পাচার হওয়া টাকা ফেরাতে সরকারের ভিন্ন কৌশল

মত ও পথ প্রতিবেদক

অর্থপাচার
অর্থপাচার। ফাইল ছবি

সুইস ব্যাংকসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পাচার হয়ে যাওয়া লাখ লাখ কোটি টাকা ফিরিয়ে আনা নিয়ে বৈঠকের পর বৈঠক হলেও গ্রহণযোগ্য পথ বের হচ্ছে না। টাকা ফেরত আনা দুরূহ ও অত্যন্ত জটিল বিবেচনায় এখন ফেরতের চেয়ে বরং পাচার করা অর্থের ওপর জরিমানাসহ কর আরোপ করে তা আদায়ের কথা ভাবছে সরকার।

এ জন্য সম্ভাব্য অর্থ পাচারকৃত দেশে কর গোয়েন্দা পাঠানোর কথা বলা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের মডেল অনুসরণের বিষয়টি সামনে রাখা হয়েছে। এতে অসুবিধা হচ্ছে, পাচারকারীদের বিরুদ্ধে কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া যাবে না। যদিও এ মডেলের বিষয়ে আপত্তি করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।

universel cardiac hospital

এমন প্রেক্ষাপটে একটি খসড়া নীতিমালা তৈরির কথা বলেছে বাংলাদেশ ব্যাংকের ফিন্যানশিয়াল ইন্টেলিজেন্ট ইউনিট (বিএফআইইউ)। এ প্রতিবেদনের আলোকেই পরবর্তী কার্যক্রম গ্রহণ করা হবে। বিএফআইইউর বৈঠকের ভিত্তিতে তৈরি একটি প্রতিবেদন থেকে এসব তথ্য জানা গেছে।

বিএফআইইউর প্রধান আবু হেনা মোহাম্মদ রাজী হাসান গণমাধ্যমকে বলেন, পাচারের টাকা ফেরত আনতে না পারলেও অন্তত যাতে কর আদায় করে কিছু টাকা আনা যায়, এটা নিয়ে কাজ করছি। ভারত, যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের কয়েকটি দেশ এ বিষয়ে কাজ করছে। এখন আমরাও দেখছি কী করা যায়।

এ ধরনের উদ্যোগে এশিয়া প্যাসিফিক গ্রুপ অন মানি লন্ডারিংয়ের (এপিজি) কোনো আপত্তি থাকবে কি না- এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এতে তাদের আপত্তির কিছু নেই। পৃথিবীর বহু দেশ এ নিয়ে কাজ করছে। তথ্যের আদান-প্রদান করছে।

পাচারের অর্থ ফেরতের চেয়ে কর আদায়ের প্রস্তাব বাস্তবায়ন করা হলে কর হয়তো কিছু পাওয়া যাবে, তবে বাংলাদেশ থেকে পাচার হয়ে যাওয়া বিপুল অঙ্কের টাকা ফেরত আনা নিয়ে আশঙ্কা থেকে যায়। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফিন্যানশিয়াল ইন্টিগ্রিটি বা জিএফআই রিপোর্ট অনুযায়ী আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের আড়ালে ২০০৫ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে ১১ বছরে দেশ থেকে পাচার হয়েছে প্রায় ছয় লাখ কোটি টাকা।

আর বিশ্বব্যাংক বলছে, শুধু ২০১৫ সালেই বাংলাদেশ থেকে পাচার হয়েছে প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকা। কোনো গবেষণা না থাকলেও ধারণা করা হয়, এরপর ২০১৫ থেকে ২০১৯ সালের নভেম্বর পর্যন্ত বিপুল অঙ্কের টাকা পাচার হয়ে থাকতে পারে। কয়েকদিন আগেও ভুয়া কম্পানির আড়ালে পোলট্রি শিল্পের কাঁচামাল আনার নামে প্রায় এক হাজার এক শ কোটি টাকা পাচারের দায়ে দুজনকে আটক করা হয়েছে। এ রকম ঘটনা ধরা পড়ছে অহরহ।

সার্বিক বিষয়ে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন গণমাধ্যমকে বলেন, দ্বৈত কর পরিহার চুক্তির আওতায় কিভাবে পাচারের টাকা ফেরত না এনে কর আদায় করা হবে, এটা আমার বোধগম্য নয়। ভারত মডেল কতটা সফল এটাও পর্যালোচনার বিষয়।

তিনি উল্টো প্রশ্ন রেখে বলেন, আমরা পাচারের টাকাই আনতে পারছি না, তাহলে কী করে ওই টাকার ওপর কর আরোপ করব? এটা আমার কাছে ফিজিবল মনে হচ্ছে না। খাজনার চেয়ে বাজনা বেশি হলে তো পোষাবে না।

ড. জাহিদ মনে করেন, মুদ্রাপাচার কেন হয় আগে তা খুঁজে বের করতে হবে। দুর্নীতি, কর ফাঁকি, বিনিয়োগ জটিলতার কারণে সাধারণত মুদ্রাপাচার হয়। আগে এর উৎস বন্ধ করতে হবে।

অবশ্য টাকা ফেরতের চেয়ে কর আরোপ করার পক্ষে মত দিয়েছেন এনবিআরের সাবেক আয়কর নীতির সদস্য, সিআইসির সাবেক মহাপরিচালক ড. সৈয়দ আমিনুল করিম।

তিনি বলেন, আমি মনে করি দ্বৈত কর পরিহার চুক্তির আওতায় এভাবে জরিমানাসহ কর আদায় করা সহজ। ভারত যদি পারে তাহলে আমরা কেন পারব না? এ জন্য দুই দেশের সমন্বয়কারী থাকতে হবে। তথ্য আদান-প্রদানের মাধ্যমে তা করা সম্ভব। এখন তথ্য-প্রযুক্তির যুগ। এ সুযোগ আমরা কেন নেব না?

তিনি জানান, আমদানি-রপ্তানি ও এলসির তথ্য যাচাই-বাছাই করলেই অনেক ক্ষেত্রে মুদ্রাপাচার ধরা সম্ভব। এনবিআরের সিআইসিতে ডাটা ফরেনসিক ল্যাব রয়েছে। এর মাধ্যমে ডাটা অ্যানালিসিস করে পাচারের অনেক সংবেদনশীল তথ্য পাওয়া সম্ভব। এর পাশাপাশি মুদ্রাপাচার যাতে না হয় তাও খতিয়ে দেখার পরামর্শ দেন।

বিএফআইইউর প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, বাংলাদেশ ব্যাংকে এক বৈঠকে বিএফআইইউর পক্ষ থেকে জানানো হয়, বাংলাদেশসহ বিশ্বের কয়েকটি উন্নয়নশীল পর্যায়ের দেশ থেকে প্রতিবছর বিপুল অঙ্কের অর্থ সুইজারল্যান্ডে সুইস ব্যাংকসহ বিভিন্ন দেশে পাচার হয়। কয়েকটি দেশ টাকা ফেরতের কিছু সাফল্য পেলেও এ ব্যাপারে নানা তৎপরতার পরও সুইস ব্যাংক বাংলাদেশের অর্থের ব্যপারে কোনো সহায়তাই করেনি, তথ্যও দেয়নি।

বৈঠকে জানানো হয়, পাচারকৃত অর্থ চিহ্নিতকরণ ও টাকা ফেরত আনার বিষয়টি অনেক জটিল প্রক্রিয়া। প্রথমে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা কর্তৃক পাচারকৃত অর্থ চিহ্নিত করে তদন্তের পর মামলা করতে হয়। এরপর আদালত দিলেই কেবল প্রক্রিয়া শুরু করা যায়।

তবে এ ক্ষেত্রে অনুসন্ধান বা তদন্ত পর্যায়ে পাচারের বিষয়টি নিশ্চিত হলে তদন্তকারী সংস্থা ওই দেশে পাচারের অর্থ অবরুদ্ধ করার জন্য মিউচুয়াল লিগ্যাল অ্যাসিস্ট্যান্স বা এমএলএর জন্য অনুরোধ করতে পারে। এরপর ওই দেশের আদালত থেকে পাচারের অর্থ অবরুদ্ধ করার অনুমতি নিয়ে কয়েকটি ধাপের পর দুই দেশের কেন্দ্রীয় সংস্থার মাধ্যমে পাচারের অর্থ ফেরতের প্রক্রিয়া এগিয়ে নেওয়া হয়।

এ ক্ষেত্রে ওই দেশের আদালতের কাছে বিষয়টি প্রমাণসাপেক্ষে গ্রহণযোগ্য হতে হবে। বাংলাদেশের আদালতে যে রায় হয়েছে অন্য দেশের আদালতে তা গ্রহণযোগ্য নাও হতে পারে। প্রমাণ হলেও আবার কস্ট শেয়ারিং বা অর্থের ভাগাভাগির ব্যাপার রয়েছে। নানান শর্তও রয়েছে। এসব ক্ষেত্রে যে দেশে অর্থ পাচার হয়েছে তাদের সদিচ্ছার অভাব থাকলে অর্থ ফেরত আনা অত্যন্ত দুরূহ ব্যপার।

যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, স্পেনসহ বহু দেশ এ প্রক্রিয়া থেকে বের হয়ে গেছে। বিএফআইইউ বলছে, সর্বোপরি পাচারের অর্থ দেশে ফেরত আনা শ্রমসাধ্য, সময়সাপেক্ষ এবং অনেকটাই কঠিন বিষয়।

এমন প্রেক্ষাপটে বৈঠকে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) প্রতিনিধি টাকা ফেরত আনার চেয়ে বরং পাচারের টাকা চিহ্নিত করে ওই টাকার ওপর জরিমানাসহ কর আরোপের প্রস্তাব দেন। এ সময় জানানো হয়, ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র এ মডেলে সফল হয়েছে।

এ প্রক্রিয়ায় ভারত সুইজারল্যান্ড থেকে জরিমানাসহ কর আদায় করেছে। সুইস ব্যাংকে দেশটির ৬৩৯ জন নাগরিকের হিসাব পরিচালনা সংক্রান্ত তথ্য পাওয়ার পর জনৈক ব্যক্তি টাকা ফেরত আনতে সে দেশের আদালতে মামলা করেন। মামলার রায়ে দেশটির কর বিভাগকে টাকা ফেরত আনার দায়িত্ব দিলে তারা জরিমানাসহ কর আদায়ে সক্ষম হয়।

এ ব্যাপারে ভারত ও সুইজারল্যান্ডের মধ্যে দ্বৈত কর পরিহার চুক্তির সহায়তা নেওয়া হয়। তবে এ ক্ষেত্রে পাচারকারীর তথ্য অন্য কোনো সংস্থাকে দেওয়া যাবে না এবং পাচারকারীর বিরুদ্ধে ফৌজদারি ব্যবস্থাও নেওয়া যাবে না।

পুরো টাকা ফেরত আনার অনিশ্চয়তার চেয়ে জরিমানাসহ কর আরোপ অনেক সহজ জানিয়ে বৈঠকে বলা হয়, বাংলাদেশের সঙ্গে সুইজারল্যান্ডসহ বহু দেশের দ্বৈত কর পরিহার চুক্তি রয়েছে। এর আওতায় তথ্য আদান-প্রদান করা সম্ভব।

কর কর্মকর্তা জানান, ভারত পাচারের অর্থের ওপর জরিমানাসহ কর আদায়ে তাদের ১০টি দূতাবাসে এবং যুক্তরাষ্ট্র তাদের ২৪টি দূতাবাসে কর কর্মকর্তা নিয়োগ দিয়েছে। এ জন্য বাংলাদেশের দূতাবাসে সার্বক্ষণিক কর কর্মকর্তা নিয়োগ সম্ভব না হলেও অন্তত এক থেকে দুই মাসের জন্য একজন কর গোয়েন্দা নিয়োগের প্রস্তাব করা হয়।

এ প্রস্তাবের আপত্তি করে বৈঠকে মতামত দেন দুদকের প্রতিনিধি। তিনি জানান, কর আদায়ের মাধ্যমে পাচারকারীকে অব্যাহতি দেওয়া হলেও মানি লন্ডারিং আইনে পাচারকারীকে অব্যাহতি দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। এ ছাড়া এপিজিও এ ব্যাপারে আপত্তি করবে। এ সময় বিএফআইইউর প্রধান বৈঠকে জানান, ভারত কর আদায় করলেও অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে আর কোনো ফৌজাদারি ব্যবস্থা নেয়নি।

সব শেষে বৈঠকে জরিমানাসহ কর আরোপের ব্যাপারে নমনীয়তা প্রকাশ করে একটি খসড়া নীতিমালা তৈরির পাশাপাশি সম্ভাব্য পাচারকৃত দেশে এক বা দুই মাসের জন্য কর ও আর্থিক গোয়েন্দা পাঠানোর সিদ্ধান্ত হয়। এ জন্য সুইজারল্যান্ডের সঙ্গে বাংলাদেশের দ্বৈত কর পরিহার চুক্তিটি হালনাগাদ করার পরামর্শ দেওয়া হয়।

জিএফআইয়ের প্রতিবেদনে ১৪৮টি উদীয়মান ও উন্নয়নশীল দেশের অর্থপাচারের তথ্য দেওয়া হয়েছে। সবচেয়ে বেশি অর্থপাচার হয় চীন থেকে। এ তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান ১৯তম। তবে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ায় দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, বাংলাদেশ থেকে ২০০৫ সালে ৪২৬ কোটি ডলার, ২০০৬ সালে ৩৩৭ কোটি ডলার, পরের বছর ২০০৭ সালে ৪০৯ কোটি ডলার পাচার হয়। ২০০৮ সালে পাচারের পরিমাণ ৬৪৪ কোটি ডলারে দাঁড়ায়। ২০০৯ সালে ৫১০ কোটি ডলার। ২০১০ সালে ৫৪০ কোটি ডলার, ২০১১ সালে ৫৯২ কোটি ডলার ও ২০১২ সালে ৭২২ কোটি ডলার অর্থপাচার হয়।

শেয়ার করুন

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে