ঢাকা সিটি নির্বাচনে কম ভোটের ৫ কারণ

মত ও পথ প্রতিবেদক

ডিএনসিসি-ডিএসসিসি
ফাইল ছবি

ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন নির্বাচনে কম ভোট পড়ার বিষয়টি নিয়ে নানা মহলে আলোচনা চলছে। নির্বাচন কমিশনের তথ্য অনুসারে গত শনিবার অনুষ্ঠিত নির্বাচনে ঢাকা উত্তর সিটিতে মেয়র পদে ভোট পড়েছে ২৫.৩০ শতাংশ, আর দক্ষিণে পড়েছে ২৯ শতাংশ। কম ভোট পড়ার পেছনে বিশেষজ্ঞরা অন্তত পাঁচটি কারণ চিহ্নিত করেছেন।

এর আগে গত ১৩ জানুয়ারি জাতীয় সংসদের চট্টগ্রাম-৮ আসনের উপনির্বাচনে ভোটের হার ছিল ২২.৯৪ শতাংশ।

বিশেষজ্ঞরা চট্টগ্রাম-৮ আসনের উপনির্বাচনের ভোটের হারের সঙ্গে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের নির্বাচনের ভোটের হারকে তুলনা করতে চান না। তাঁদের কাছে জাতীয় সংসদের একটি উপনির্বাচনের তুলনায় রাজধানী ঢাকার দুই সিটির সাধারণ নির্বাচনের গুরুত্ব অনেকে বেশি। এ গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচনে কেন কম ভোট পড়ল, সেটিই তাঁদের কাছে এখন বিশ্লেষণের বিষয়।

বিশেষজ্ঞদের মতে, জনপ্রিয় প্রার্থী না থাকা, ইভিএম সম্পর্কে নেতিবাচক প্রচার, তিন দিনের ছুটিতে অনেক ভোটারের ঢাকা ত্যাগ, ভোটের দিন যানবাহন চলাচল বন্ধ থাকা, সহিংসতার আশঙ্কা ও জনমতের প্রতিফলন নিয়ে সংশয়—এ পাঁচ কারণে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ভোট কম পড়েছে।

এ নির্বাচনে মেয়র পদে উত্তরে ৩০ লাখ ১২ হাজার ৫০৯ ভোটারের মধ্যে ছয় প্রার্থীকে ভোট দিয়েছেন সাত লাখ ৬০ হাজার ৮৫১ ভোটার। অর্থাৎ এ সিটিতে ২২ লাখ ৫২ হাজার ৮৫১ ভোটার ভোট দেননি। আর দক্ষিণে ২৪ লাখ ৫৩ হাজার ১৫৯ ভোটারের মধ্যে ভোট দিয়েছেন সাত লাখ ১১ হাজার ৪৮৮ ভোটার। অর্থাৎ ১৭ লাখ ৪১ হাজার ৬৭১ জন ভোটার ভোট দেননি।

বিশেষজ্ঞদের মতে নানা কারণেই ভোটের প্রতি ভোটারদের আগ্রহ কমে যেতে পারে। কেউ বলছেন, ইভিএমে জাল ভোট দেওয়ার সুযোগ থাকে না বা রাতের বেলায় ব্যালট পেপার ছিঁড়ে ব্যালট বাক্স ভরানোর সুযোগ নেই বলে ভোটের হার কম হতে পারে। কিন্তু ইভিএম ভোটে সর্বোচ্চ ৮১.৪০ শতাংশ ভোট পড়ারও নজির আছে। গত ১৩ জানুয়ারি বগুড়ার দুপচাঁচিয়া পৌরসভায় এই পরিমাণ ভোট পড়ে। এ ছাড়া একই দিন পাবনার মালিগাছা ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনে ভোট পড়ে ৭৪.৩২ শতাংশ।

এর আগে ২০১৮ সালে ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে যে ছয়টি আসনে ইভিএমে ভোট হয় তাতে গড়ে ৫১.৪২ শতাংশ ভোট পড়ে। এর মধ্যে চট্টগ্রাম-৯ আসনে ভোট পড়ে ৬২.৮৭ শতাংশ। ঢাকা-৬ আসনে পড়ে ৪৫.২৬ শতাংশ ও ঢাকা-১৩ আসনে পড়ে ৪৩.৭ শতাংশ ভোট।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশে নির্বাচন একটি উৎসবের মতো। কিন্তু প্রার্থীর যদি জনসম্পৃক্ততা না থাকে, প্রার্থীকে যদি ভোটাররা নিজেদের প্রতিনিধি ভাবতে না পরেন তাহলে কেন সেসব প্রার্থীকে নির্বাচিত করার জন্য ভোটকেন্দ্রে আসবেন? সাবেক নির্বাচন কমিশনার মোহাম্মদ আব্দুল মোবারক গণমাধ্যমের সঙ্গে আলাপকালে এ প্রশ্নই রাখেন।

জাতীয় নির্বাচন পর্যবেক্ষক পরিষদ (জানিপপ) প্রধান অধ্যাপক নাজমুল আহসান কলিমুল্লাহ এ ভোটের আগেই গণমাধ্যমকে বলেছিলেন, জাল ভোট দেওয়ার সুযোগ নেই বলে ইভিএমে কম ভোট কাস্ট হলেও আমি অবাক হব না।

কিন্তু এত কম ভোট পড়বে বলে কি ধারণা ছিল আপনার? এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি গণমাধ্যমকে বলেন, আমি বিস্মিত হইনি। কারণ আরো কিছু বিষয় রয়েছে। ভোটের দিনসহ তিন দিন ছুটি ছিল। এ সময় অনেকে ঢাকার বাইরে নিজেদের স্থায়ী ঠিকানায় চলে গেছেন। ঢাকায় ভোটার হলেও তাঁদের স্থায়ী ঠিকানা ঢাকায় নয়। আবার ঢাকার কোনো এলাকার শতভাগ ভোটার সে এলাকায় বসবাস করেন না। বাসা পরিবর্তন করে অন্য এলাকায় চলে যান। ভোটের দিন যানবাহন চলাচল বন্ধ থাকায় তাঁরা তাদের জন্য নির্ধারিত কেন্দ্রে ভোট দিতে আসতে পারেননি। এসব বিষয়গুলো এবারের নির্বাচনে ভোটের হার কমিয়েছে।

নির্বাচন রাজনীতির বা রাজনৈতিক নেতাদের হাতছাড়া হয়ে গেছে বলে মনে করেন নির্বাচনী আইন বিশেষজ্ঞ ড. শাহদীন মালিক। তিনি বলেন, এবার নির্বাচনে বিএনপিসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দল ইভিএমবিরোধী যে প্রচার চালিয়েছে তাতেই এ প্রযুক্তির ওপর ভোটাররা আস্থা রাখতে পারেননি। এ নির্বাচনে জনমতের প্রকৃত প্রতিফলন ঘটার বিষয়েও শঙ্কা ছিল।

এদিকে ওয়ার্ডভিত্তিক ফল বিশ্লেষণ করে জানা যায়, কম ভোটের হার দুই সিটির সব এলাকাতেই প্রায় একই রকম। ঢাকা দক্ষিণের ১ নম্বর ওয়ার্ডে মোট ভোটার ৪৬ হাজার ৯৭৬ জন। এর মধ্যে ভোট দিয়েছেন ১২ হাজার ৩৪৫ জন। অর্থাৎ ২৬ শতাংশের কাছাকাছি ভোটার ভোট দিয়েছেন। ২৭ নম্বর ওয়ার্ডে মোট ভোটার ১৭ হাজার ৯২৮ জন। এর মধ্যে ভোট দিয়েছেন পাঁচ হাজার ৭৬ জন বা ২৮ শতাংশ।

সাধারণ ভোটারদের মধ্যেও ভোট না দিতে যাওয়ার নানা যুক্তি রয়েছে। ঢাকা উত্তর সিটির ৩১ নম্বর ওয়ার্ডের ভোটার আব্দুল আলিম ভোট দিতে কেন যাননি এমন প্রশ্নে জবাবে নিজের যুক্তি তুলে ধরেন। তিনি গণমাধ্যমকে বলেন, নির্বাচনী প্রতিশ্রুতির সময় মেয়র পদপ্রার্থীরা বাস্তবায়নযোগ্য নয়—এমন অনেক প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। এ নিয়ে গণমাধ্যমে সমালোচনা হয়েছে এবং বোঝা গেছে তাঁদের তেমন কিছু করার নেই। শুধু ঢাকার মেয়র নন, অন্য নির্বাচিত জনপ্রতিনিধরাও নির্বাচিত হয়ে গেলে ভোটারদের আর খবর রাখেন না। এ অবস্থায় তাঁদের ভোট দিয়ে আমাদের লাভ কী?

আবার ভোটকেন্দ্রে এসে কাউন্সিলর প্রার্থীদের ভোট দিলেও মেয়র পদে ভোট দেননি এমন ভোটারের সংখ্যা দুই সিটিতে তিন হাজার ৯২ জন। এর মধ্যে ঢাকা উত্তর সিটিতে এক হাজার ৫৩০ জন এবং দক্ষিণে এক হাজার ৫৬২ জন। রিটার্নিং অফিসার স্বাক্ষরিত ফলাফল শিটে এই ভোটারদের ভোট অবৈধ বা বাতিল হিসেবে চিহ্নিত করা আছে। কিন্তু নির্বাচন কমিশন বলে আসছে ইভিএমের ভোটে ভোট বাতিল হওয়ার সুযোগ নেই।

এর পরও কেন ভোট বাতিল হলো জানতে চাইলে নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) শাহাদাত হোসেন চৌধুরী গণমাধ্যমকে বলেন, এ সম্পর্কে খোঁজ নেওয়া হবে।

আর ঢাকা উত্তর সিটির রিটার্নিং অফিসার আবুল কাশেম বলেন, যেসব ভোটার মেয়র পদে কাউকে ভোট দিতে চাননি এবং মেয়র পদের বাটনে দুইবার ক্রস চিহ্নে প্রেস করেছেন, মেয়র পদে তাঁদের ভোট বাতিল বা অবৈধ দেখানো হয়েছে। কাউন্সিলর প্রার্থীদের ক্ষেত্রেও এ ধরনের ফলাফল দেখা যায়।

রিটার্নিং অফিসার আবুল কাশেমের যুক্তি অনুসারে অনেক ভোটার মেয়র পদে ভোট দিয়েছেন; কিন্তু কাউন্সিলর পদে ভোট দেননি। কাউন্সিলর প্রার্থীদের ফলাফল শিটে অনেক ক্ষেত্রে অবৈধ বা বাতিল ভোট লেখা আছে। আবার কিছু ক্ষেত্রে অবৈধ বা শূন্য ভোট লেখা আছে। ফলাফল শিটগুলোও একই ধরনের নয়। ব্যালটের ভোটের ফলাফল শিটই এবার ব্যবহৃত হয়েছে।

শেয়ার করুন

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে