নির্ধারিত সময়ের আগেই উৎপাদনে ‘পায়রা’

মত ও পথ প্রতিবেদক

পায়রা তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্র
ফাইল ছবি

দেশের সর্ববৃহৎ এবং সর্বাধুনিক বিদ্যুৎকেন্দ্র ‘পায়রা’ সরকারের বেঁধে দেয়া সময়ের আগেই উৎপাদন শুরু করেছে। ১৩২০ মেগাওয়াট কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রটি জাতীয় গ্রিডের সঙ্গে সংযুক্ত (সিনক্রোনাইজিং) হয়েছে। বাংলাদেশ ও চীনের যৌথ বিনিয়োগে তৈরি এ কেন্দ্র থেকে এরিমধ্যে ১০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হয়েছে।

নির্ধারিত সময়ের আগে এই প্রযুক্তিতে উৎপাদনে গিয়ে বিশ্বে অনন্য নজির সৃষ্টি করেছে পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলার ধানখালী ইউনিয়নে নির্মিত এই পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্র।

সংশ্লিষ্টরা জানান, পৃথিবীতে এ ধরনের উন্নত প্রযুক্তির বিদ্যুৎকেন্দ্রের নির্মাণকাজ সাধারণত ১০ বছরের আগে শেষ হওয়ার নজির নেই। কিন্তু বাংলাদেশে মাত্র পাঁচ বছরের মধ্যেই এর নির্মাণকাজ শেষ হয়েছে।

জানা গেছে, আগামী ২৭ জানুয়ারি কেন্দ্রটি প্রথম ইউনিটের ৬৬০ মেগাওয়াট পূর্ণ ক্ষমতায় চালানো হবে। এছাড়া ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির সমান দ্বিতীয় ইউনিট উৎপাদন শুরু করবে আগামী মে মাসে। এই বিদ্যুৎকেন্দ্রে উৎপাদিত বিদ্যুতের জ্বালানি হচ্ছে আমদানি করা কয়লা। এরই মধ্যে ইন্দোনেশিয়া থেকে কয়লা দেশে ভিড়েছে।

বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় জানায়, প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ে বিদ্যুৎকেন্দ্রটি উদ্বোধনের তারিখ চেয়ে অবহিত করা হয়েছে। তারিখ চূড়ান্ত হলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এটি উদ্বোধন করবেন। এর আগেও পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্র এলাকায় ক্ষতিগ্রস্থদের জন্য নির্মিত আবাসন প্রকল্প উদ্বোধন করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী।

প্রাথমিকভাবে পায়রা কয়লা ভিত্তিক তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্র সম্প্রতি পরীক্ষামূলকভাবে উৎপাদন শুরুর পাশাপাশি জাতীয় গ্রীডে বিদ্যুৎ সরবরাহ করেছে। প্রায় ১৩৬ কিলোমিটার দীর্ঘ ডবল সার্কিটের হাই ভোল্টেজ লাইনটি পটুয়াখালীর কলাপাড়ার পায়রা তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে পটুয়াখালী সদর হয়ে গোপালগঞ্জ জেলার মকসুদপুর উপজেলায় নবনির্মিত ৪০০/২৩০ কেভি গ্রিড উপকেন্দ্রে যুক্ত হয়।

প্রকল্প পরিচালক শাহ আব্দুল মাওলা বলেন,  ১৩ জানুয়ারি কেন্দ্রের প্রথম ইউনিট চালানো হয়েছে। শুরুতে ৬০ মেগাওয়াট উৎপাদন হলেও ধীরে ধীরে উৎপাদন বৃদ্ধি করা হয়েছে। সারাদিনে ১২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়েছে। এর মধ্যে কেন্দ্রটির নিজস্ব ব্যবহার বাদে ১০০ মেগাওয়াট জাতীয় গ্রিডে সরবরাহ করা হয়েছে।

তিনি বলেন, ক্রমান্বয়ে উৎপাদন বৃদ্ধি করা হবে। প্রতিদিন অল্প অল্প করে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হবে। এরপর বাড়ানো হবে। পাশাপাশি যন্ত্রপাতিগুলোও চলবে এই মাসজুড়েই। আমরা আশা করছি, আগামী ২৭ জানুয়ারি গ্রিডে আমরা ৬৬০ মেগাওয়াটই সরবরাহ করতে পারব। এ জন্য অনেক ধরনের পরীক্ষা এবং পর্যবেক্ষণ রয়েছে। আশা করছি, আগামী মাস ফেব্রুয়ারির শেষ দিকে আমরা কেন্দ্রটির প্রাথমিক বাণিজ্যিক অপারেশনের দিন নির্ধারণ করতে পারব।

প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা জানান, তিন বছর নয় মাস ২৩ দিন পেরিয়ে ১৩ জানুয়ারি আসে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। প্রায় ১০ হাজার চীন এবং বাংলাদেশী শ্রমিক ও প্রকৌশলীর দিন রাত অক্লান্ত পরিশ্রম। ২ দশমিক চার বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগে নতুন এক ইতিহাসের সূচনাকে দেশের বিদ্যুৎ খাতের অন্যতম বড় অর্জন বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

কেন্দ্রটির সমান অংশিদার চীন এবং বাংলাদেশ। চীনের এক্সিম ব্যাংকের আর্থিক সহায়তায় কেন্দ্রটি নির্মাণ করা হয়েছে। সরকার যেসব মেগা প্রকল্প নির্মাণ করছে তার মধ্যে পায়রা অন্যতম।

এর আগে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিদ্যুৎকেন্দ্রটি সর্ম্পকে বলেছিলেন, কেন্দ্রটি উৎপাদনে আসলে অন্তত এক হাজার ৩০০ মেগাওয়াট তেলচালিত বিদ্যুত কেন্দ্রর উৎপাদন কমানো যাবে। এতে করে বিদ্যুৎ খাতে বিপুল পরিমাণ অর্থ সাশ্রয় হবে।

এখন তেলচালিত বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মধ্যে ফার্নেস তেলে প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ ১৩ শমিক ৬২ টাকা এবং ডিজেলে ২৭দশমিক ২১ টাকায় উৎপাদন করা হয়। এর বিপরীতে পায়রার উৎপাদন খরচ থাকবে সাড়ে ৬ টাকার নিচে। ফলে প্রতি বছর বিদ্যুৎ খাতে বিপুল পরিমাণ সাশ্রয় হবে।

প্রসঙ্গত, সরকার প্রথম মেয়াদে দায়িত্ব নেয়ার পর বিদ্যুতের নিরবচ্ছিন্ন উৎপাদনের সঙ্গে ব্যয় সাশ্রয়ের উদ্যোগ নেয়। এজন্য বিদ্যুৎ উৎপাদনে মিশ্র জ্বালানি ব্যবহারের উদ্যোগ নেয়। সেই উদ্যোগের প্রথম বাস্তবায়ন হলো পায়রা বিদ্যুৎ কেন্দ্র। কেন্দ্রটি নির্মাণে ব্যবহার করা হচ্ছে বিসিপিসিএল সর্বাধুনিক আল্ট্রাসুপার ক্রিটিক্যাল প্রযুক্তি।

দেশের দক্ষিণ-পশ্চিম এবং উত্তরাঞ্চলের বিদ্যুৎকেন্দ্র দিয়ে মধ্যভাগের চাহিদা মেটানোর জন্য বিদ্যুৎ সঞ্চালনে এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ করা হচ্ছে। পায়রা-রামপাল-রূপপুরের বিদ্যুৎ নেয়া হবে গোপালগঞ্জে। সেখান থেকে ঢাকাতে বিদ্যুত সঞ্চালন করা হবে। জিরো লোডশেডিং আওয়ার বা নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য এই মেগা প্রকল্পটির কাজ শুরু করেছে।

গত ২০১৪ সালের ৯ জুন চীনের ন্যাশনাল মেশিনারি এক্সপোর্ট এন্ড ইমপোর্ট করপোরেশন (সিএমসি) এর সঙ্গে রাষ্ট্রীয় নর্থ ওয়েস্ট পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি (এনডব্লিউপিজিসিএল) বাংলাদেশে একটি ১৩২০  মেগাওয়াট ক্ষমতার তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের জন্য সমঝোতা স্মারক সই করে।

এরপর সমঝোতা স্মারক, যৌথ মূলধনী কোম্পানি গঠন আর ক্রোড়পত্র আহ্বানের পর ২০১৬ সালের ৩০ মার্চ কেন্দ্রটির নির্মাণকাজ শুরু হয়। চীনের আরেক প্রতিষ্ঠান এনইপিসি কেন্দ্রটির ঠিকাদার নিযুক্ত হয়। বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির আর্থিক সংস্থানের আগেই ঠিকাদারকে ২০ ভাগ অর্থ ব্যয়ের শর্ত দেয়া হয়।

এতে করে বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির চুক্তি সইয়ের পরের দিন থেকেই কেন্দ্র নির্মাণ শুরু করে এনইপিসি। যাতে কেন্দ্রটির কাজ দ্রুততার সাথে শেষ হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। এই প্রকল্পের সম্পূর্ণ নির্মাণকাজ শেষ হওয়ার কথা রয়েছে ২০২২ সালে।

শেয়ার করুন

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে