরামর্শকরা বেতনভুক্ত হওয়ার পরও সাইট পরিদর্শন-বাবদ তাদের জন্য দৈনিক ভাতা রাখা হয়েছে, যা সমীচীন নয়। প্রকল্পে ক্যাপিটাল ড্রেজিং এবং সংরক্ষণ ড্রেজিং-বাবদ প্রতি ঘনমিটার ১৯০ টাকা হারে প্রস্তাব করা হয়েছে। এ হারও যৌক্তিক নয়। বিষয়গুলো নিয়ে বিআইডব্লিউটিএ’র সঙ্গে আলোচনার মতও দেয় পরিকল্পনা কমিশন।
বিআইডব্লিউটিএ-এর চেয়ারম্যান কমোডোর মোহাম্মদ মাহবুব-উল ইসলাম দাবি করেন, ‘সম্প্রতি পরিকল্পনা কমিশনের সঙ্গে তাদের বৈঠক হয়েছে। আমি তো ছিলাম ওখানে। আমার যতটুকু মনে পড়ে, পরিকল্পনা কমিশন আমাদের মন্তব্যে সন্তুষ্ট।’
সম্ভাব্যতা যাচাই না করার বিষয়ে তিনি আরও বলেন, ‘এ প্রকল্প করাতে গেলে আমরা যদি স্ট্যাডি করাতাম, তাহলে এটার জন্য সময় লাগত এবং স্ট্যাডি করার জন্য আলাদা একটা প্রকল্প দিতে হতো। প্রকল্প পাস হওয়ার পর স্ট্যাডি করে আবার প্রকল্পটা হাতে নিতাম। এজন্য আমরা ইনহাউজ স্ট্যাডি (অভ্যন্তরীণ পর্যালোচনা) করেছি।’
এ প্রসঙ্গে অর্থনীতিবিদ ও উন্নয়নকর্মী বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ‘যে যত যাই বলুক না কেন, বিধান মেনে প্রকল্প গ্রহণের আগে এর সম্ভাব্যতা যাচাই করা জরুরি। না হলে এটা অপরিকল্পিতভাবে এগোবে।’
৭৪ কোটি ৯০ লাখ টাকা ব্যয়ে প্রকল্পটি চলতি বছরের সেপ্টেম্বর থেকে ২০২৩ সালের জুলাইয়ে বাস্তবায়নের প্রস্তাব করা হয়েছে। প্রকল্পের নির্ধারিত ব্যয় বেশি টাকা নয় বলেও মনে করছেন বিআইডব্লিউটিএ-এর চেয়ারম্যান। মাহবুব-উল ইসলাম বলেন, ‘আমি ছিলাম মিটিংয়ে। এ প্রকল্প টাকার অঙ্কে খুব একটা বেশি নয়। এটা খুব একটা বড় প্রকল্পও নয়। ভুল না বলে থাকলে ১০ কিলোমিটার এটার ড্রেজিং হবে।’
বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ‘৭৪ কোটি কম টাকা নয়। সাম্প্রতিক সময়ে যেসব তথ্য বেরোচ্ছে, তাতে দেখা যাচ্ছে অনেক অপচয় হচ্ছে, দুর্নীতি হচ্ছে। আমি আশা করব, পরিকল্পনা কমিশন যে বিষয়গুলো তুলে ধরেছে, সেই তথ্যগুলো সুরাহা হওয়ার আগে প্রকল্প বাস্তবায়নের দিকে অগ্রসর না হওয়াই যৌক্তিক।’
প্রকল্পটি কীভাবে পরিকল্পনা কমিশন পর্যন্ত যেতে পারল, এটাও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের খতিয়ে দেখা দরকার বলে মনে করেন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান।
‘ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ল্যাবরেটরি মেডিসিন অ্যান্ড রেফারেল সেন্টার স্থাপন (দ্বিতীয় সংশোধন)’ প্রকল্পটিও সম্ভাব্যতা যাচাই ছিল না। প্রকল্পটির ছয়বার সময় বাড়ানোর আবেদন অনুমোদন দেয়া হয়েছে গত ২২ অক্টোবরের একনেক সভায়। অথচ ২০১০ সালে শুরু হওয়া এ প্রকল্পের বর্তমান আর্থিক অগ্রগতি মাত্র ৫২ দশমিক ৪৬ শতাংশ।
মূল প্রকল্পটি গ্রহণের আগে এর সম্ভাব্যতা যাচাই করা ছিল না বলে প্রকল্প-সংশ্লিষ্টরা জানান।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের এ প্রকল্পের ষষ্ঠবার বেঁধে দেয়া সময়ের মধ্যে পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন নিয়েও রয়ে গেছে সংশয়। বারবার সময় বাড়ানোর বিষয়টি ভালোভাবে দেখছেন না পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নানও। ২০১০ সালের জুলাই থেকে ২০১৩ সালের জুনের মধ্যে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করার কথা ছিল। কিন্তু তা হয়নি। ষষ্ঠবার মেয়াদ বাড়িয়ে প্রকল্পের সময় ধরা হয়েছে ২০২০ সালের জুন পর্যন্ত।
প্রকল্পটি প্রসঙ্গে পরিকল্পনামন্ত্রী বলেন, ‘অপচয় দুর্নীতির চেয়ে বড় অপরাধ। দুর্নীতি টাকার পরিমাণে ধরা যায়। কিন্তু অপচয়ের ফলে ক্ষতি কতটুকু হতে পারে, তা নির্ধারণ করা যায় না। সবচেয়ে বড় অপচয় হলো সময় অপচয়। সময়ের অপচয় আমাদের সবচেয়ে বড় ব্যয়। এটা যদি কেউ গাফিলতি করে নিজের ইচ্ছায় করে থাকেন, সেটা দুর্নীতির চেয়ে ভয়ঙ্কর।’
- আরও পড়ুন>> আলোচনা ফলপ্রসূ, মাঠে ফিরছেন ক্রিকেটাররা
শুরুতে প্রকল্পটির ব্যয় ছিল ১৩৮ কোটি ১৩ লাখ ৬০ হাজার টাকা। বর্তমানে প্রকল্পটির ব্যয় ১৯৪ কোটি ৩২ লাখ ২৪ হাজার টাকা।
উন্নয়ন প্রকল্পে এমন অনিয়ম কেন বারবার ঘটছে- এমন প্রশ্নের জবাবে ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘এটা এখন সংস্কৃতি হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ, যারা এ প্রকল্পের সঙ্গে জড়িত, যাতের হাতে দেশের উন্নয়ন প্রকল্প প্রণীত ও বাস্তবায়িত হয়, সংশ্লিষ্টদের একটা শ্রেণি এটাকে নিজেদের অর্থ-সম্পত্তি বিকাশের সুযোগ হিসেবে দেখছেন। যে কারণে এটা জবাবদিহিহীনতা কিংবা যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ না করে, জনস্বার্থ বিবেচনায় না এনে প্রকল্পগুলো প্রণীত হচ্ছে। এবং সেটা অনেক ক্ষেত্রে প্রশ্নের মুখে না এনে অনুমোদিত এবং বাস্তবায়িতও হচ্ছে। যে কারণে প্রকল্পের নামে প্রকল্প হচ্ছে, কিন্তু অংশগ্রহণমূলক উন্নয়ন থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন জনগণ এবং বোঝাটাও তাদের ওপর পড়ছে।’