সামাজিক মূল্যবোধ ও মানবাধিকার : তরুণের ভূমিকা

ড. সৈয়দ আনোয়ার হোসেন

ড. সৈয়দ আনোয়ার হোসেন
ড. সৈয়দ আনোয়ার হোসেন

প্রস্তাবিত আলোচ্য বিষয়টির তিনটি মাত্রা লক্ষণীয়—সামাজিক মূল্যবোধ, মানবাধিকার ও তরুণের ভূমিকা। উল্লেখ্য, মাত্রা তিনটি পরস্পর সন্নিহিত হলেও মৌল বক্তব্য মানবাধিকার সংরক্ষণ-সম্প্রসারণে তরুণের ভূমিকা। এমন একটি বিষয় নির্ধারণে ক্রিয়াশীল চেতনাটি হলো, তারুণ্য মানবজীবনে সাহসী-উদ্যমী সৃজনশীলতার পর্ব; পর্বটি স্বপ্নেরও বটে। এ কারণে ইতিহাস বলে, তারুণ্য অদল-বদল করা তাবৎ ঘটনার অনুঘটক হিসেবে ভূমিকা রেখেছে। সুতরাং মানবাধিকার আমাদের সমাজে ব্যাপৃত করার ক্ষেত্রে তরুণ প্রজন্মকে সম্পৃক্ত করা হোক—এমন প্রস্তাবনা যৌক্তিকভাবে কাঙ্ক্ষিত। মানুষের জন্ম, যাপিত জীবন ও লোকান্তরণ—সব কিছু তার তৈরি করা সমাজ নামের একটি প্রতিষ্ঠানের চৌহদ্দিতে। সমাজের বাইরে কোনো মানুষই নয়। এমনকি সভ্যতাপূর্ব গুহাবাসী মানুষেরও আদিম এক সমাজ বা কওম ছিল। উল্লেখ্য, কওম বলি আর সমাজ বলি তার পরিচালন নির্ভর করেছে বা করে মানুষের সম্মিলিত সিদ্ধান্তভিত্তিক সামগ্রিক স্বার্থ রক্ষার কিছু নিয়ম-নীতি, রীতি-নীতি ও বিধি-বিধানের ওপর; যাকে বলা হয় মূল্যবোধ। এই মূল্যবোধ সম্পর্কে দুটি কথা আছে। এক. মূল্যবোধ ব্যক্তি নয়, সমাজের সামগ্রিক স্বার্থে। ব্যক্তির চেয়ে বড় সমাজ, আর যে সমাজে সামগ্রিক স্বার্থের অগ্রাধিকার, সেই সমাজ সামগ্রিক কল্যাণধর্মী। দুই. সামগ্রিক দ্যোতনার কারণে মূল্যবোধ মানবকল্যাণ নিশ্চিত করে। আর এ জন্যই মূল্যবোধ সংরক্ষণে আমরা নিয়ত উচাটন। অন্যদিকে সামাজিক ব্যত্যয়-বিচ্যুতির কারণ হিসেবে আমরা নির্দেশ করি মূল্যবোধের অবক্ষয়কে। উল্লেখ্য, মূল্যবোধ অবক্ষয়িত সমাজকে জীবনানন্দ দাশ তুলনা করেছেন ‘অদ্ভুত এক আঁধারের’ সঙ্গে; আর ইংরেজ কবি ইয়েটসের পঙিক্ততে যা—Things fall apart/ Centre cannot hold.

উল্লেখ্য, দুই ভিনদেশি কবির আক্ষেপ অভিন্ন এবং তা মূল্যবোধের অবক্ষয় বা বিকৃতির কারণে বেসামাল সমাজ। সুতরাং মূল্যবোধ-অবক্ষয়িত সমাজ বিশৃঙ্খল-বেসামাল, যা অনাকাঙ্ক্ষিত। কিন্তু প্রসঙ্গক্রমে আমরা বাংলাদেশের সামাজিক চালচিত্রকে কী বলব? এখন এই সমাজ নিয়ে কথা বলতে গেলে কী জীবনানন্দ বা ইয়েটস প্রাসঙ্গিক হন না? কেন এমন হলো তা নিয়ে বিস্তৃত কোনো বয়ানের প্রয়োজন এই মুহূর্তে অপ্রাসঙ্গিক। তবু এটুকু বলতে হবে যে কাঠামোগত না হলেও অন্তত চরিত্র-বৈশিষ্ট্যগত পরিবর্তন আশু প্রয়োজন এবং যে ক্ষেত্রে আদর্শপ্রাণিত, সাহসী-উদ্যমী তারুণ্য একান্ত প্রয়োজন।

সামাজিক মূল্যবোধ ব্যষ্টি-সমষ্টির সৃষ্টি। ব্যক্তি-ব্যষ্টির সৃষ্টি কালের আবর্তন-বিবর্তনে সামষ্টিক হয়। যেমন—ধরা যাক একজন ফরাসি দার্শনিক ভলতেয়ারের কথা। তাঁর মুখনিঃসৃত শাশ্বত বাণী ছিল—‘তুমি যা বলো আমি তা ঘৃণা করি; কিন্তু তোমার তা বলার অধিকারকে আমি প্রাণ দিয়ে হলেও রক্ষা করব।’ এমন বাণী উদারবাদের ভিত্তি, এমন বাণী শুধু মূল্যবোধের কথা নয়, সামাজিক-রাজনৈতিক গণতন্ত্রের দিগ্দর্শনও বটে। তুলনীয় বঙ্গবন্ধুর উক্তি যে ‘একজন মানুষও ন্যায্য কথা বললে তার কথা শুনতে হবে।’

মানবাধিকারের ধারণা উৎসগতভাবে সামাজিক মূল্যবোধ উৎসারিত আন্তর্মানবীয় ব্যাপার। ১৯৪৮ সালের ১০ ডিসেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে ২১৭-এ (III) প্রস্তাব অনুযায়ী মানবাধিকারের বিশ্বজনীন ঘোষণা গৃহীত হয়, যা আজ পর্যন্ত ৫০০টি ভাষায় অনূদিত হয়েছে। তবে ১৯৪৮-এর এই মানবাধিকার ঘোষণার পেছনের কিছু ইতিহাস আছে, যা মানবাধিকারসংক্রান্ত মানবিক চেতনার দীর্ঘ পটভূমি নির্দেশ করে। পশ্চিম দুনিয়ার বইপত্রে উল্লেখ না থাকলেও এটা ভেবে নেওয়া অযৌক্তিক হবে না যে মানবাধিকারের প্রাথমিক দলিল মহানবী (সা.)-এর মদিনা সনদ (৬২২) এবং বিদায় হজের ভাষণ (৬৩২)। পশ্চিম দুনিয়ায় ইংরেজ জন লক সতেরো শতকে মানুষের তিনটি মৌল অধিকার নির্দেশ করেছিলেন :

‘Life, liberty and estate (property).’ ১৬৮৯-এ ইংরেজদের Bill of Rights ও মানবাধিকারের দলিল। ১৭৭৬-এ মার্কিন স্বাধীনতার ঘোষণায় বলা হলো : ‘ We hold these truths to be self-evident, that all men are created equal, that they are endowed by their Creator with certain unalienable rights, that among these are Life, Liberty and the pursuit of Happiness.’ ১৭৯১-তে ফরাসি বিপ্লবোত্তর সংবিধান সভা ঘোষণা করেছিল—

Rights of Man and the Citizen। ১৮-১৯ শতকে দার্শনিক টমাস পেইন, জন স্টুয়ার্ট মিল ও হেগেল মানবাধিকারের ধারণা বিস্তৃত করেন। ১৮৩১-এ উইলিয়াম লয়েড গ্যারিসন The Liberator সংবাদপত্রে প্রকাশিত একটি নিবন্ধে পাঠকের সমর্থন কামনা করলেন— ‘In the great cause of human rights.’ এরপরই প্রকাশিত হয়েছিল পেইনের The Rights of Man। সম্ভবত এই সময়ে human rights-সংক্রান্ত ধারণা পশ্চিম দুনিয়ায় চালু হয়। ১৮৪৯-এ মার্কিন দার্শনিক হেনরি ডেভিড থোরো তাঁর On the Duty of Civil Disobedience বইতে মানবাধিকার নিয়ে বিস্তৃত আলোচনা করেন। ১৯৪১-এর ৬ জানুয়ারি কংগ্রেসে প্রদত্ত একটি ভাষণে প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট চারটি মানবাধিকারের ওপর ভিত্তি করে ভবিষ্যৎ বিশ্ব কল্পনা করেছিলেন, যা ছিল freedom of speech, freedom of every person to worship God in his own way, freedom from want and freedom from fear. এই চারটি অধিকারকে তিনি বলেছিলেন ‘four essential freedoms.’ জাতিসংঘ মানবাধিকার ঘোষণার ভূমিকা শুরু হয়েছে এভাবে : ‘Whereas recognition of the inherent dignity and of equal and inalienable rights of all members of the human family is the foundation of freedom, justice and peace in the world.’ লক্ষণীয়, এখানে মানবাধিকারকে বিশ্বশান্তির পূর্বশর্ত হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। সংগত কারণে এলেনর রুজভেল্ট মন্তব্য করেছিলেন, ‘It is not a treaty… [in the future, it] may well become the international Magna Carta.’ হয়েছেও তাই; আর আমরা প্রতিবছর ১০ ডিসেম্বর মানবাধিকার নিয়ে উচ্চকণ্ঠ হই। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ১০ এপ্রিল ১৯৭১, মুজিবনগর সরকার তার স্বাধীনতার প্রচারপত্রে উল্লেখ করেছিল সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচারের কথা।

এখন প্রসঙ্গ হলো, মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় বা মানবিক বাংলাদেশ গড়ার কাজে বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্মের ভূমিকা কী? বাংলাদেশের যুবনীতি অনুযায়ী ১৮ থেকে ৩৫ বছর যুবক বা তরুণের বয়ঃসীমা। সমগ্র জনসংখ্যার প্রেক্ষাপটে এমন বয়সীদের অনুপাত প্রায় ৪৭ শতাংশ। এদের সম্পৃক্ত না করে মানবাধিকার কেন, জাতীয় কোনো প্রকল্পই চিন্তা করা যায় না। ’৭১-পূর্ব আমাদের স্বাধীনতাসংগ্রামের প্রতিটি পর্বে তরুণরাই ছিল অনুঘটক; আর মুক্তিযোদ্ধার বেশির ভাগ তো ছিল তারাই। বঙ্গবন্ধু ২৯ বছর বয়সে যুগ্ম সম্পাদক, ৩৩ বছরে সাধারণ সম্পাদক; আর ৪৬ বছরে সভাপতি ও বাঙালির ম্যাগনাকার্টা ছয় দফা প্রদানকারী। আরো উল্লেখ্য, বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা মূলত তরুণদের অবদান।

বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটেও তারুণ্যের জয়গান প্রতুল। ইংরেজ রাজনীতিক বেনইয়ামিন ডিজরেইলি বলতে বাধ্য হয়েছিলেন, ‘Almost everything that is great has been done by youth.’ ইতালি একত্রীকরণের জনক ম্যাৎসিনি স্বীকার করেছিলেন, ‘Put the young men at the head a movement, and you know not their strength.’ বিশ্বের তাবৎ ভালো কাজের বেশির ভাগ তারুণ্যের অবদান; আন্দোলন-সংগ্রামেও তারা অগ্রবর্তী। ১৭৫৬-তে বড় পিট ২৮ বছর বয়সে ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী হয়ে কমনস সভায় বলেছিলেন, ‘ও know I can save the nation.’ আসলেই তাঁর নেতৃত্বে ফ্রান্সের কাছে প্রায় হেরে যাওয়া ইংরেজ জাতি সাত বছরের যুদ্ধে (১৭৫৬-৬৩) জয়ী হয়েছিল। মার্কিন সংবিধান প্রণেতাদের গড় বয়স ছিল ৩৩। বঙ্গবন্ধু ৪১ বছর বয়সে ১৯৬১-তে কমরেড মণি সিংহ ও কমরেড খোকা রায়কে বলেছিলেন, বাঙালির স্বাধীনতা চাই।

সুতরাং তারুণ্যের জয়গান সর্বত্র। কিন্তু এই মুহূর্তে বাংলাদেশের তারুণ্য নিয়ে আমাদের অনুভূতি মিশ্র। তবে তারুণ্যের মধ্যে যা কিছু নেতি তার কারণ নেতৃত্ব ও দিকনির্দেশনার ঘাটতি। নেতৃত্ব ও দিকনির্দেশনার খোলনলচে না পাল্টালে তরুণের অপচয়িত-অবক্ষয়িত দশা কাটবে না। মানবাধিকারের ক্ষেত্রে তারুণ্যের ভূমিকা নিশ্চিত করতে হলে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনকে উদ্দীপক-উজ্জীবক ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে হবে এবং তা মাঠপর্যায়ের নানামুখী কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে। অর্থাৎ প্রতিষ্ঠানটিকে নেতৃত্ব ও দিকনির্দেশকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে হবে।

লেখক : বঙ্গবন্ধু চেয়ার অধ্যাপক, বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালস (বিইউপি)

শেয়ার করুন

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে