একটি দৈনিকের একই দিনের কয়েকটি খবরের বৈপরীত্য দেখে অনেকেই বিস্মিত হতে পারেন। একটি খবর বলছে, বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি হবে ৭.৮ শতাংশ। এটি একটি সুখবর, দেশের যেকোনো নাগরিক এতে আশান্বিত হতে পারে যে আমাদের সমৃদ্ধি উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাবে। উন্নয়নশীল দেশের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আমরা এগিয়ে যাব। এভাবে এগোতে থাকলে কয়েক বছর পর আমরা নিম্নমধ্যম আয়ের দেশ থেকে মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হব। একই দৈনিকে রয়েছে চট্টগ্রামে মেট্রো রেলের সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের কথা। বড় রকমের আশার বাণী সন্দেহ নেই।
এরই পাশে রয়েছে মন খারাপ করার মতো খবরগুলো। যেমন—‘টঙ্গীতে বাস থেকে ফেলে কলেজছাত্রকে হত্যা।’ ‘খাদ্য পরিদর্শক খোরশেদ যুবলীগের সহসভাপতি।’ তিনি সগর্বে উচ্চারণ করেছেন যে সম্রাট তাঁকে যুবলীগের কমিটিতে বসিয়েছেন। এতে যদি তাঁর চাকরি চলে যায় তবে যাবে, তাতে তাঁর কিছু আসে-যায় না। পরের খবরটি আরো মারাত্মক, ভয়ংকর। এটি হচ্ছে, ‘সুনামগঞ্জে বীভৎস কায়দায় শিশুহত্যা। বাবার কোলে তুহিনের গলা কাটে চাচা।’ এই বীভৎস ঘটনার বর্ণনা অনেক পাঠকই সহ্য করতে পারবেন না। তাই এর বিস্তারিত বর্ণনা প্রদান থেকে বিরত থাকছি। তবে এ ঘটনার ভয়াবহতা আজীবন আমাদের তাড়া করে বেড়াবে। আমরা মনস্তাত্ত্বিক চাপের মধ্যে থাকব। এ খবর যখন পড়েছি, তখন মনে হয়েছে বেঁচে থাকা বুঝি বা অপ্রাসঙ্গিক, প্রবৃদ্ধির হার নিতান্তই অর্থহীন।
এখন দেশে শুদ্ধি অভিযান চলছে। প্রভাবশালী দুর্নীতিবাজদের আইনের আওতায় আনা হচ্ছে। এ অভিযানে এখনো পর্যন্ত যাঁদের আটক করা হয়েছে বা যাঁদের চলাফেরা ও লেনদেনের ওপর বিধি-নিষেধ আরোপ করা হয়েছে, তাঁরা শাসকদলীয় ঘারানার লোক। কয়েকজন তো শাসকদলের অঙ্গসংগঠনের শীর্ষ স্তরের নেতা। তাঁদের বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত মূল অভিযোগ আর্থিক দুর্নীতি। বলা হচ্ছে, দুর্নীতির মাধ্যমে তাঁরা অর্থ-সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলেছেন। স্বচ্ছ আয়ের শত গুণ, হাজার গুণ সম্পদ তাঁদের মালিকানায় রয়েছে। জমাকৃত সম্পদের একাংশ তাঁরা বিদেশে পাচার করেছেন। সন্ত্রাস, দখলবাজি, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, নিয়োগ বাণিজ্য, ঘুষ লেনদেন, মাদক ব্যবসা, চোরাকারবার, অস্ত্র চালান, জালিয়াতি, জোচ্চুরির মাধ্যমে তাঁরা বিশাল সম্পদের মালিক হয়ে যাবতীয় অন্যায়, অনাচার, সাধারণ নাগরিকের সম্পদ হরণ, সন্ত্রাস, এমনকি প্রাণহানি করে সমাজের শান্তি-শৃঙ্খলা, স্থিতিশীলতা বিনষ্ট করেছেন। তাঁদের কর্মকাণ্ডে সমাজে নৈরাজ্য, অনিশ্চয়তা ও ভয়ভীতি সৃষ্টি হয়েছে। দেশের প্রশাসনব্যবস্থা বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। সরকারের আইন-কানুন, বিধি-বিধান, এমনকি সামগ্রিক প্রশাসনব্যবস্থা হুমকির মুখে পড়েছে।
আপামর জনগণ দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে পরিচালিত অভিযানকে সমর্থন করেছে। তারা চায় দুর্নীতিবাজরা ধরা পড়ুক, তাঁদের স্বরূপ উদ্ঘাটিত হোক। তাঁদের শাস্তি দেওয়া হোক। দুর্নীতিবাজরা ধরা পড়ার পর যেসব তথ্য পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হচ্ছে তাতে বিবেকবুদ্ধিসম্পন্ন চিন্তাশীল জনগণ আঁতকে উঠছে। অনিয়ম-আনাচার এবং লুটপাট যে এত বিস্তৃত হয়েছে, এত গভীরে গিয়েছে, তা তারা এর আগে আন্দাজ করতে পারেনি। এর মাধ্যমে দেশের রাজনীতি এবং রাজনীতিবিদদের চরিত্র উন্মোচিত হয়েছে। অর্থের লোভে তাঁরা যে এত নিচে নামতে পারেন তা জেনে তাঁরা দেশের স্বার্থ, জাতীয় পর্যায়ের নেতানেত্রীদের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন। ফ্রিডম পার্টির সন্ত্রাসী সদস্য, যাঁদের বিরুদ্ধে পত্রপত্রিকার প্রতিবেদন মতে মারাত্মক অভিযোগ রয়েছে, তাঁরা কিভাবে শাসকদলের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গসংগঠনের উচ্চ পদে (office bearer) অধিষ্ঠিত হতে পারেন, তার গ্রহণযোগ্য উত্তর দায়িত্ববান নেতারা দিতে পারবেন বলে মনে হয় না। অনেকেই একে শুধু সতর্কতার অভাব কিংবা সাংগঠনিক ব্যর্থতা হিসেবে উড়িয়ে দিতে নারাজ। তাঁরা এর মধ্যে অনৈতিক লেনদেনের অশনিসংকেত দেখতে পান। নানারূপ সম্ভাব্য অপকর্মের উৎকট দুর্গন্ধ তাঁদের নাকে এসে লাগে।
দুর্নীতিবাজ ব্যক্তি সব সময় নিরাপত্তার হুমকি। নেতানেত্রীর যত কাছে তাঁদের অবস্থান হবে, হুমকির আশঙ্কা তত বাড়বে। অনৈতিক আয়, অনুপার্জিত অর্থের লোভ যার চরিত্রে একবার ঢুকে যায়, তার কাছে দেশের স্বার্থ, নেতানেত্রীর মানসম্মান, জীবন—কোনোটি ফাও অর্থের চেয়ে বড় বিবেচিত হয় না। অপরাধের প্রকৃতি এবং পরিমাণ অর্থনির্ভর হয়ে পড়ে। অর্থাৎ প্রদেয় অর্থের পরিমাণ বাড়িয়ে লোভী দুর্নীতিবাজকে যেকোনো জঘন্য অপরাধে প্রবৃত্ত করা যায়। দুর্নীতিবাজরা রাজনৈতিক সংগঠনের জন্য দূর-নিয়ন্ত্রিত বিস্ফোরক। সংগঠনের কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ পদে তাঁদের অধিষ্ঠান সংগঠনের জন্য মহাবিপর্যয় ডেকে আনতে পারে। একইভাবে শীর্ষ পর্যায়ের নেতানেত্রীদের আশপাশে তাঁদের অবস্থান নেতানেত্রীর জীবনকে ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলতে পারে। এককথায় তাঁদের থেকে সাবধান হতে হবে। দুর্নীতিবাজরা সর্বোতভাবে পরিত্যাজ্য।
এ প্রসঙ্গে রাজনৈতিক দলে ব্যবস্থাপনার গুরুত্বের বিষয়টি এসে পড়ে। অনেকের ধারণা, ব্যবস্থাপনার বিষয়টি শুধু সরকারি প্রশাসন এবং করপোরেটজগতের জন্য প্রযোজ্য। রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, ধর্মীয় কিংবা ক্রীড়াঙ্গনে ব্যবস্থাপনার প্রাসঙ্গিকতা নেই। তাঁরা মনে করেন, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বরা থাকেন সুকুমার বৃত্তিতে, খেলোয়াড় ও ক্রীড়াবিদরা থাকেন মাঠে-ময়দানে, রাজনীতিবিদরা পরিবৃত্ত থাকেন তাঁদের কর্মী-সমর্থক এবং সাধারণ মানুষ দ্বারা। তাঁরা কেন ব্যবস্থাপনার ফাঁদে পড়বেন। ব্যবস্থাপনা হচ্ছে জটিল এবং নিরস বিষয়। উপরোক্ত তিন অঙ্গনের লোকদের আবেদন আসে আবেগ থেকে, উৎসাহ থেকে, নৈপুণ্য বা পারফরম্যান্স থেকে, সর্বোপরি মানবিক সম্পর্কের বেহিসাবি টান থেকে। ব্যবস্থাপনার হিসাব-নিকাশ, জটিল মারপ্যাঁচ, সাবধানতা, সন্দেহ প্রবণতা উপরোক্ত সেক্টরের আর্কষণ-আবেদনকে বিনষ্ট করবে। তাই সুকুমারবৃত্তির লোক, মাঠে-ময়দানের লোককে এসবের মধ্যে টানা ঠিক হবে না। তাঁদের চিন্তামুক্ত, বাধাবন্ধনহীন জীবন যাপন করতে দেওয়া সমীচীন হবে।
ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে এমন ধারণা সঠিক নয়। সুব্যবস্থাপনা ব্যক্তিজীবনকে সুন্দর করে, সুখময় করে। সংগঠনকে সুঠাম করে, কার্যকর, আনন্দময় এবং নিরাপদ করে। সুব্যবস্থাপনা পারিবারিক পরিবেশকে মসৃণ, মধুর এবং উন্নয়নবান্ধব করে। রাষ্ট্রীয় এবং সামাজিক জীবনের এমন কোনো ইউনিট নেই, যার উন্নয়ন এবং কার্যকর ভূমিকা নিশ্চিতকরণে ব্যবস্থাপনার অবদান নেই। সাম্প্রতিক সময়ের দুর্নীতিবিরোধী অভিযানে এ বিষয়টি পরিষ্কার হয়েছে যে আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর ব্যবস্থাপনা কাঠামো, এর পদ্ধতি-প্রক্রিয়া বিজ্ঞানভিত্তিক, বিশ্লেষণধর্মী এবং সুবিন্যস্ত নয়। আমাদের রাজনৈতিক নেতাদের কর্মপরিবেশ খুব কাছ থেকে দেখেছি। তাঁদের নেতৃত্বে বিভিন্ন কমিশন, কমিটিতে কাজ করেছি। তাঁরা বুদ্ধিমান এবং অভিজ্ঞতাসম্পন্ন। কিন্তু নগণ্যসংখ্যক ব্যতিক্রম ছাড়া তাঁদের সবার মধ্যে সতর্কতা অবলম্বন করে, হিসাব-নিকাশ করে, সময় দিয়ে কাজ করার প্রতি অনীহা দেখেছি। তাঁরা একটি বিশেষ ভাবনা (Idea) বা প্রস্তাবের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়েন এবং এ প্রস্তাবকে টেনে নিতে সচেষ্ট থাকেন। প্রস্তাবের পক্ষে-বিপক্ষে যেসব বক্তব্য আসে বা আসতে পারে, তা ধৈর্যসহকারে শুনে সিদ্ধান্ত প্রণয়ন করতে চান না। সবচেয়ে বড় কথা, প্রস্তাবের ওপর সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য যেসব প্রয়োজনীয় তথ্য-উপাত্ত যাচাই-বাছাই করা অত্যাবশ্যক, তা-ও তাঁরা সংগ্রহ, সংকলন বা বিশ্লেষণ করতে বিরক্ত বোধ করেন। মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণের পরিভাষায় বলা যায় তাঁদের মধ্যে এক ধরনের ADD (Attention Deficit Disorder) কাজ করে।
এই মানসিকতা সবচেয়ে বেশি লক্ষ করা যায় কর্মী ব্যবস্থাপনা (Personnel Management) এবং সংগ্রহ তথা কেনাকাটা ব্যবস্থাপনার (Procurement Management) ক্ষেত্রে। দুর্নীতির অংশ বাদ দিয়ে বলা যায় যে এ দুই ক্ষেত্রে ভাবাবেগ এবং অযৌক্তিক (ওত্ত্ধঃরড়হধষ) ব্যক্তিক পছন্দ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপধায়ক হিসেবে দেখা দেয়। রাজনৈতিক দল, বিশেষ করে শাসকদলে নতুন সদস্য অন্তর্ভুক্তিতে, কার্যকরী পরিষদে মনোনয়নকালে, সরকারি-বেসরকারি সংস্থায় নিয়োগ ও পদোন্নতির বেলায় এবং গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগের জন্য লোক বাছাইয়ের ক্ষেত্রে ব্যক্তির জীবনবৃত্তান্ত, কর্মকালীন সময়ের রেকর্ড, তাঁর সম্পর্কে সাধারণ মানুষের ধারণা (perception) এমনকি তাঁর পরিবার সম্পর্কে অতি প্রয়োজনীয় তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করার আবশ্যকতা রয়েছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে এটি সময় সাপেক্ষ হতে পারে। কিন্তু ঝুঁকি এড়ানোর জন্য, পরবর্তী সময়ে বিব্রতকর পরিস্থিতি এড়ানোর জন্য কিছু সময় নিয়ে হলেও এই তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে তার আলোকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। দেখা যায় তালাফি-তদবিরের চাপে সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন ব্যক্তিরা এ সময় নিতে চান না, তাঁরা অসম্পূর্ণ তথ্যের ভিত্তিতে তাড়াহুড়া করে সিদ্ধান্ত নিয়ে পছন্দের ব্যক্তি বা গোষ্ঠীকে সন্তুষ্ট করতে চান। এরূপ তাড়াহুড়া এবং তথ্যের অসম্পূর্ণতা পরবর্তী সময়ে কাল হয়ে দাঁড়াতে পারে। যে ধরনের সংগঠনই হোক না কেন, ব্যক্তি ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে ধৈর্য এবং সতর্কতার ব্যাপারে নমনীয় তথা গাছাড়া ভাব দেখালে চলবে না।
কর্মী ব্যবস্থাপনার একটি প্রায়োগিক সূত্র হলো যে দুর্নীতি করে, অপরাধ করে, অনাচার বা অসদাচরণ করে, তাকে প্রথম সুযোগে জবাবদিহির আওতায় আনা। যদি জবাব সন্তোষজনক না হয়, তবে অপরাধের প্রকৃতি ও মাত্রা অনুযায়ী তার বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া। এটি তার নিজের জন্য এবং অন্যদের জন্য কার্যকর সংকেত (ংরমহধষ) হিসেবে কাজ করবে। আমাদের পদস্থ ব্যক্তিরা এবং নেতানেত্রীরা এ জায়গায় একটু আড়ষ্ট থাকেন। নানারূপ ব্যক্তিক, সামাজিক, সাংগঠনিক এবং রাজনৈতিক বিবেচনায় তাঁরা এরূপ অপরাধ, অনাচার, অসদাচরণ, দুর্নীতি দেখেও দেখেন না। শাস্তি প্রদান তো দূরের কথা, জবাবদিহির আওতায় এদের আনেন না। অপরাধীরা পার পেয়ে যায়, অন্যরা উৎসাহিত হয়। এবার যাদের আইনের আওতায় আনা হচ্ছে, ব্যক্তি, গোষ্ঠী বা সংস্থার দুর্নীতি অথবা ব্যর্থতার কারণে যদি তারা হাসতে হাসতে বেরিয়ে আসে, তবে মন্দ কাজের দুর্গন্ধ সারা সমাজে ছড়িয়ে পড়বে। সেই উৎকট দুর্গন্ধের প্রাবল্যে ভালো কাজের প্রভাব চাপা পড়ে যাবে।
উচ্চ মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত কতিপয় ব্যক্তিকে আমরা ন্যক্কারজনক অপরাধে জড়িত হতে দেখছি। সে অপরাধ খুন-গুমের নয়। কিন্তু তার সুদূরপ্রসারী সংশ্লেষ রয়েছে। যেমন—কেউ যদি উচ্চতর পর্যায়ের পাবলিক পরীক্ষায় জোচ্চুরি-জালিয়াতির আশ্রয় নেন, তবে সাংগঠনিকভাবে তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। তাঁকে হয়তো রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক কারণে ফৌজদারি আইনের আওতায় দীর্ঘমেয়াদি শাস্তি দেওয়া যাবে না। কিন্তু তাঁর বিরুদ্ধে এমন ব্যবস্থা নেওয়া যায়, যাতে তিনি দৃশ্যমানভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হন, তাঁর সম্মানহানি ঘটে। কেউ হয়তো একে ছোট অপরাধ বলে উড়িয়ে দিতে চাইবে; কিন্তু ছোট অপরাধ হলেও এর বড় প্রভাব রয়েছে। অপরাধ করা সম্মানীয় ব্যক্তিকে জবাবদিহির আওতায় এনে সমাজকে দুর্নীতি-অনাচার মুক্ত করতে হবে। সরকারের গৃহীত বড় পদক্ষেপের সঙ্গে এ ব্যাপারে গৃহীত পদক্ষেপ যেন সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়, নীতিনির্ধারকদের সেদিকে বিশেষ লক্ষ রাখতে হবে।
আমরা উন্নয়নের এমন এক পর্যায়ে আছি, যেখানে ভালো-খারাপ দুই ধরনের ব্যাপার একসঙ্গে মিশে থাকবে অথবা পাশাপাশি অবস্থান করবে। আমাদের চেষ্টা থাকবে যাতে ভালোর মাত্রা বেশি থাকে, খারাপের তীব্রতা দুর্গন্ধ না ছড়ায়। এর জন্য প্রয়োজন নিরন্তর সতর্ক দৃষ্টি এবং বিকৃতি, বিচ্যুতি দৃষ্ট হলে দ্রুত প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ। মূল দল এবং অঙ্গসংগঠনের সদস্যদের কার্যকলাপ এবং আয়-সম্পদের ওপর কঠোর নজরদারি রাখতে হবে। আয়-সম্পদ যাঁদের মাত্রাতিরিক্তি বেড়ে যাচ্ছে তাঁদের অবিলম্বে জবাবদিহির আওতায় এনে বুঝিয়ে দিতে হবে যে তাঁরা দলের জন্য দায় হয়ে পড়েছেন। অতএব তাঁদের চালচলন, অপকর্ম শোধরাতে হবে; অন্যথায় তাঁদের বিরুদ্ধে শাস্তির ব্যবস্থা করা হবে। দুর্নীতি, অনাচার, অপুষ্টির
(Malnutrition) মতো। এর প্রভাব একদিনে অনুভব করা যায় না। প্রথম দিকে মনে হয় না বড় কোনো সংকট এগিয়ে আসছে। অপুষ্টি ধীরে ধীরে মানুষের দেহকে কুরে কুরে খায়। অবেশেষে এমন পর্যায়ে নিয়ে যায় যখন কোনো ওষুধ আর কাজ করে না। অনেক সাধ্য সাধনার পরও চরমতম অপুষ্টি থেকে স্বাস্থ্যে ফিরে আসতে দীর্ঘ সময় লেগে যায়। দুর্নীতি ও সমাজ, রাষ্ট্রকে কুরে কুরে খায়। প্রথম দিকে এর কুফল টের পাওয়া যায় না। কিন্তু ধীরে ধীরে সমাজ ও রাষ্ট্র খাদের কিনারে এসে পড়ে। তখন বহু সাধ্য সাধনা করেও বিপর্যয় থেকে সহজে রক্ষা পাওয়া যায় না। প্রথম থেকে সতর্ক দৃষ্টি রেখে দ্রুত প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা নিলে এই দুর্যোগ থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যেতে পারে। কষ্টবহুল হলেও সেটি যথার্থ পদক্ষেপ। সাবধানের মার নেই।
লেখক : সাবেক মন্ত্রিপরিষদসচিব ও পিএসসির সাবেক চেয়ারম্যান