সড়কযাত্রা কি এবার নিরাপদ হবে

আহমদ রফিক

আহমদ রফিক
আহমদ রফিক। ফাইল ছবি

বিজয়ের মাস ডিসেম্বর। শুরুতেই একটি খবর সবগুলো দৈনিকে গুরুত্বের সঙ্গে প্রকাশিত—‘দুই চালক ও সহকারীর যাবজ্জীবন কারাদণ্ড’/‘জাবালে নূরের দুই বাসের রেষারেষিতেই দুর্ঘটনা’। আসলে এটা দুর্ঘটনা নয়, বেপরোয়াবাজির পরিণামে হত্যাকাণ্ড। পূর্বোক্ত প্রতিবেদনের ভাষ্য : ‘রাজধানীর শহীদ রমিজউদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের দুই শিক্ষার্থীকে বাস চাপা দিয়ে হত্যা ও কয়েকজনকে আহত করার দায়ে জাবালে নূর পরিবহনের দুই বাসের চালক ও এক হেলপারকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে।’

এতে নিহত দুই শিক্ষার্থী দিয়া-রাজীবের পরিবার আপাতদৃষ্টিতে হয়তো সন্তোষ প্রকাশ করবে যথাক্রমে মেয়ে ও ছেলে হারানোর যন্ত্রণা বুকে চেপে; কিন্তু নিরাপদ সড়ক কতটা অর্জিত হবে বাস-মালিকরা ঘটনার পর ঘটনায় ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে গেলে? রাজীবের মায়ের আকাঙ্ক্ষা হয়তো অপূর্ণ থেকে যাবে। তিনি বলেছেন, ‘আর কোনো মায়ের সন্তানকে যেন এভাবে রাস্তায় মরতে না হয়। বাস চালক ইচ্ছা করে আমার ছেলেকে মেরেছে।’

হত্যাকাণ্ড বেপরোয়া চালনা, রেষারেষি করে চালনার অন্যায়ের কারণে। আমরা জানি না আইনে একে ‘ইচ্ছাকৃত হত্যাকাণ্ড’ বলে মেনে নেওয়া হবে কি না এবং সে হিসেবে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। তবে আগেকার তুলনায় এবার দৃষ্টান্তমূলক সন্দেহ নেই, তবু সবাইকে তা হয়তো সন্তুষ্ট করতে পারেনি। তাই একটি দৈনিকের পাতায় একজনের প্রতিক্রিয়ার খবরের শিরোনাম : ‘দৃষ্টান্ত হলো/গোড়ায় যাওয়া হলো না’।

‘গোড়ায় যাওয়া’ বলতে বাস মালিক ও অসাধু কর্মকর্তাদের কথা বলা হয়েছে। বাস মালিকদের চালক নিয়োগ পদ্ধতি নিয়ে এর আগে অনেক সমালোচনা হয়েছে, তাদের দায়িত্বহীনতায় যুক্ত এন্তার অর্থপ্রাপ্তির বিষয় নিয়ে কম লেখালেখি হয়নি। ফিটনেস প্রশ্নে অযোগ্য যানবাহন রাজপথে চালনাসহ মালিকদের একাধিক অসাধু আচরণেই যে নিরাপদ সড়ক অর্জিত হচ্ছে না, এ কথা বহুজন কথিত এবং এ বিষয় নিয়ে ভিন্নমত প্রকাশের সুযোগ নেই।

দুই.

পরিবহন খাতের নৈরাজ্য, সড়কজুড়ে যানবাহন চালনায় অসুস্থ প্রতিযোগিতা (বিশেষ করে বাসের), বাস মালিকদের যানবাহন পরিচালনার বিধি-বিধান, নিয়ম-কানুনের তোয়াক্কা না করে অনিয়মের রাজ্য প্রতিষ্ঠা যেন এক নিয়মের রাজত্বে পরিণত হয়েছে। মালিক ও পরিবহন শ্রমিক মিলে এমনই এক শক্তিমান সিন্ডিকেট তৈরি করেছে যে এদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া এক অসম্ভব ঘটনা। কথাগুলো বলেছেন বুয়েটের এক অধ্যাপক।

দিয়া-রাজীবের শোকাবহ মৃত্যুর ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় শিক্ষার্থীরা প্রচণ্ড মনোবেদনা নিয়ে রাজপথে নেমে পড়েছিল নিরাপদ সড়কের দাবি নিয়ে। সেই সঙ্গে মালিক-চালকদের অন্যায় বা অপরাধের যথাযথ শাস্তির দাবিতে। তাদের সড়ক অবরোধে যাতায়াত ব্যবস্থায় অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়।

এ আন্দোলনের বিপক্ষে অযৌক্তিক নানা অভিযোগ তুলে তা দমন করা হয়, রাজপথ সাময়িক অবরোধমুক্ত করা হয়। তবে এ ঘটনা সারা দেশের চেতনা স্পর্শ করে, জনমানসের সমর্থন ও সহানুভূতি অর্জন করে। পাশাপাশি সরকারি আশ্বাসও উচ্চারিত হয় নিরাপদ সড়ক আইন ও ব্যবস্থা গ্রহণের পক্ষে।

এরই পরিণামে নিরাপদ সড়ক আইন তথা পরিবহন আইন পাস, যা নিয়ে প্রবল প্রতিবাদ এই কিছুদিন আগে মালিক-শ্রমিক পরিবহন খাতে, ধর্মঘট, যাতায়াতে অচলাবস্থা, এককথায় দেশ অচল। আবারও সরকারের নতি স্বীকার, আইন সংশোধনের আশ্বাসের মাধ্যমে অচলাবস্থার নিরসন ইত্যাদি ঘটনা আমাদের চোখের সামনেই ঘটে গেল।

এতে মানুষ ক্ষুব্ধ, শিক্ষিত শ্রেণি থেকে রাজনীতিমনস্ক মানুষ মাত্রেই ওই ঘটনায় নানাভাবে তাদের অসন্তোষ প্রকাশ করেছে। এখনো করছেন দৈনিকের কলাম লেখকরা, পরিবহন খাতের বিশেষজ্ঞ-বিশ্লেষকরা। গত ৩০ নভেম্বর একটি দৈনিকে প্রকাশিত কলাম-নিবন্ধের গুরুত্বপূর্ণ শিরোনাম এ উপলক্ষে : ‘পরিবহন শ্রমিকদের শক্তির উৎস কী?’

শ্রমিক শক্তি ন্যায্য শ্রমিক স্বার্থের পাশাপাশি জনস্বার্থমূলক হলে কারো আপত্তির কারণ ছিল না, সমালোচনাও প্রয়োজন ছিল না। ওই নিবন্ধকার দীর্ঘ পর্যালোচনার একপর্যায়ে লিখেছেন : ‘পরিবহন শ্রমিকদের কিছুতেই আইন মানতে বাধ্য করা যাচ্ছে না। দেশে একটি বৈধ, স্থিতিশীল ও শক্তিশালী সরকার থাকা সত্ত্বেও দেশের রাস্তাঘাট অবৈধ ও বেপরোয়া ড্রাইভারদের অভয়ারণ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে।’

তিন.

কিন্তু এ সত্যটিই শেষ কথা বা সব কথা নয়। পরিবহন শ্রমিকদের নেপথ্য নায়ক কারা, সে বিষয়টিই তো সমস্যার প্রধান কারণ এবং প্রধান আলোচ্য। এ ক্ষেত্রে যেমন রয়েছে এর আগে আলোচিত বাস মালিকদের বেশুমার অর্থনৈতিক লোভ-লালসা, তেমনি শ্রমিক রাজনীতির জাদুকাঠি হাতে থাকা শক্তিমান ব্যক্তিবর্গ, যাদের স্বার্থও এই সমগ্র কর্মকাণ্ডের পেছনে কম দায়িত্বভোগী নয়।

অবশ্য শেষোক্ত দিকটি নিয়ে কিছু মন্তব্য করেছেন লেখক এই বলে যে ‘আবার বিভিন্ন সময়ের সরকারে পরিবহন (খাতের) শ্রমিক নেতাদের মধ্য থেকে যাঁদের মন্ত্রী, এমপি বানানো হয়, তাঁরাও সরকারে থেকে কলকাঠি নেড়ে পরিবহন শ্রমিকদের পায়া ভারী করে দেন। সময়ে সময়ে তাঁদের ভূমিকাও…ইত্যাদি অনৈতিক অবৈধ কর্মকাণ্ডবিষয়ক কথকতা। উল্লিখিত হয়েছে, সড়কে ‘বাঁশকল ফেলে শ্রমিকদের চাঁদাবাজি’র কথাও।

পরিবহন খাতের গোটা ঘটনার অন্তর্নিহিত রাজনৈতিক সমস্যার দিকটি দীর্ঘ এ আলোচনায় অপেক্ষাকৃত কম গুরুত্ব পেয়েছে, বিশেষ করে সরকার পক্ষে দুর্বলতার দিকটি। অন্যদিকে নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের অন্যতম নেতা, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ইলিয়াস কাঞ্চন পরিবহন সেক্টরের একটি চক্রের চক্রান্তের ও বাধার কথা বলেও পূর্বোক্ত গোড়ার গলদ সম্পর্কে কথা বলেছেন।

যেমন তাঁর প্রশ্ন শ্রমিকদের উদ্দেশে : ‘যারা পরিবহন শ্রমিকদের ব্যবহার করে ফায়দা লুটছে, কোটি কোটি টাকা চাঁদা আদায় করছে, তারা শ্রমিকদের কল্যাণে কতটা ব্যয় করে? আপনাদের সুরক্ষার জন্য মালিক কি কোনো টাকা ব্যয় করেন? আপনাদের দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য কি কোনো ইনস্টিটিউশন গড়েছেন? বিষয়গুলো একবার ভেবে দেখবেন?’ ইত্যাদি।

এ কথাগুলো যুক্তিহীন নয়। ট্রেড ইউনিয়নের সর্বোচ্চ নেতা অধিকাংশ ক্ষেত্রে তাঁদের লুম্পেন চরিত্র নিয়ে মালিক-স্বার্থের সঙ্গে যোগসাজশের মাধ্যমে যে অঢেল বিত্ত-সম্পদের অধিকারী, বোধগম্য কারণে সাধারণ শ্রমিক এ সম্পর্কে সচেতন নয়, তাদের অংশবিশেষ কিছু প্রাপ্তির বিনিময়ে ওই একই চরিত্র অর্জন করেছে।

বাংলাদেশে শ্রমিক আন্দোলনের বড় অংশ দীর্ঘদিন থেকে সুবিধাবাদী আপসবাদী পথে চলতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে। ফলে দেশের শ্রমিক আন্দোলনের চরিত্র নষ্ট হচ্ছে, মূল লক্ষ্য অর্জন, বিশেষত শ্রেণিসংগ্রাম পিছু হটেছে নানা খাতে। পরিবহন খাতে এই দুর্বলতা সর্বাধিক দৃশ্যমান, তেমনি পোশাকশিল্প খাতে। বাংলাদেশে শ্রমিক আন্দোলনের এ দুর্ভাগ্যজনক দিকটি প্রকৃত শ্রমিক স্বার্থের রাজনীতির নিয়ন্ত্রণে নেই।

চার.

নিরাপদ সড়কের মৃত্যুহীন যাত্রার দীর্ঘকালীন দাবির প্রেক্ষাপটে যে আইন হয়েছে তার কার্যকর ক্ষমতা কতটা সার্থক প্রয়োগের পথ ধরতে পারবে সেটাই আমাদের জন্য বড় দুশ্চিন্তার বিষয়। তাই এক কথিত ‘দৃষ্টান্তমূলক রায়’ নিয়ে উল্লসিত হওয়ার সময় এখনো আসেনি। ওই রায়ে আদালতের পর্যবেক্ষণও লক্ষ করার মতো, ‘হালকা গাড়ির লাইসেন্স নিয়ে ভারী যানবাহন চালানো ঠেকাতে পুলিশকে কঠোর হতে হবে, এ বিষয়ে মালিককে সতর্ক থাকতে হবে এবং পথচারীদের সতর্কভাবে চলতে হবে।’

প্রথম দুটি ক্ষেত্রে রয়েছে শুভংকরের ফাঁকি, যে কারণে আদালতের সদিচ্ছা কতটা বাস্তবায়িত হবে তা নিয়ে সংশয়ের অবকাশ রয়েছে। হতাশা নয়, এটাই বাস্তবতা। তাই দেখা যাচ্ছে, এই আইনের মধ্যেই দুঃখজনক, দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা—‘কলেজছাত্রসহ সড়কে নিহত ৬’ (২৯.১১.২০১৯)।

এবং সে কারণেই দিয়া-রাজীব হত্যার রায় সামনে রেখে; সড়ক পরিবহন আইনের (২০১৮) পরিপ্রেক্ষিত বিবেচনায় একটি দৈনিকে কাব্যিক শিরোনাম : ‘সড়কে শৃঙ্খলা ফেরেনি তবু’ (২.১২.২০১৯)। প্রতিবেদনে ‘রাজীব-দিয়া’র জন্য শোকার্ত আক্ষেপ করতে গিয়ে ওই লেখায় ২৯ জুলাইয়ে (২০১৮) রাজীব-দিয়া হত্যার প্রতিবাদে সারা দেশে পথে নামা লাখ লাখ শিক্ষার্থীর বিক্ষোভ আন্দোলন প্রসঙ্গ উঠে আসে। উল্লিখিত হয় ‘তৎকালীন নৌপরিবহনমন্ত্রী শাহজাহান খানের পদত্যাগসহ ৯ দফা দাবি আদায়ের কথা। সেই শাহজাহান খান যেমন তখন, তেমনি এখনো পরিবহন শ্রমিক খাতের অন্যতম প্রধান নেতা।

এই আইন উপলক্ষে নিরাপদ সড়ক প্রসঙ্গে মালিক সমিতির মহাসচিব মনে করেন, ‘সড়কে নিরাপত্তা বজায় রাখতে মালিক-চালক-পথচারী সবার ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে হবে।’ এ ক্ষেত্রে পুলিশের ভূমিকাও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। ‘সড়ক কি আদৌ নিরাপদ হবে’—জনৈক নিবন্ধকারের এমন প্রশ্নের জবাবে বলতে হয় গোটা বিষয়টি নির্ভর করছে সব পক্ষের সদর্থক ভূমিকার ওপর। সর্বোপরি, নিরাপদ সড়কের মূল চাবিকাঠি রয়েছে যানবাহন মালিকের সদিচ্ছার মধ্যে। এ বিষয়ে প্রশ্নের কোনো অবকাশ নেই। সেই সঙ্গে জনগণের নিরাপত্তায় অঙ্গীকৃত সরকারের কঠোর ন্যায়সংগত অবস্থানের ওপর। আমরা অপেক্ষা করছি ফলাফল দেখার।

লেখক : কবি, গবেষক, ভাষাসংগ্রামী

শেয়ার করুন

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে