শেয়ারবাজারে বড় ধরনের উত্থান

মত ও পথ প্রতিবেদক

শেয়ারবাজার
শেয়ারবাজার

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উদ্যোগ নেয়ার পর দেশের শেয়ারবাজারে বড় ধরনের উত্থান হয়েছে। আজ রোববার প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) এবং অপর শেয়ারবাজার চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জে (সিএসই) লেনদেনে অংশ নেয়া প্রায় সবকটি প্রতিষ্ঠানের শেয়ার ও ইউনিটের দাম বেড়েছে। ফলে সাত বছরের মধ্যে মূল্য সূচকের সবচেয়ে বড় উত্থান হয়েছে রোববার। এতে একদিনেই ১৫ হাজার কোটি টাকার ওপর বাজার মূলধন ফিরে পেয়েছে ডিএসই। প্রধান মূল্য সূচক বেড়েছে সাড়ে ৫ শতাংশের ওপর।

বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শেয়ারবাজার নিয়ে প্রধানমন্ত্রী উদ্যোগ নেয়ায় বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আস্থা বেড়েছে। বিনিয়োগকারীরা বিশ্বাস করেন, সরকার শেয়ারবাজার ভালো করতে আন্তরিক। তারই প্রতিফল দেখা যাচ্ছে শেয়ারবাজারে। তাছাড়া বড় ধরনের ধসের কারণে ভালো ভালো কোম্পানির শেয়ার দাম অনেক কমে গেছে। এখন এসব প্রতিষ্ঠানের শেয়ারের দাম বাড়বে এটাই স্বাভাবিক।

তারা বলছেন, এখন যেহেতু শেয়ারবাজার পতন কাটিয়ে উঠছে তাই বিনিয়োগকারীদের সতর্কতার সঙ্গে বিনিয়োগ করতে হবে। হুজুগে বা গুজবে বিনিয়োগ করা উচিত হবে না। কোনোভাবেই বিনিয়োগকারীদের প্যানিক সেল (হুজুগে বিক্রি) করা যাবে না। আবার গুজবে পড়ে অতিরিক্ত লাভের আশায় দুর্বল কোম্পানির শেয়ারে বিনিয়োগ করা ঠিক হবে না। বিনিয়োগকারীদের ভালো কোম্পানি বাছাই করে মৌলভিত্তিসম্পন্ন কোম্পানিতে বিনিয়োগ করতে হবে।

বাজার পর্যালোচনায় দেখা যায়, গত সপ্তাহের শেষ কার্যদিবস বৃহস্পতিবার লেনদেন শেষে ডিএসইর বাজার মূলধন ছিল ৩ লাখ ১৯ হাজার ৩৭০ কোটি টাকা, যা রোববারের লেনদেন শেষে দাঁড়িয়েছে ৩ লাখ ৩৪ হাজার ৫৫৬ কোটি টাকা। অর্থাৎ একদিনেই ডিএসই’র বাজার মূলধন বেড়েছে ১৫ হাজার ১৮৬ কোটি টাকা। মূলধন বাড়ার অর্থ হলো তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর শেয়ারের দাম সম্মিলিতভাবে ওই পরিমাণ বেড়েছে।

বড় অংকের বাজার মূলধন বাড়ার পাশাপাশি সবকটি মূল্য সূচকের বড় উত্থান হয়েছে। সূচকের এ উত্থানে প্রধান ভূমিকা রেখেছে শেয়ারবাজারের বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর নেয়া উদ্যোগ। শেয়ারবাজারে বড় ধরনের ধসের পরিপ্রেক্ষিতে গত বৃহস্পতিবার (১৬ জানুয়ারি) শেয়ারবাজারের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের সঙ্গে নিজ কার্যালয়ে বৈঠক করেন প্রধানমন্ত্রী। সেইসঙ্গে শেয়ারবাজার উন্নয়নে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদী বেশ কিছু পদক্ষেপ নেয়ার ঘোষণা দেয়া হয় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের তরফ থেকে।

প্রধানমন্ত্রীর বৈঠকের পর রাষ্ট্রায়ত্ত চার ব্যাংকের পক্ষ থেকে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ বাড়ানোর ঘোষণা দেয়া হয়। আর বিএসইসি থেকে বিজ্ঞপ্তি দিয়ে জানানো হয়, শেয়ারবাজার উন্নয়নে সরকার অত্যন্ত আন্তরিক। শেয়ারবাজার উন্নয়নের জন্য যে ধরনের সাহায্য প্রয়োজন সরকার ধারাবাহিকভাবে তা করে যাবে। সভায় স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদী বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। স্বল্পমেয়াদী কিছু পদক্ষেপ অচিরেই কীভাবে বাস্তবায়ন করা যায়, তার জন্য মতামত দেয়া হয়েছে।

এর মধ্যে রয়েছে- শেয়ারবাজারে ব্যাংক ও ব্যাংক বহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানের অংশগ্রহণ বাড়ানো, মার্চেন্ট ব্যাংকার ও প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের জন্য সহজ শর্তে ঋণ সুবিধা পর্যালোচনা করা, আইসিবি’র বিনিয়োগ সক্ষমতা বাড়ানো, বাজারে আস্থা বাড়াতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া এবং বাজারে মানসম্পন্ন আইপিও বাড়াতে বহুজাতিক ও সরকারি মালিকানাধীন কোম্পানি তালিকাভুক্ত করার উদ্যোগ নেয়া। এ বিষয়ে সরকারের উচ্চ পর্যায় যথাযথ ব্যবস্থা নেবে।

এমন ঘোষণার পর রোববার ছিল শেয়ারবাজারের প্রথম কার্যদিবস। এদিন লেনদেনের শুরুতেই সূচকের বড় ধরনের উত্থান ঘটে। মাত্র দুই মিনিটের লেনদেন ডিএসই’র প্রধান মূল্য সূচক ৮০ পয়েন্ট বেড়ে যায়। লেনদেনের সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে বাড়তে থাকে সূচকের উত্থান প্রবণতা। ১০ মিনিটের লেনদেনে ডিএসই’র প্রধান মূল সূচক বাড়ে ১৩৫ পয়েন্ট। আর লেনদেনের এক ঘণ্টার মধ্যে সূচক দুই’শ পয়েন্টের ওপরে বেড়ে যায়।

সূচকের এই উল্লম্ফন চলে লেনদেনের শেষ পর্যন্ত । ফলে দিনের লেনদেন শেষে ডিএসই’র প্রধান মূল্য সূচক আগের দিনের তুলনায় ২৩২ পয়েন্ট বেড়ে ৪ হাজার ৩৮২ পয়েন্টে দাঁড়ায়। ২০১৩ সালের জানুয়ারিতে এই সূচক চালু হওয়ার পর একদিনে প্রধান মূল্য সূচকের এত বড় উত্থান আর হয়নি। অপর দুই সূচকের মধ্যে ডিএসই-৩০ সূচক ৮০ পয়েন্ট বেড়ে ১ হাজার ৪৮৭ পয়েন্টে উঠে আসে। আর ডিএসই’র শরিয়াহ্ সূচক ৫৭ পয়েন্ট বেড়ে ৯৯৭ পয়েন্টে দাঁড়ায়।

সূচক এমন হু হু করে বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রায় সবকটি প্রতিষ্ঠানের শেয়ারের দামও হু হু করে বাড়তে থাকে। এতে দফায় দফায় দাম বাড়িয়েও অনেক কোম্পানির শেয়ার কিনতে পারেননি বিনিয়োগকারীরা। দাম বাড়ার সীমার সর্বোচ্চ পর্যায়ে চলে যায় প্রায় অর্ধশত কোম্পানি। এছাড়া আরও প্রায় অর্ধশত প্রতিষ্ঠানের শেয়ার দাম বাড়ার সর্বোচ্চ পর্যায়ের কাছাকাছি চলে আসে।

এদিন এক শতাংশের ওপরে দাম বেড়েছে ৩৩৬টি প্রতিষ্ঠানের শেয়ার ও ইউনিট। এর মধ্যে ৩২৭টির দাম বেড়েছে ২ শতাংশের ওপরে। ৪ শতাংশের ওপরে দাম বাড়ার তালিকায় রয়েছে ২৫৯টি। ৫ শতাংশের ওপরে দাম বাড়ার তালিকায় রয়েছে ২১৬টি। ১৭৭টি প্রতিষ্ঠানের শেয়ার ও ইউনিটের দাম বেড়েছে ৬ শতাংশের ওপরে। আর ৯ শতাংশের ওপরে দাম বেড়েছে ৫১টির।

এমন দাম বাড়িয়েও অনেক বিনিয়োগকারী কিছু প্রতিষ্ঠানের শেয়ার কিনতে পারেননি। যাদের কাছে এসব প্রতিষ্ঠানের শেয়ার আছে তারা বিক্রি করতে চাচ্ছেন না। অথচ কিছুদিন আগেই এসব প্রতিষ্ঠানের শেয়ার ৮-৯ শতাংশ দাম কমিয়েও বিক্রি করা যাচ্ছিল না।

গত ৫ জানুয়ারি থেকে ১৪ জানুয়ারি পর্যন্ত দেশের শেয়ারবাজারে বড় ধরনের দরপতন ঘটে। এ সময়ে লেনদেন হওয়া ৮ কার্যদিবসের মধ্যে ৭ কার্যদিবসেই বড় পতন হয়। এতে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের প্রধান মূল্য সূচক ৪২৩ পয়েন্ট কমে যায়। তখন রাস্তায়ও নামেন বিনিয়োগকারীরা । এর প্রেক্ষিতেই শেয়ারবাজারের বিষয়ে হস্তক্ষেপ করেন প্রধানমন্ত্রী।

এদিকে ক্রেতা সংকট থেকে বিক্রেতা সংকটে পড়া শেয়ারবাজারে লেনদেন খরাও কিছুটা কেটেছে। মাসের অধিক সময় ধরে দুই’শ থেকে তিন’শ কোটি টাকার ঘরে ঘুরপাক খাওয়া ডিএসইর লেনদেন রোববার হয়েছে ৪১১ কোটি ৩৬ লাখ টাকা। যা আগের দিন ছিল ২৬৭ কোটি ৪৯ পয়সা। এ হিসেবে লেনদেন বেড়েছে ১৪৩ কোটি ৮৭ লাখ টাকা।

অপর শেয়ারবাজার চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের সার্বিক মূল্য সূচক সিএএসপিআই ৬৭৭ পয়েন্ট বেড়ে ১৩ হাজার ২৭৭ পয়েন্টে উঠে এসেছে। বাজারটিতে লেনদেন হয়েছে ৪৩ কোটি ৬৮ লাখ টাকা। লেনদেনে অংশ নেয়া ২৫৭টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ২৩১টির শেয়ার ও ইউনিটের দাম বেড়েছে। বিপরীতে দাম কমেছে ১৫টির, আর ১১টির দাম অপরিবর্তিত রয়েছে।

এ বিষয়ে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের পরিচালক মিনহাজ মান্নান ইমন বলেন, প্রধানমন্ত্রীর উদ্যোগের ফলে বাজারের ওপর বিনিয়োগকারীদের আস্থা বেড়েছে। বিনিয়োগকারীরা বিশ্বাস করেন প্রধানমন্ত্রী যে আশ্বাস দিয়েছেন তা বাস্তবায়ন করবেন। তারই প্রতিফল শেয়ারবাজারে দেখা যাচ্ছে। তাছাড়া বড় দরপতনের কারণে ভালো কোম্পানির শেয়ারের দাম অনেক কমে গেছে। এ পরিস্থিতিতে বড় উত্থান হওয়া স্বাভাবিক। আমরা বিশ্বাস করি বাজার সামনে আরও ভালো হবে।

তিনি বলেন, বাজার যখন ঊর্ধ্বমুখী থাকে তখন বাজারে গুজব ছড়িয়ে দুর্বল কোম্পানির শেয়ারের দাম বাড়ানোর একটি প্রবণতা থাকে। বিনিয়োগকারীদের এ বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে। দুর্বল কোম্পানি এড়িয়ে মৌলভিত্তির কোম্পানিতে বিনিয়োগ করতে হবে। সেইসঙ্গে প্যানিক সেল দেয়া যাবে না। ভালো শেয়ারে বিনিয়োগ করে ধরে রাখতে হবে।

শেয়ার করুন

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে