মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় কর্তৃক সদ্য প্রকাশিত রাজাকার, আলবদর, আলশামস ও স্বাধীনতাবিরোধীর তালিকায় মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ও পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে নির্যাতিতদের নাম অন্তর্ভুক্ত হওয়ার বিষয়টি সারা দেশে ব্যাপক বিতর্ক ও সমালোচনার ঝড় তুলেছে। তাছাড়া কোনো কোনো স্থানে স্বীকৃত রাজাকারের নাম তালিকা থেকে বাদ পড়ে যাওয়ার ঘটনাও ঘটেছে।
বিষয়টি নিয়ে ব্যাপক ক্ষোভ ও হতাশা দেখা গেছে মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক এবং তাদের পরিবারের মধ্যেও। কোথাও কোথাও গতকাল এর প্রতিবাদে বিক্ষোভ কর্মসূচিরও আয়োজন করা হয়। স্বাধীনতাবিরোধীর তালিকায় দেশের বিভিন্ন স্থানের মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ও পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে নির্যাতিতদের অন্তর্ভুক্তি এবং এ নিয়ে প্রতিক্রিয়ার সংবাদ—
সিরাজগঞ্জ: মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় প্রকাশিত রাজাকারের তালিকায় মুক্তিযুদ্ধের সময়ে সিরাজগঞ্জে গঠিত মুক্তিযোদ্ধাদের পলাশডাঙ্গা যুবশিবিরের সর্বাধিনায়ক, জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি ও উল্লাপাড়া থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্য ও জাতীয় সংসদের প্যানেল স্পিকার প্রয়াত আব্দুল লতিফ মির্জার নাম অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের সংগঠকদের মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভ দেখা দিয়েছে। আব্দুল লতিফ মির্জার নাম এ তালিকা থেকে প্রত্যাহারের জোর দাবি জানিয়েছেন তারা।
এ বিষয়ে জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার ও পলাশডাঙ্গা যুবশিবিরের সামরিক প্রশিক্ষক সোহরাব আলী সরকার বলেন, আব্দুল লতিফ মির্জার নাম কীভাবে এ তালিকায় এল, সেটাই ভাবার বিষয়। এতে আমরা হতাশ হয়েছি।
বিষয়টি নিয়ে করণীয় ঠিক করতে আজ স্থানীয় সব মুক্তিযোদ্ধাকে নিয়ে জরুরি বৈঠক ডাকা হয়েছে বলেও জানান তিনি।
বিষয়টি নিয়ে আব্দুল লতিফ মির্জার পরিবারের পক্ষ থেকেও ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দেয়া হয়েছে। আব্দুল লতিফ মির্জার মেয়ে মুক্তি মির্জা বলেন, এমন ঘটনায় আমরা স্তম্ভিত ও বাকরুদ্ধ। লতিফ মির্জার নাম রাজাকারের তালিকায় আসা মানে মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশকেই অস্বীকার করা। মুক্তিযুদ্ধের সময় গঠিত ছয়টি বেসামরিক বাহিনীর মধ্যে মুক্তিযোদ্ধা সংগঠন সিরাজগঞ্জের পলাশডাঙ্গা যুবশিবির ছিল খুবই শক্তিশালী, যার প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক ছিলেন আমার বাবা। বিষয়টি জানানোর জন্য আমাদের পরিবারের পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রী ও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করার চেষ্টা করা হচ্ছে।
বরিশাল: স্বাধীনতাবিরোধীদের তালিকায় ভাতাপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা অ্যাডভোকেট তপন কুমার চক্রবর্তী এবং তার মা ও শহীদ জায়া উষা রানী চক্রবর্তীর নাম অন্তর্ভুক্তির বিষয়টি জেলায় ব্যাপক আলোড়নের সৃষ্টি করেছে। বরিশালে এ নিয়ে প্রতিবাদ কর্মসূচি অব্যাহত রয়েছে।
নগরীর অশ্বিনী কুমার হলের সামনে গতকাল দুপুরে বিতর্কিত এ তালিকায় আগুন ধরিয়ে প্রতিবাদ জানায় বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ)। এ সময় সংগঠনটির পক্ষ থেকে পুনরায় ও সংশোধিত তালিকা প্রকাশের দাবি জানানো হয়।
এর আগে সকালে নগরীর ফকিরবাড়ি রোড বাসদ কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। এ সময় অ্যাডভোকেট তপন কুমার চক্রবর্তী ও তার মেয়ে ডা. মনীষা চক্রবর্তী উপস্থিত ছিলেন।
তপন কুমার চক্রবর্তী বলেন, একজন গেজেটেড মুক্তিযোদ্ধাকে রাজাকারের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা দুঃখজনক। এ ঘটনা যারা ঘটিয়েছে তারা অসৎ উদ্দেশ্যে এমনটা করেছে। তালিকা সংশোধনের পাশাপাশি জড়িতদের আইনের আওতায় আনতে হবে।
সংবাদ সম্মেলন শেষে একটি বিক্ষোভ মিছিল নগরীর বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ করে। পরে তালিকা থেকে তপন কুমার চক্রবর্তীর নাম প্রত্যাহারের দাবিতে সদর রোডে একটি সমাবেশের আয়োজন করা হয়।
ঝালকাঠি: মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় প্রকাশিত স্বাধীনতাবিরোধীর তালিকায় ঝালকাঠির মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক জেলা কমান্ডার শামসুল আলমের নামও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। প্রয়াত শামসুল আলম চারবার জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করেন। বিষয়টি নিয়ে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক এবং শামসুল আলমের পরিবারের সদস্যরা ব্যাপক ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন।
বগুড়া: মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের স্বাধীনতাবিরোধীর তালিকায় বগুড়ারও বেশ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা ও আওয়ামী লীগের মুক্তিযুদ্ধকালীন সংগঠকের নাম অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে তালিকাটি সংশোধনের দাবি জানিয়েছেন মুক্তিযোদ্ধারা। এ ঘটনার প্রতিবাদ ও নিন্দা জানিয়েছেন তারা।
এ তালিকায় বিতর্কিতভাবে যাদের নাম অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, তাদের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক আওয়ামী লীগ নেতা ও সাবেক এমপি কছিম উদ্দিন আহম্মেদের নামও রয়েছে। এছাড়া আওয়ামী লীগের সাবেক এমএনএ মজিবর রহমান (আক্কেলপুর), মুক্তিযুদ্ধকালীন কমান্ডার মনছুর আলীসহ আরো কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের সংগঠকের নামও রয়েছে।
বরগুনা: বরগুনার পাথরঘাটা মুক্তিযুদ্ধ সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি, পাথরঘাটা থানা আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি প্রয়াত মজিবুল হকের নামও স্বাধীনতাবিরোধীদের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে স্থানীয়দের মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে।
প্রয়াত মজিবুল হক ১৯৮৬ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে (পাথরঘাটা-বামনা) সংসদীয় আসন থেকে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়ে নৌকা প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করেন। ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত তিনি পাথরঘাটা থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিলেন।
তালিকায় তার নাম আসায় বিক্ষুব্ধ মুক্তিযোদ্ধারা গতকাল সকালে পাথরঘাটা প্রেস ক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে প্রতিবাদ জানিয়েছেন।
সংবাদ সম্মেলনে পাথরঘাটা উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার আবদুল মান্নান বলেন, মজিবুল হক বঙ্গবন্ধুর সহচর ছিলেন। তারা একই সময়ে কলকাতার ইসলামিয়া কলেজের ছাত্র ছিলেন। পাথরঘাটার তালিকায় প্রকাশিত আটটি নামের মধ্যে চিহ্নিত রাজাকার আছেন মোটে তিনজন। তারা হলেন কালমেঘার গোলাম কাদের কাদু, টেংরার শেখ আবদুল মালেক ও পাথরঘাটার ছালেহ আহমেদ। বাকিরা স্বাধীনতাবিরোধী ছিলেন না।
তিনি আরও জানান, তালিকার আমির হামজা ওরফে রুস্তম খা ও খলিলুর রহমান মানিক তালিকাভুক্ত মুক্তিযোদ্ধা। এদের মধ্যে খলিলুর রহমান মানিক বাদী হয়ে পাথরঘাটা থানার শান্তি কমিটির সভাপতি খলিলুর রহমানকে আসামি করে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে মামলা করেছিলেন।
সংবাদ সম্মেলন শেষে পাথরঘাটা পৌর শহরের শেখ রাসেল চত্বরে মানববন্ধনের আয়োজন করা হয়।
নাটোর: স্বাধীনতা-পরবর্তীকালে নাটোরে সেখানকার কুখ্যাত ৫৯ রাজাকারের একটি তালিকা তৈরি হয়েছিল। তৎকালীন নাটোর মহকুমার প্রশাসন এতে স্বীকৃতিও দিয়েছিল। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের রোববার প্রকাশিত তালিকায় এদের নাম খুঁজে পাওয়া যায়নি। বিষয়টি নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা।
নাটোরের সিংড়া উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার আব্দুল ওয়াদুদ দুদু বলেন, ১৫ ডিসেম্বর সরকারিভাবে যে তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে, সে তালিকা ভুলে ভরা। প্রকৃত যারা রাজাকার ছিল, তাদের নাম তালিকায় আসেনি। তাছাড়া কিছু কিছু স্বীকৃত রাজাকার এখনো বেঁচে রয়েছে। তারা বুক ফুলিয়ে চলছে। তালিকা আরও যাচাই-বাছাই করে প্রকাশ করলে ভালো হতো।
সূত্র জানায়, ১৯৭৫ সালের ৫ মার্চ নাটোর মহকুমার ৫৯ রাজাকারের একটি নামের তালিকা প্রকাশ করা হয়। নাটোর মহকুমার তত্কালীন প্রশাসনও এ তালিকায় স্বীকৃতি দেয়। তালিকাটি পরবর্তী সময়ে নষ্ট করে ফেলা হয়েছে বলে সন্দেহ করছেন তারা।
এদিকে নাটোর জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে মুক্তিযুদ্ধের সময়কার রাজাকার, আলবদর, আলশামস বা শান্তি কমিটির কোনো তালিকা বা দলিলপত্র পাওয়া যায়নি। জেলা প্রশাসক মো. শাহরিয়াজ জানান, ট্রেজারি অফিসে অনুসন্ধান করে কোনো দলিলপত্র পাওয়া যায়নি।
তিনি বলেন, তৎকালীন সময়ে মহকুমা প্রশাসকের কার্যালয় (এসডিও) অফিস ছিল নাটোরে। কিন্তু ট্রেজারিতে সে সময়ের কোনো দলিলপত্র বা তালিকা নেই। আমরা অনুসন্ধান করে এ ধরনের কোনো কাগজপত্র পাইনি।