সরকার পূর্বাঞ্চলীয় গ্রিড নেটওয়ার্কের সক্ষমতা বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে। এর অংশ হিসেবে বৃহত্তর কুমিল্লা, নোয়াখালী ও চট্টগ্রাম অঞ্চলের বিদ্যুৎ বিতরণ ও সঞ্চালন ব্যবস্থা শক্তিশালী করতে ৫ হাজার ৮০৩ কোটি টাকার একটি প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। প্রকল্পে বিশ্বব্যাংকের ঋণ সহায়তা হিসেবে পাওয়া যাবে ৩ হাজার ৬৪২ কোটি টাকা।
আর কাজের গুণগত মান নিশ্চিত করতে বিশ্বব্যাংকের চাহিদা অনুযায়ী টেন্ডার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার জন্য প্রকল্প শুরুর আগেই সময় বাড়ছে ‘পূর্বাঞ্চলীয় গ্রিড নেটওয়ার্কের পরিবর্ধন এবং ক্ষমতাবর্ধন’প্রকল্পের।
প্রকল্পটি জানুয়ারি ২০১৮ থেকে ডিসেম্বর ২০২১ মেয়াদে বাস্তবায়নের জন্য অনুমোদন করা হয়। অথচ জানুয়ারি ২০২০ পর্যন্ত প্রকল্পের আর্থিক অগ্রগতি মাত্র মোট প্রকল্প ব্যয়ের ০ দশমিক ৭০ শতাংশ। প্রকল্পের ভৌত অগ্রগতি ৪ দশমিক ৮০ শতাংশ। মূলত টেন্ডার কাজে বিশ্বব্যাংকের চাহিদা পূরণ করতেই সময় লাগছে। এমনকি প্রকল্পটি প্রায় দুই বছর আগে অনুমোদন পেলেও এখনও টেন্ডার প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়নি।
তাই প্রকল্পটি নির্দিষ্ট মেয়াদে সম্পন্ন হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। এজন্য প্রকল্পের মেয়াদ আরো এক বছর বাড়ানোর জন্য পরিকল্পনা কমিশনে প্রস্তাব করেছে পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশ লিমিটেড (পিজিসিবি)। বিশ্বব্যাংকের টেন্ডার জটিলতার কারণেই প্রকল্পটি শুরু করতে সময় লাগছে বলে জানায় সংশ্লিষ্ট বিভাগ।
পিজিসিবি সূত্র জানায়, প্রকল্পের আওতায় নির্মিত সব উপকেন্দ্র জিআইএস (জিওগ্রাফিক ইনফরমেশন সিস্টেম) পদ্ধতিতে চায় বিশ্বব্যাংক। ফলে কাজের গুণগত মান বজায় রাখার জন্য বিশ্বব্যাংক থেকে সিঙ্গল স্টেজ টু এনভেলপের (এসএসটিই) দরপত্র আহ্বানের অনুমোদন করা হয়।
পিজিসিবির কাছে বিশ্বব্যাংকের এসএসটিইর প্রকিউরমেন্ট ডকুমেন্ট না থাকায় সিঙ্গেল স্টেজ সিঙ্গেল এনভেলপে (এসএসএসই) করাসহ এসএসটিই প্রকিউরমেন্ট ডকুমেন্ট প্রস্তুত করায় টেন্ডার প্রক্রিয়ায় বিলম্ব হয়েছে।
ডিপিপি (উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনা) প্রস্তুতের সময় বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে প্রকল্পের আওতায় নির্মিত গ্রিড উপকেন্দ্রসহ ও সঞ্চালন লাইনসমূহের ইনভেন্টরি অব লসেস (এলওএল) কাজের জন্য প্রিপারেশন অ্যান্ড ইমপ্লিমেন্টেশন অব রিসেটেলমেন্ট অ্যাকশন প্ল্যান (আরএপি) বিষয়ে পরামর্শক নিয়োগের কাজটি সম্পন্ন করার কথা ছিল। অথচ প্রকল্পের কাজটি উল্লেখ করা হয়নি এবং অর্থও বরাদ্দ দেওয়া হয়নি। এসব কাজ সম্পন্ন করতেও কালক্ষেপণ হচ্ছে।
প্রকল্পের প্রধান কার্যক্রমগুলো হচ্ছে- ১২ দশমিক ৬৩ কিলোমিটার ৪০০ কেভি সঞ্চালন লাইন নির্মাণ, ১৭৫ দশমিক ৯১ কিলোমিটার ২৩০ কেভি সঞ্চালন লাইন নির্মাণ, ২৫৬ দশমিক ৩ কিলোমিটার ১৩২ কেভি সঞ্চালন লাইন নির্মাণ, ২টি ৪০০ কেভি সাব-স্টেশন, ২টি ২৩০ কেভি সাব-স্টেশন, ১০টি ১৩২ কেভি সাব-স্টেশন, ৬টি বে সম্প্রসারণ, রক্ষণাবেক্ষণ এবং ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম উন্নতকরণ, ৮৬ একর ভূমি অধিগ্রহণ করা হবে।
প্রকল্প পরিচালক এ কে এম গাউস মহিউদ্দিন আহমেদ গণমাধ্যমকে বলেন, টেন্ডারের জন্য প্রকল্পটি বাস্তবায়নের শুরুতে কিছু সময় লাগছে। ফলে প্রকল্পের অগ্রগতিও কম। চলতি বছরের এপ্রিল নাগাদ চারটি প্যাকেজের কাজের চুক্তিসই হবে। তখন প্রকল্পের অগ্রগতি বেড়ে যাবে। আমরা আরো এক বছর সময় চেয়েছি, আশা করি এই সময়েই প্রকল্পের কাজ শতভাগ সম্পন্ন করতে পারব। ২০১৯ সালের মে মাসে ১২টি উপকেন্দ্র নির্মাণের জন্য সংশ্লিষ্ট ডিসি অফিসকে চূড়ান্ত প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে।
প্রকল্প পরিচলক আরো বলেন, এখন আর বিশ্বব্যাংকের টেন্ডার জটিলতা নেই। প্রথমে দরপত্রের জন্য সময় লেগেছে। টেন্ডার ফাইনাল হলেই কাজের গতি বেড়ে যাবে বলে আশা করছি।
দেশের পূর্বাঞ্চলীয় গ্রিড নেটওয়ার্কের সক্ষমতা বৃদ্ধির উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এ কাজে মোট ব্যয় হবে ৫ হাজার ৮০৩ কোটি ৯৩ লাখ টাকা। প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে বৃহত্তর কুমিল্লা, নেয়াখালী ও চট্টগ্রাম অঞ্চলে নিবিড় বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করার পাশাপাশি বিদ্যুতের ক্রমবর্ধমান চাহিদা পূরণ করা সম্ভব হবে।
যেসব উপজেলায় প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হচ্ছে সেগুলো হলো, মুন্সীগঞ্জ জেলার গজারিয়া উপজেলা। চট্টগ্রামের চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন, মিরসরাই, পটিয়া, হালিশহর, হাটহাজারী, আনোয়ারা, চন্দনাইশ, সাতকানিয়া এবং লোহাগড়া উপজেলা।
ফেনীর ফেনী সদর, ছাগলনাইয়া, দাগনভূঁইয়া ও সোনাগাজী উপজেলা। নোয়াখালীর নোয়াখালী সদর, বেগমগঞ্জ, সেনবাগ, সোনাইমুড়ি এবং চাটখিল উপজেলা। কুমিল্লার কুমিল্লা সদর, দেবীদ্বার, দাউদকান্দি, মুরাদনগর, লাকসাম, বুড়িচং এবং ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলা।
চাঁদপুরের শাহরাস্তি, হাজীগঞ্জ এবং মতলব উপজেলা। লক্ষীপুরের লক্ষীপুর সদর এবং রামগঞ্জ উপজেলা। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবা উপজেলা। কক্সবাজারের কক্সবাজার সদর, চকোরিয়া এবং রামু উপজেলা।
বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, ২০২১ সালের মধ্যে সবার কাছে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ করার জন্য পাওয়ার সিস্টেম মাস্টার প্ল্যান অনুযায়ী বিদ্যুৎ উৎপাদন ও বিতরণ ব্যবস্থার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে বিদ্যুৎ সঞ্চালন খাতে ব্যাপক উন্নয়ন কর্মসূচি গ্রহণ আবশ্যক।
এ জন্য পাওয়ার সিস্টেম মাস্টার প্ল্যান ২০১৬ অনুযায়ী ২০৩০ সালের মধ্যে দেশব্যাপী ৪০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে সক্ষম একটি সঞ্চালন ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। সে লক্ষ্য বাস্তবায়নে পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশ (পিজিসিবি) লিমিটেড একটি শক্তিশালী গ্রিডে নেটওয়ার্ক বিনির্মাণের মাধ্যমে বিদ্যুতের ক্রমবর্ধমান চাহিদা পূরণের জন্য পূর্বাঞ্চলীয় গ্রিড নেটওয়ার্কের পরিবর্ধন এবং ক্ষমতাবর্ধন শীর্ষক প্রকল্পটির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
এই প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে, একটি শক্তিশালী দক্ষ ও বর্ধিত ক্ষমতাসম্পন্ন বিদ্যুৎ সঞ্চালন ব্যবস্থা নির্মাণ করা হবে। এর আওতায় দেশের পূর্বাঞ্চল তথ্য বৃহত্তর কুমিল্লা, নোয়াখালী ও চট্টগ্রামে গ্রিড নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণ ও ক্ষমতা বর্ধিতকরণের কাজ অন্তর্ভুক্ত। এলাকাগুলোর বিদ্যমান সঞ্চালন অবকাঠামো বহুলাংশে পুরাতন এবং প্রয়োজনের তুলনায় সঞ্চালন ক্ষমতা অপ্রতুল।
সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপের কারণে চট্টগ্রাম এলাকায় ব্যাপক শিল্পায়নের দুয়ার উন্মোচিত হয়েছে। এর সঙ্গে তাল মিলিয়ে নিকটবর্তী কুমিল্লা ও নোয়াখালী অঞ্চলের বিদ্যুতের চাহিদাও বেড়ে চলেছে। তাই বিদ্যুতের ক্রমবর্ধমান চাহিদার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে এলাকাগুলোকে নির্ভরযোগ্য বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করা ও বিদ্যুতের চাহিদা পূরণের জন্য এই প্রকল্পটি নেয়া হয়েছে। অথচ বিশ্বব্যাংকের চাহিদা মতো টেন্ডার কাজ সম্পন্ন করতেই প্রায় দুই বছর চলে গেছে প্রকল্পের মেয়াদ।