বিদায়ি বছরের রাজনৈতিক সালতামামি

আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরী

আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরী
আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরী। ফাইল ছবি

বিদায় ২০১৯। ব্রিটেনের রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ তাঁর ক্রিসমাসের বাণীতে বছরটি যে অসুবিধাজনক ছিল সে কথা উল্লেখ করেছেন। ব্রেক্সিট নিয়ে সারা বছর ব্রিটেনে ঝামেলা গেছে প্রচুর। রানির দ্বিতীয় পুত্র এন্ড্রুজ এ বছর নারী কেলেঙ্কারিতে জড়িত হয়ে তাঁর রাজকীয় পদের দায়িত্বগুলো হারিয়েছেন। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প শান্তিতে নেই। নিম্ন আদালতে তাঁর বিরুদ্ধে অভিশংসন পাস হয়ে গেছে। এখন রিপাবলিকান সংখ্যাগরিষ্ঠ সিনেট তাঁকে বাঁচিয়ে দেয় কি না তা দেখার রইল।

পাকিস্তানে ক্রিকেটার ইমরান সেনাবাহিনীর সমর্থনে কোনো রকমে ক্ষমতায় টিকে আছেন। প্রতিনিয়ত জঙ্গি হামলায় চলছে মানুষ হত্যা। টেলি টক শোতে দেশটির কোনো কোনো বুদ্ধিজীবী বলেছেন, পাকিস্তানকে বাঁচাতে তাঁদের একজন শেখ হাসিনা চাই। মিয়ানমারের অং সান সু চির সেই বিশ্বখ্যাতি আর নেই। রোহিঙ্গাদের ওপর তাঁর সামরিক বাহিনীর বর্বর হত্যাকাণ্ডের জন্য তাঁকে বিশ্ব আদালতের আসামির কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয়েছিল।

ভারতের রাজনীতি বিদায়ি বছরে টালমাটাল হয়েছে। মাত্র কয়েক বছর আগে ভারতব্যাপী যে মোদি-ঝড় উঠেছিল, তা এই বিদায়ি বছরে প্রশমিত। সাধারণ নির্বাচনে বিরোধী দলগুলোর অনৈক্য ও কংগ্রেসে নেতৃত্বের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে নরেন্দ্র মোদি আরো সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় এসেছেন বটে; কিন্তু তাঁর তখতে তাউস নড়বড়ে হয়ে গেছে। ভারতের নাগরিকত্ব আইন, সংখ্যালঘুদের, বিশেষ করে মুসলমানদের দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকে নামিয়ে দেওয়া এবং এনআরসি নিয়ে সারা ভারত এখন বিক্ষোভ ও প্রতিবাদে উত্তাল। রোজই এখানে-সেখানে জনতা বিক্ষোভ দেখাচ্ছে। পুলিশ গুলি চালাচ্ছে। মানুষ মরছে।

এই বিক্ষোভে শামিল হয়েছেন ভারতের নোবেলজয়ী অমর্ত্য সেন, বিশ্বখ্যাত লেখিকা অরুন্ধতী রায়, এমনকি কলকাতার চলচ্চিত্রজগতের ‘বিদুষী নায়িকা’ বলে খ্যাত অপর্ণা সেনও। এ সম্পর্কে প্রতিবাদ জানিয়ে তিনি প্রধানমন্ত্রী মোদিকে চিঠি পাঠিয়েছেন এবং আরো অনেকেসহ রাষ্ট্রদ্রোহের দায়ে অভিযুক্ত হয়েছেন। আমাদের শহীদ জননী জাহানারা ইমামের অবস্থায় তিনি পড়েছেন। এই গণবিক্ষোভে মোদি সরকারের পতন হবে—এমন কথা কেউ ভাবছেন না। কিন্তু মোদি সরকার কাশ্মীরেও আগুন জ্বালিয়েছে। কাশ্মীরসহ ভারতের বর্তমান অভ্যন্তরীণ অবস্থা ভবিষ্যতে কী রূপ নেয় তা নিয়ে অনেকেই ভাবিত।

এবার জাতীয় রাজনীতির কথায় আসি, আজ ২০১৯ সালের শেষ মাসের শেষ দিন। এই মাসের ১১ তারিখে বাংলাদেশে গিয়েছিলাম। ডাক্তারের নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে অসুস্থ শরীরে ঢাকায় গিয়েছি এবং অসুস্থ শরীরেই লন্ডনে ফিরে এসেছি। ২১ তারিখ পর্যন্ত ঢাকায় ছিলাম। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছিলাম। তিনি সময় দিতে পারেননি। আগেই অনুমান করেছিলাম, তিনি দলের জাতীয় সম্মেলন ও বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উদ্যাপনের মহাপ্রস্তুতি নিয়ে এত ব্যস্ত আছেন যে আমাকে সাক্ষাৎ দানের সময় করে উঠতে পারবেন না। সেটাই হয়েছে।

তবে ২০ তারিখে আওয়ামী লীগের সম্মেলনের প্রথম দিনের অধিবেশনে যোগ দেওয়ার জন্য তিনি নিজেই আমাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। এমনকি আমি অসুস্থ জেনে যাতে সম্মেলনে যেতে পারি, মন্ত্রীদের দিয়ে তার বিশেষ ব্যবস্থা করেছিলেন। কিন্তু শরীর আরো খারাপ হওয়ায় সম্মেলনে যেতে পারিনি। নইলে আওয়ামী লীগের এই ঐতিহাসিক সম্মেলনে যাওয়ার বিশেষ ইচ্ছা ছিল। বিধি বাম। ২১ তারিখে দ্বিতীয় দিনের অধিবেশনে যাব, তাও পারিনি। ওই দিন লন্ডনে ফিরে এসেছি।

মাত্র ১০ দিন ঢাকায় থাকলেও জাতীয় রাজনীতির নাড়ির স্পন্দন অনুভব করতে আমার অসুবিধা হয়নি। বয়স ও অভিজ্ঞতা আমাকে সাহায্য করেছে। আওয়ামী লীগের ২৫তম জাতীয় সম্মেলন উপলক্ষে ঢাকা শহর যখন সরগরম তখন আমি সেখানে উপস্থিত। এই সম্মেলনকে আমি ঐতিহাসিক বলেছি। তার কারণ, বাংলাদেশের রাজনৈতিক নাটমঞ্চে এখন শুধু প্রবল পদধ্বনি আওয়ামী লীগেরই শোনা যায়। আওয়ামী লীগ একটানা ১২ বছর ধরে ক্ষমতায় রয়েছে।

তাঁর নীতি ও নেতৃত্বের প্রভাব পড়েছে সারা দক্ষিণ এশিয়ায়। শেখ হাসিনা এখন শুধু একটি দলের এবং একটি দেশের নেত্রী নন, দক্ষিণ এশিয়ার তিনি একজন প্রভাবশালী নেতা—তাঁর দল এবারের অধিবেশনে নতুনভাবে সংগঠিত হয়ে তাঁর দেশকে যে দিকনির্দেশনা দেবে, সেদিকে সারা দক্ষিণ এশিয়ার মানুষের দৃষ্টি রয়েছে। কারণ তা থেকে তারাও দিকনির্দেশনা লাভ করতে চায়।

এই ব্যাপারে পেশোয়ারের খাইবার টাইমস পত্রিকায় পাকিস্তান ন্যাপের এক নেতার একটি মন্তব্য প্রকাশিত হয়েছে। তিনি বলেছেন, সারা দক্ষিণ এশিয়ায় সাম্প্রদায়িক দানবের উত্থান ঘটেছে। পাকিস্তান একটি কট্টর সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র। তার পাল্টা আরো ভয়াবহ সাম্প্রদায়িকতার প্রকাশ ঘটেছে ভারতে। যে ভারত ছিল সারা এশিয়ার জন্য গণতন্ত্রের বাতিঘর, সে বাতি আজ নিভে যাওয়ার মুখে। মিয়ানমারে রেস-রিলেশন্সের চরম অবনতি ঘটেছে। সংখ্যালঘু রোহিঙ্গারা নির্মম গণহত্যার শিকার। এই অবস্থায় একমাত্র বাংলাদেশে শেখ হাসিনা গণতন্ত্রের কাঠামোটুকু অন্তত জীবন বাজি রেখে বাঁচিয়ে রেখেছেন। এই অবস্থায় বাংলাদেশের এই নেত্রীর দলের জাতীয় সম্মেলন থেকে কী দিকনির্দেশনা আসে, সেদিকে সারা উপমহাদেশের মানুষের দৃষ্টি নিবদ্ধ রয়েছে। কারণ বাংলাদেশে গণতন্ত্র ও অসাম্প্রদায়িকতার এই দীপশিখা থেকেই গোটা উপমহাদেশে—তথা দক্ষিণ এশিয়ায় গণতন্ত্রের সহস্র দীপশিখা জ্বলে উঠতে পারে।

সারা দক্ষিণ এশিয়ার সাধারণ মানুষের এই আশা আওয়ামী লীগের বর্তমান অধিবেশন কতটা পূরণ করতে পেরেছে, সেই আলোচনায় যাওয়ার আগে আমাদের জাতীয় রাজনীতির সামগ্রিক অবস্থাটা একবার বিবেচনা করা দরকার। বাংলাদেশের রাজনৈতিক জীবনে অচলাবস্থা নেই, কিন্তু সজীবতাও নেই। আওয়ামী লীগ নির্বাচিত এবং গণতান্ত্রিক সরকার; কিন্তু জবাবদিহির সরকার নয়। কারণ আওয়ামী লীগ সরকার জবাবদিহি হবে কার কাছে? জনগণের নির্বাচিত সংসদের কাছে? কিন্তু সংসদে শক্তিশালী বিরোধী দল নেই। মাঠেও নেই কোনো গণতান্ত্রিক বিরোধিতা।

আগে মাঠে যে আন্দোলন চলেছিল তা সন্ত্রাস। সন্ত্রাসী ও স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াতের সঙ্গে মিশে বিএনপি আন্দোলনের নামে এই সন্ত্রাস চালিয়েছিল এবং তার গণতান্ত্রিক চরিত্র হারিয়েছিল। বিদায়ি ২০১৯ সালে এই গণতান্ত্রিক চরিত্র সে অর্জন করতে পারেনি। যে রাজনৈতিক দল কর্মী ও গণসমর্থননির্ভর নয়, ক্যান্টনমেন্ট ও নেতানির্ভর হয়, সে দলের অবস্থা এটাই হয়। বিএনপি ক্যান্টনমেন্টের সমর্থন হারিয়েছে, এখন নেত্রী দীর্ঘদিনের জন্য দুর্নীতির দায়ে জেলে যাওয়ায় তারা একেবারেই দিশাহারা। দলের অপর শীর্ষ নেতা বিদেশে পলাতক। মাঝ পর্যায়ের নেতারা আত্মকলহে মাথা তুলতে পারছেন না। সিদ্ধান্ত নিতে পারছেন না। বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম দলটির অবস্থা এখন হারাধনের দশ ছেলের মতো।

বিদায়ি বছরে দেখা গেছে, বিএনপির অবস্থা রণক্ষেত্রে পরাজিত পক্ষের শিবিরের মতো। একেবারেই বিপর্যস্ত। দলে নেতৃত্বের অভাব পূরণের জন্য বিএনপি গত সাধারণ নির্বাচনের সময় দু-একজন রাজনৈতিক এতিমকে রাজনৈতিক বনবাস থেকে তুলে এনে ঐক্যফ্রন্ট গঠন করেছিল। বিদায়ি বছরে এই ঐক্যফ্রন্টে আস্থার বড় অভাব। রাজনৈতিক এতিম নেতারা ঐক্যফ্রন্ট ছেড়ে আবার বনবাসের গুহায় ফিরে যাচ্ছেন। আর বিএনপিতে দেখা দিয়েছে নেতৃত্বের অভাব ও সিদ্ধান্তহীনতা। স্ববিরোধিতার কানাগলিতে তাঁরা সবাই ঘুরে মরছেন।

দলটি এখনো সংশয় ও স্ববিরোধিতার আবর্তে ঘুরপাক খাচ্ছে। মাথা খাড়া করতে পারছে না। গত সাধারণ নির্বাচনে তাদের যোগ দেওয়া ঠিক হয়েছিল কি না, ঐক্যফ্রন্ট গঠন এবং ড. কামাল হোসেনকে নেতৃত্বে আনা সঠিক সিদ্ধান্ত ছিল কি না, জাতীয় সংসদে যোগদান, যোগদান না করা, জামায়াতকে এখনো সঙ্গে রাখা ঠিক হলো কি না ইত্যাদি প্রশ্নে দলের কর্মীদের মধ্যে কেন, দলের নেতাদের মধ্যেও কোনো ঐকমত্য নেই। দলের প্রতিটি স্তর সংশয় ও বিবাদে জর্জরিত।

বিএনপি বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম রাজনৈতিক দল। বিস্ময়ের ব্যাপার, তাদের থলিতে কোনো বিকল্প রাজনৈতিক কর্মসূচি নেই। একমাত্র কর্মসূচি খালেদা জিয়ার মুক্তি। হতাশ কর্মীদের মনোবল অক্ষুণ্ন রাখা এবং একই উদ্দেশ্যে কোনো কোনো নেতা মাঝেমধ্যে গর্জন করে বলেন, সরকারের পতন ঘটানোর লক্ষ্যে খালেদা জিয়ার মুক্তির একটিমাত্র দাবিতে দেশে গণ-আন্দোলন গড়ে তোলা হবে। এ ছাড়া তাদের সামনে আর কোনো উপায় নেই। এটা অক্ষমের আস্ফাালন। দেশে এখন আন্দোলন গড়ে তোলার কোনো পরিবেশ নেই এবং খালেদা জিয়ার মুক্তি দাবিতে গণ-আন্দোলনের ডাক দিলে দেখা যাবে তাতে জনসমর্থন নেই। আন্দোলনের ডাক দেওয়ার আগে তাঁর পক্ষে কী করে জনসমর্থন গড়ে তোলা যাবে সে সম্পর্কে বিএনপি নেতারা নীরব। বোঝাই যায়, এটা কর্মীদের ধোঁকা দেওয়া ছাড়া আর কিছু নয়।

অথচ বিএনপিই পারত দেশে গণতান্ত্রিক বিরোধিতার শূন্যতা পূরণ করতে। যদি তারা স্বাধীনতার শত্রু জামায়াতের সঙ্গ ত্যাগ করে বিকল্প রাজনৈতিক কর্মসূচি নিয়ে সংসদ ও মাঠের রাজনীতিতে অবিচল থাকত। তারা ক্ষমতা দখলের শর্টকাট পলিসি গ্রহণ করতে চেয়েছে। জামায়াতের সঙ্গ এবং সন্ত্রাসের পথ ধরে ক্ষমতা দখল করে চিরকালের জন্য তা ধরে রাখতে চেয়েছে। বিদায়ি বছরটি তাই তাদের সম্পূর্ণ ব্যর্থ রাজনীতির বছর। তবে বছর শেষে তাদের একটি পজিটিভ ঢাকার দুই অংশের দুই মেয়র পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতার সিদ্ধান্ত। তাদের জয়ের সম্ভাবনা যে একেবারেই নেই এ কথা বলব না।

বিদায়ি বছরে জাতীয় পার্টির নেতা হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের মৃত্যু হওয়ায় দেশের রাজনীতিতে একটা শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছে। মনে হয়েছিল তাঁর মৃত্যুর পর জাতীয় পার্টি ভেঙে যাবে। সে আশঙ্কা সত্য হয়নি। ‘প্রধান পৃষ্ঠপোষক’ নামে একটি আলংকারিক পদ সৃষ্টি করে এবং তাতে বেগম রওশন এরশাদকে বসিয়ে জোড়াতালি দিয়ে জাতীয় পার্টির ঐক্য রক্ষা করা গেছে। এই জোড়াতালি বেশি দিন টিকবে মনে হয় না। ক্ষমতার দ্বন্দ্ব বড় দ্বন্দ্ব। দলে একটি ক্ষমতাসীন আলংকারিক পদ লাভ করে বেগম সাহেবা বেশি দিন খুশি থাকবেন মনে হয় না।

শুধু অভ্যন্তরীণ ক্ষমতার দ্বন্দ্বে নয়, জাতীয় পার্টি ক্লীব রাজনীতি ত্যাগ না করলে জাতীয় রাজনীতিতে টিকে থাকা তার পক্ষে অসম্ভব হবে। জাতীয় পার্টি বর্তমান সংসদে সরকারপক্ষ, না বিরোধীপক্ষ এই প্রশ্নটির স্পষ্ট মীমাংসা দিতে হবে। তার ওপর জি এম কাদেরের জাতীয় নেতৃত্বে উঠে আসার মতো দক্ষতা ও যোগ্যতা আছে কি না তার প্রমাণও তাঁকে দিতে হবে। নইলে জাতীয় পার্টির অবস্থা হবে ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরীর বিকল্পধারার মতো। এই বিকল্পধারাও একজন সাবেক রাষ্ট্রপতির পার্টি।

গণফোরামকে আমি রাজনৈতিক দল বলে মনে করি না। এটি এক ব্যক্তির রাজনৈতিক এপিটাফ। তাই এটি নিয়ে আলোচনা নিষ্প্রয়োজন। জাসদের প্রধান দুই অংশই হয়তো বিলুপ্তির পথে। সিপিবি, ওয়ার্কার্স পার্টি তথা দেশে বাম রাজনীতি এখন গ্রামের এককালের প্রতাপশালী জমিদারদের ভাঙা দালানের মতো। এটা শিগগিরই মেরামত হবে এমন আশা কম। আদি ওয়ার্কার্স পার্টির নেতা মন্ত্রিত্ব হারানোর পর রাজনৈতিক হলিডেতে গেছেন। সিপিবি তার আগের রেটোরিক উচ্চারণে ব্যস্ত। এটি অনেকটা তারাশঙ্করের ‘জলসাঘর’ উপন্যাসের এককালের অভিজাত জমিদার পরিবারের শেষ নিঃস্ব বংশধরের হুঁকোর নলে টান দিয়ে কল্পিত দারোয়ানকে হাঁক দিয়ে বলা, মেরা ঘোড়া লে আও। তার আস্তাবলে যে আর ঘোড়া নেই, এই বোধ তার নেই। এককালের শক্তিমান সিপিবি, মোজাফফর ন্যাপ এখন নেই। বাংলাদেশে কেন, পশ্চিমবঙ্গ ও ত্রিপুরায়ও এখন বামদের বাম দশা। এই অবস্থায় বাংলাদেশের সিপিবি যখন বাম বিকল্প শক্তি গড়ে তোলার ডাক দেয় তখন তা জলসাঘরের নিঃস্ব জমিদারের ঘোড়া তলব করার মতো হয়ে দাঁড়ায়। দেশে বাম রাজনীতি নেই। বাম ঐক্য গড়ে উঠবে কোথা থেকে। বরং সিপিবির নেতাদের বাস্তবতাবোধ থাকলে তাঁরা বৃহত্তর গণতান্ত্রিক ঐক্য গড়ার ডাক দিতে পারতেন।

এবার আমি বিদায়ি বছরের শেষ মাসে অনুষ্ঠিত ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ দলের জাতীয় সম্মেলনের কথায় আসি। দলের কেন্দ্রীয় কমিটি নতুনভাবে গঠিত হয়েছে। তাতে সামান্য কয়েকটি নতুন মুখ এসেছেন। উপদেষ্টা পরিষদেও তাই। শেখ হাসিনা সভানেত্রী থাকবেন এটা নিয়ে কোনো সংশয় ছিল না। সংশয় ছিল ওবায়দুল কাদের সাধারণ সম্পাদক থাকবেন কি না। তিনি সাধারণ সম্পাদক পদে পুনর্নির্বাচিত হওয়ায় আমি খুশি হয়েছি। তাঁর দুটি গুণ। ওপরতলার রাজনীতি তিনি বোঝেন। আবার মাঠের রাজনীতির ভাষাও তিনি জানেন।

কিন্তু বিদায়ি বছর আমাকে একটি ব্যাপারে নিরাশ করেছে। মন্ত্রিসভায় রদবদলের চেয়েও আমি আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী পরিষদের অনেক পদে নতুন রক্তের সঞ্চালন এবং একটা বড় ধরনের পরিবর্তন আশা করেছিলাম। আশা করেছিলাম আওয়ামী লীগ নতুনভাবে পুনর্গঠিত হবে। সারা দক্ষিণ এশিয়াকে নতুন দিকদর্শন দেবে। সে জন্যই বলেছিলাম, এই অধিবেশন ঐতিহাসিক হবে। সেই ঐতিহাসিকতা এই অধিবেশন দেখাতে পারেনি। শুধু জাঁকজমক দেখিয়েছে। মরচে ধরা তলোয়ার দিয়ে আধুনিককালের যুদ্ধে নামা যায় না।

২০১৯ অর্থাৎ বিদায়ি বছর যে নতুন বছরের উন্মেষ ঘটিয়েছে, আভাস দিয়েছে, সেই বছরটি হবে আরো সংঘাতময়। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বরিস-ট্রাম্প আঁতাত নতুন সমস্যার সৃষ্টি করবে। ইসলামী জঙ্গিরা পুনর্গঠিত হয়েছে। ভারতে হিন্দুত্ববাদী পুঁজিবাদের দানব মাথা তুলেছে। তা বাংলাদেশের জন্য বিপজ্জনক। বাংলাদেশে গণতন্ত্রের স্বার্থে আওয়ামী লীগকে একটি শক্তিশালী সংগঠনে পরিণত করা উচিত। এ অধিবেশনে তা হয়নি। দেশের ছাত্ররাজনীতিতে হিংসা, রাজনীতিক, মন্ত্রী, এমপিদের মধ্যে দুর্নীতির প্রাবল্য রোখা ইত্যাদি ব্যাপারে শেখ হাসিনার ভাষণে জাতিকে উদ্দীপ্ত করার এবং ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জগুলো তিনি কিভাবে মোকাবেলা করবেন তার কোনো সুস্পষ্ট কথা নেই। শুধু দেশের উন্নয়নের কথা বারবার বলা এবং দলের মন্ত্রী-এমপিদেরও বারবার সাবধান করা দিয়ে তিনি দেশের যুবচিত্তকে উৎসাহী ও সংগ্রামী করে তুলতে পারবেন না। সাধারণত শেখ হাসিনার ভাষণে দেশ ও জাতির জন্য উৎসাহী হওয়ার, প্রতিটি সংকট মোকাবেলা করার, সাম্প্রদায়িকতাকে রুখে দাঁড়ানোর আহ্বান ও প্রেরণা থাকে। আমার ধারণা, এবারের আওয়ামী লীগ অধিবেশনে তাঁর ভাষণে সেই আবেগ ও উদ্দীপনা ছিল অনুপস্থিত।

আমার এই লেখায় ২০২০ সাল তথা মুজিববর্ষকে স্বাগত জানাচ্ছি। শুধু জানি না, এই নতুন বছরেও আমাদের কি নতুন চ্যালেঞ্জের মোকাবেলা করতে হবে।

লন্ডন, সোমবার, ৩০ ডিসেম্বর ২০১৯

শেয়ার করুন

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে