দীর্ঘসময় ধরে অস্থিতিশীল হয়ে রয়েছে দেশের কয়েকটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়। নানা ইস্যুতে এগুলোয় শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মধ্যে অসন্তোষ রয়েছে। কোনো কোনোটিতে টানা আন্দোলন চলছে। উন্নয়ন প্রকল্পের টাকায় ছাত্রনেতাদের ভাগ দেওয়া, অনিয়ম, দুর্নীতি, স্বেচ্ছাচারিতার অভিযোগ উঠেছে এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের বিরুদ্ধে। আন্দোলনের মুখে একজন উপাচার্যকে পদত্যাগ করতে হয়েছে। আরেকজনকে পদত্যাগে আলটিমেটাম দিয়েছেন শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা।
স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার ঘাটতির কারণে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় এমন পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে বলে মনে করেন শিক্ষাসংশ্লিষ্টরা। টানা কয়েকদিনের আন্দোলনের মুখে পদত্যাগে বাধ্য হন গোপালগঞ্জের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য খোন্দকার নাসিরউদ্দিন। কথায় কথায় শিক্ষার্থীদের শোকজ ও বহিষ্কার করে দেশজুড়ে তীব্র সমালোচনার মুখে পড়েন নাসিরউদ্দিন। তার বিরুদ্ধে নারী কেলেঙ্কারি, অনিয়ম, দুর্নীতি, অদক্ষতারও অভিযোগ ছিল। শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মধ্যেই তার বিষয়ে তদন্ত কমিটি করে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)। বিভিন্ন অভিযোগের সত্যতা মেলায় তাকে অপসারণের সুপারিশ করে কমিটি। এর পর তিনি পদত্যাগ করেন।
এখনো আন্দোলন চলছে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে। উপাচার্যকে পদত্যাগের আলটিমেটাম দিয়েছেন শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা ছাড়াই একটি সান্ধ্যকোর্সে ছাত্রলীগ নেতাদের ভর্তি করা নিয়ে অসন্তোষ রয়েছে। এরই মধ্যে আবাসন সংকট নিরসনে উপাচার্যকে সময় বেঁধে দিয়েছেন শিক্ষার্থীরা। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘জয় হিন্দ’ সমালোচনার পর এবার নিয়োগ নিয়ে উপ-উপাচার্যের ফোনালাপ ফাঁস। শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে পদত্যাগ করতে হয়েছে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক ড. মাহবুবর রহমানকে। আমরা মনে করি- বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এ অবস্থায় চলতে পারে না। বিশ্ববিদ্যালয়ে নানামুখি গ্রুপ, ব্যক্তিগত লাভালাভ, ক্ষমতা আর স্বার্থের দ্বন্দ্বে শিক্ষার পরিবেশ সম্পূর্ণরূপে বিনষ্ট হচ্ছে।
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর আন্দোলনের গতি প্রকৃতি লক্ষ্য করলে দেখা যায়- প্রায় প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়েই উন্নয়ন প্রকল্পের টাকা ভাগ-বাটোয়ারা, নিয়োগ বাণিজ্য, উপাচার্যদের স্বৈরাচারী মনোভাব কিংবা শিক্ষকদের পছন্দ অপছন্দের অপরাজনীতি। এসবের ফলে আন্দালনের সময় এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হচ্ছে যা বিব্রতকর। কিন্তু কেন এমন হচ্ছে? আমরা মনে করি- এ প্রশ্নের উত্তর খোঁজার মধ্য দিয়েই সমাধানের পথ বের হয়ে আসবে। সবকিছুকে রাজনীতির চোখে দেখলে চলবে না। রাজনীতি ছিল, থাকবে। এসবের ভেতর দিয়েই আমাদের শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। তবে বাস্তবতা এমন পর্যায়ে দাঁড়িয়েছে যে-পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা এখন সময়ের দাবি।
বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, শিক্ষক এবং ছাত্র-শিক্ষকদের উচিত- প্রতিষ্ঠানসমূহে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা এবং বিদ্যমান পরিস্থিতির পরিবর্তনে মনোযোগী হওয়া। অন্যদিকে উপাচার্যদের মনে রাখতে হবে- স্বৈরাচারী কায়দায় প্রশাসনযন্ত্র চালানো এবং ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য এমন কাজ করা ঠিক না যা শুধু শিক্ষক সমাজকে বিব্রত করে না, বরং পুরো দেশবাসীও বিব্রত হয়। সম্প্রতি কয়েকটি বিশ্ববিদ্যলয়ে এমন কর্মকাণ্ড পুরো দেশবাসীকে বিব্রত করেছে। আমরা আশা করব- নীতি, আদর্শ বা আত্মসম্মানবোধের সঙ্গে উপাচার্য এবং ছাত্র-শিক্ষকগণ কাজ করবেন।
একই সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে বলব- বিশ্ববিদ্যালয়ের অস্থিরতা দূরীকরণে স্থায়ী সমাধানের পথ বের করতে হবে। দেশের সমস্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রমকে নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণে রাখা জরুরি। যার বিরোদ্ধে যখনই কোন অভিযোগ উঠে তা যত ছোটই হোক না গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নিয়ে তদন্ত করুন। অভিযোগ প্রমাণিত হলে ব্যবস্থা নিন এবং একই সঙ্গে মিথ্যা অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে প্রতিষ্ঠান কিংবা ব্যক্তি ক্ষতিগ্রস্ত হলে অভিযোগকারীর বিরোদ্ধেও ব্যবস্থা নিন। তবে মনে রাখতে হবে- এ প্রক্রিয়াটি যেন স্বচ্ছতার সঙ্গে হয়। আমরা আশা করি দ্রুত পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অস্থিরতা কেটে শিক্ষার পরিবেশ ফিরবে।