বাংলা ভাষার মধ্যবর্তিতা

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী

অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী
অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী

আমরা আগে বাঙালি, না আগে মুসলমান সে নিয়ে একসময় একটা বিতর্ক ছিল; বিজ্ঞজনরা বলতেন যে বিতর্কটি নিতান্তই অহেতুক। কেননা একই সঙ্গে বাঙালি ও মুসলমান হতে কোনো অসুবিধা নেই। বাঙালিত্ব ও মুসলমানত্বের ভেতর বিরোধ যে নেই সেটা সত্য; কিন্তু তবু বিরোধ তো একটা তৈরি করা হয়েছিল এবং সেই বিরোধটা যখন তুঙ্গে উঠল তখন অখণ্ড বাংলাকে দ্বিখণ্ডিত করা ছাড়া উপায় রইল না। তাতে বাঙালির যে কত বড় সর্বনাশ ঘটেছে সেটার পরিমাপ করা অসম্ভব। কিন্তু ঘটনার অল্প পরেই বেশির ভাগ বাঙালি বাস করে যেখানে, সেই পূর্ববঙ্গে আওয়াজ উঠল যে ভুল হয়ে গেছে, আমরা আগে বাঙালি, তারপরে অন্য কিছু।

ব্যাপারটা আত্মপরিচয়ের। বাঙালি নিজেকে বাঙালি বলেই পরিচয় দেবে—এটাই স্বাভাবিক, ঠিক যেভাবে পৃথিবীর বিভিন্ন জাতি নিজেদের পরিচয় দিয়ে থাকে, আমরা সেভাবেই বলব, আমরা বাঙালি বটে।

universel cardiac hospital

কিন্তু কাকে আমরা বাঙালি বলব? নিরিখটা কী? প্রথম নিরিখটা পরিষ্কার। সেটা হলো বাংলা ভাষার চর্চা। তাকেই বাঙালি বলা যাবে, যে বাংলায় কথা বলে, এই সংজ্ঞাটা সহজ। কিন্তু বাঙালিও বাংলা বলতে পারে। তাই শুধু বাংলা বললেই বাঙালি হবে—এটা বলা যাবে না। একটু এগিয়ে গিয়ে বলতে হবে যে সে-ই হচ্ছে বাঙালি, যে বাংলা ভাষার চর্চা করে এবং অন্য বাঙালির সঙ্গে সহমর্মিতা অনুভব করে—তাদের দুঃখে কাতর হয়, তাদের আনন্দে উত্ফুল্ল এবং সবার উন্নতি চায়। এই যে সহমর্মিতা, এর একটা নাম সামাজিকতা, আরেকটা নাম দেশপ্রেম।

সামাজিক হওয়া চাই, দেশপ্রেমিকও হওয়া চাই, নইলে নয়। অর্থাৎ এককথায় বাঙালি হতে হলে মানুষ হতে হবে। সামাজিকতা ও দেশপ্রেম মনুষ্যত্বেরই অংশ বটে, অপরিহার্য অংশ। যে মানুষ সামাজিক নয়, যে বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকে, সমাজে থেকেও দূর দ্বীপে কিংবা গহিন অরণ্যে বসবাস করে; একদিন নয়, দীর্ঘদিন, সব সময় সে লোকটি মানুষের মতো হলেও ঠিক মানুষ নয়। কেননা, মানুষ প্রকৃত অর্থেই হচ্ছে একটি সামাজিক প্রাণী। তার বুদ্ধি, বিবেক, হৃদয়ানুভূতি, জ্ঞান, রুচি যা কিছুকে মানবিক গুণ বলে আমরা জানি সব কিছু সামাজিকভাবেই বিকশিত হয়। এটা একা কোনো কিছুই সৃষ্টি বা অর্জন করা সম্ভব নয়। আমরা এও বলতে পারি যে সামাজিক হলেই দেশপ্রেমিক হওয়া সম্ভব।

আসলে বাঙালি হওয়া মানেই মানুষ হওয়া। পরিপূর্ণ অর্থে মানুষ হওয়া। আর সেটা হওয়া ক্রমেই যে কঠিন হয়ে পড়েছে তা একটি বাস্তবিক সত্য বৈকি। এই যে পহেলা বৈশাখ আসে, আবির্ভাব ঘটে বাঙালির নববর্ষের, তখন অন্তত এক দিনের জন্য বাঙালি হয়ে উঠলাম বলে আমরা মনে করি। সবাই নয়, এমনকি নববর্ষের অনুষ্ঠানে যারা যোগ দেয়, তাদের ভেতরেও সবাই নয়।

একুশ উদ্যাপন কিংবা পহেলা বৈশাখও মানুষে মানুষে যে বৈষম্য সেটাকেই উন্মোচিত করে দেয়। এমনকি অল্পসংখ্যায় যাঁরা উৎসবে-অনুষ্ঠানে যোগ দেন তাঁরাও কাছাকাছি হন বটে; কিন্তু ঐক্যবদ্ধ হন না, সামাজিক হয়ে উঠেন না। সমাজে সামাজিকতা কি নেই? আছে, অবশ্যই আছে। কিন্তু সেটা এখন পারিবারিক হয়ে পড়েছে। এমনকি পরিবারের সবাই যে একত্র হবে তাও হয় না। পরিবার আয়তনে বড় হয়েছে এটা যেমন সত্য, পরিবারের ভেতরও বৈষম্য দেখা দিয়েছে এটাও মিথ্যা নয়; কোথাও কোথাও বৃদ্ধি পেয়েছে স্বার্থের দ্বন্দ্ব, ভাগ-বাটোয়ারার লড়াই, উত্তরাধিকার নিয়ে সংঘর্ষ। ফলে সামাজিকতা অত্যন্ত সংকীর্ণ হয়ে পড়েছে। পারিবারিক এবং বন্ধুবান্ধবের মিলনের বাইরে বড় জায়গায় গিয়ে যে মিলব—এমনটা দেখা যায় না। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের অভাব, খেলাধুলার জন্য মাঠ নেই, এমনকি জনসভাও এখন আর আগের মতো হয় না। আমরা সংকীর্ণ হচ্ছি, ক্ষুদ্র হচ্ছি, ফলে মনুষ্যত্ব খর্ব হয়ে পড়ছে। আর মানুষ্যত্ব যদি না থাকে, তাহলে তো আমরা মানুষই থাকব না, বাঙালি হব কী করে? পারছি না, হতে পারছি না।

মাতৃভাষার চর্চাটা দরকার। খুবই দরকার, অত্যাবশ্যক বলা যায়। সবাই মিলে বাংলা ভাষার চর্চা করব, তাতে আমাদের আত্মসম্মান বাড়বে, আমরা পরস্পরের কাছাকাছি চলে আসব, একে অপরকে বুঝব, আমাদের শিক্ষাদীক্ষা একই রকম হবে। বৃদ্ধি পাবে সামাজিকতা তথা মানুষ্যত্ব।

২.

বাংলা ভাষার পক্ষে অবশ্য মাঝখানে থাকার কথা ছিল না, থাকার কথা ছিল জনতার সঙ্গে। বাংলা তো জনতারই ভাষা। তার ইতিহাসে এই প্রথম বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরই, সে রাষ্ট্রভাষা হয়েছে। তার আগের শাসকরা সংস্কৃত, ফার্সি, ইংরেজি ব্যবহার করেছে, বাংলা ব্যবহার করেনি। জনতাই বাংলা ভাষাকে আপন বলে আগলে রেখেছে। বলা যায়, রাখতে চেয়েছে; কিন্তু রাখতে পারেনি। কারণ জনতার আয়ত্তে শিক্ষা ছিল না, তার অধিকারে ক্ষমতা ছিল না। ভাষা তাই চলে গেছে মধ্যবিত্তের কাছে, যারা শিক্ষা আয়ত্ত করেছে এবং ক্ষমতার ছিটেফোঁটা অংশ পেয়েছে। বাংলা ভাষার মধ্যবর্তিতা বলতে তাই বোঝাবে এই ভাষার ওপর মধ্যবিত্তের কর্তৃত্ব।

এই মধ্যবিত্তই তার শ্রম, সাধনা ও মেধা দিয়ে বাংলা ভাষার সেবা করেছে; তার নানা রূপ বিকাশ ঘটিয়েছে, তাকে সমৃদ্ধ করেছে নানা অভিজ্ঞতার ধারক ও প্রকাশক হিসেবে। বলা বাহুল্য, বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার আগ পর্যন্ত এই মধ্যবিত্ত পুরো ক্ষমতা পায়নি, ক্ষমতার অংশবিশেষ পেয়েছে মাত্র। তাই বলে সে যে একদিকে রাষ্ট্রক্ষমতা, অন্যদিকে জনগণ—এই দুই বিপরীত পক্ষের মাঝখানে পড়ে চুপসে যাচ্ছিল তা নয়; শাসক শ্রেণির সঙ্গে তার একটা দূরত্ব ও এক ধরনের বিরোধ ছিল এটা সত্য; অন্যদিকে জনতা তার প্রতিপক্ষ ছিল না; বরং বলা যায় মিত্রই ছিল। খুবই ভালো হতো যদি এই মধ্যবিত্ত পুরোপুরি চলে আসত জনগণের পক্ষে; তাহলে দেশের রাজনীতি, রাষ্ট্র ও সমাজের গঠন ইত্যাদিতে মৌলিক বিবর্তন ঘটে যেত, পরিবর্তন আসত ভাষার প্রকাশরীতিতেও। ভাষা যে বদলাত তা নয়, ভাষা ওভাবে বদলায় না, তবে তাতে নতুন প্রাণ ও প্রবহমানতা আসত।

কিন্তু তা ঘটেনি এবং সেই না ঘটাটাকে অস্বাভাবিক বলা যাবে না। কেননা, মধ্যবিত্ত যেমন চাপা পড়ে থাকেনি, তেমনি আবার সে সর্বদাই যে দোদুল্যমান থেকেছে তাও নয়। তার মুখ ওপরের দিকেই থেকেছে, সে অনেকটা সূর্যমুখীর মতো, দাঁড়িয়ে আছে ভূমিতে, অর্থাৎ জনগণের সাহায্য নিয়ে; কিন্তু তাকিয়ে থেকেছে শাসক শ্রেণির দিকে। তার এই মুখাপেক্ষিতার ছাপ বাংলা ভাষায় পড়েছে। বাংলা ভাষাকে জনগণ রক্ষা করেছে কিন্তু এ ভাষা জনগণের হয়ে ওঠেনি; হয়ে রয়েছে মধ্যবিত্তেরই। জনগণ বঞ্চিত থেকেছে শিক্ষা ও ক্ষমতা, উভয় দিক থেকেই। যার রয়েছে শিক্ষার অভাব এবং যে ক্ষমতাহীন সে কী করে ভাষার ওপর কর্তৃত্ব করবে? বাংলা ভাষা তাই রয়ে গেল মধ্যবিত্তের হাতের মুঠোতেই।

ফলটা যে ভালো হয়েছে তা বলা যাবে না। ভাষার দিক থেকে লোকসানই ঘটেছে। ভাষার জনবিছিন্নতা ঘটেছে। সংবেদনশীল না হয়ে সে বরং আত্মসচেতন ও স্পর্শকাতর হয়ে পড়েছে, ভাষার জন্য যা ধনাত্মক নয়, ঋণাত্মক বটে। সব মিলিয়ে একটা কৃত্রিমতা এসে গেছে। ভাষা যেটা এখনো কাটিয়ে উঠতে পারেনি।

বাংলা গদ্যের সৃষ্টিতে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের একটা ভূমিকা ছিল। গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকাই বলতে হবে। এবং গুরুত্বপূর্ণ যেহেতু, তাই আমাদের জন্য অগৌরবের। কেননা, ওই কলেজ তো বাঙালিকে বিদ্যা শিক্ষাদানের জন্য প্রতিষ্ঠা করা হয়নি, তার প্রতিষ্ঠা ঘটেছিল কম্পানির ইংরেজ কর্মচারীদের প্রয়োজনে। তাদের শিক্ষণীয় বিষয়ের মধ্যে বাংলাও ছিল, এবং তাই বাংলা পাঠ্যপুস্তক রচনার দরকার দেখা দিয়েছিল। এই দরকারটা বাংলা গদ্যের সৃষ্টিতে একটি ভূমিকা রেখেছে। উইলিয়াম কেরি ছিলেন বাংলা বিষয়ের অধ্যাপক। এ দেশে তিনি এসেছিলেন খ্রিস্টধর্ম প্রচারের জন্য। প্রচার করতে গিয়ে জনগণের মুখের ভাষার সঙ্গে পরিচিত হয়েছিলেন, সে পর্যায়ে তাঁর ব্যবহৃত ভাষা ছিল জনতার ভাষা। পরে যখন তিনি ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের অধ্যাপক হলেন তখন বাংলা ভাষার ব্যাপারে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিবর্তন এলো। কলেজে তাঁর সহযোগী ছিলেন দুজন; একজন হলেন রামরাম বসু, অন্যজন মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার। দুজনেই বাংলা পাঠ্যপুস্তক লিখেছেন; কিন্তু তাঁদের ভাষা ছিল দুই রকমের শুধু নয়, দুই বিপরীত প্রান্তের। রামরাম বসু ছিলেন ফার্সি-শিক্ষিত; মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার ছিলেন সংস্কৃত পণ্ডিত। রামরাম বসুর বাংলায় ফার্সির মিশাল থাকত, আর বিদ্যালঙ্কারের রোখ ছিল বাংলাকে ফার্সি প্রভাব থেকে মুক্ত করা।

রামরাম বসু পিছু হটেছেন, প্রতিষ্ঠা ঘটেছে বিদ্যালঙ্কারের। জনগণের মুখের ভাষায় দেশজ ও ফার্সি শব্দের বিস্তর ব্যবহার ছিল; সেগুলো পিছিয়ে গেল, সামনে এলো তৎসম শব্দ, এমনকি সংস্কৃত শব্দও। ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের অধ্যাপকের পদ থেকে কেরি তাঁর দুই বাঙালি মধ্যবিত্ত সহযোগীর মধ্যে বিদ্যালঙ্কারের ভাষারীতির প্রতি পক্ষপাত দেখালেন। বাংলা ভাষায় প্রথম গদ্য গ্রন্থগুলো ওই কলেজের পৃষ্ঠপোষকতাতেই তৈরি হয়েছিল এবং মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কারের ভাষাই সেখানে গ্রহণযোগ্যতা পেল। কালে সেটাই হয়ে দাঁড়াল বাংলা গদ্যের মান ভাষা।

এটাই ছিল স্বাভাবিক। প্রথমত, যে মধ্যবিত্ত বাংলার চর্চা করেছে তার মনোযোগ ছিল জনজীবনের এলাকার বাইরে; তারা ছিল কলকাতার অধিবাসী, ইংরেজি শিক্ষিত এবং ইংরেজের অনুগ্রহ-প্রত্যাশী। তারা ছিল জনজীবনবিচ্ছিন্ন, তাদের জীবনে কৃত্রিমতা এসেছে; তারা যে শিক্ষিত, তার প্রদর্শন করার প্রয়োজনীয়তাও ছিল। সেই প্রমাণ যেমন ছিল তাদের ইংরেজি ভাষা ব্যবহারে, তেমনি পাওয়া গেল তাদের ‘সাধু’ বাংলা ভাষা ব্যবহারে। সাধারণ মানুষ ছিল অশিক্ষিত ও পশ্চাৎপদ; তাদের সঙ্গে মধ্যবিত্তের যোগাযোগ ছিল সামান্য। সেটাও একটা কারণ, যে জন্য মধ্যবিত্ত নিজেদের আলাদা করে রেখেছে—যেমন জীবন যাপনে, তেমনি ভাষা ব্যবহারে।

সাধু ভাষা চালু হওয়ার দ্বিতীয় কারণ কম্পানির সাহেবদের ফার্সিবিদ্বেষ। যে স্থানীয় শাসকদের কাছ থেকে তারা রাজ্য ছিনিয়ে নিয়েছিল, ফার্সি ছিল তাদের ভাষা। কম্পানি ওই শাসকদের শত্রু ভাবত; তাই তাদের ভাষার প্রতিও বিদ্বেষটা জমে উঠেছিল স্বাভাবিক নিয়মেই। ইংরেজরা তাদের নিজেদের ভাষা চালু করার উদ্যোগ নিচ্ছিল; সেই উদ্যোগের উল্টো পিঠে ছিল ফার্সিকে হটিয়ে দেওয়ার আবশ্যকতা। ফার্সির প্রতি তাদের অনীহা সংস্কৃতের প্রতি আগ্রহকে পুষ্ট করেছে।

তা ছাড়া সংস্কৃত পণ্ডিতদের সঙ্গেই শিক্ষিত ইংরেজদের কিছুটা উঠাবসা ছিল; ফার্সি পণ্ডিতরা ছিলেন দূরে। রামমোহন রায় চমৎকার ফার্সি ভাষা জানতেন; কিন্তু তাঁর নিজের জন্য ফার্সি গুরুত্বপূর্ণ ছিল না, গুরুত্বপূর্ণ ছিল সংস্কৃতজ্ঞান। তিনি সংস্কৃত ধর্মগ্রন্থ বাংলায় অনুবাদ করে বাংলা গদ্যের অগ্রগতিতে অত্যন্ত মূল্যবান অবদান যুক্ত করেন। স্মরণীয় যে রামমোহন নানা সূত্রে কম্পানির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।

জনগণের মুখের ভাষার সঙ্গে পরিচিত হওয়া সত্ত্বেও উইলিয়াম কেরি যে সংস্কৃতবহুল বাংলা গদ্য রচনাকে উৎসাহিত করলেন তার আরো একটি কারণ ছিল। কেরি নিজেও মধ্যবিত্ত শ্রেণিরই মানুষ; তদুপরি মান ভাষা সম্পর্কে তিনি যে ধারণা নিয়ে বাংলাদেশে এসেছিলেন সেটা ছিল অষ্টাদশ শতাব্দীর শিক্ষিত ইংরেজের এবং তার পেছনে কাজ করেছে ভাষা সম্পর্কে স্যামুয়েল জনসনের চিন্তাধারা। মধ্যবিত্তের খাঁটি প্রতিনিধি জনসন মনে করতেন সাধারণ মানুষের মুখের ভাষা কখনোই মান ভাষা হতে পারে না। শিক্ষিত মানুষের মুখের ভাষা অশিক্ষিত মানুষের ভাষা থেকে অবশ্যই স্বতন্ত্র হবে। জনসন তাঁর অভিধানে, ইংরেজি ভাষার প্রথম অভিধান যাকে বলা যায় তাতে জনগণের মুখের ভাষাকে মোটেই স্থান দেননি; ওই ভাষাকে তিনি বলতেন উপভাষা এবং কামনা করতেন উপভাষা অবলুপ্ত হয়ে যাক। বাংলা ভাষার ক্ষেত্রে কেরি তেমনটাই চাইছিলেন। তাঁর মনস্কামনা যে অপূর্ণ থেকেছে তা নয়। শাসকদের পিঠ চাপড়ানোতে শাসিত মধ্যবিত্ত অত্যন্ত উৎসাহিত হয়েছে জনজীবনবিচ্ছিন্ন একটি কৃত্রিম গদ্যভাষা তৈরি করতে।

কবিতায় অবশ্য অন্য ব্যাপার ছিল। আসলে কবিতার ভাষাই তো আগে এসেছে, গদ্য তো এলো পরে। চর্যাপদ হচ্ছে বাংলার আদি কবিতা, সে কবিতার ভাষা সহজ এবং ধারণা করা যায় তা ছিল জনগণের ব্যবহৃত ভাষা। পরবর্তীকালে ভারতচন্দ্রের কাব্যভাষায় বিস্তর ফার্সি শব্দ দেখা গেছে। লালনের গানে ভাষা খুব সহজ; সে ভাষা জনগণের মুখের ভাষা বটে। লালন ও রামমোহন প্রায় সমসাময়িক; কিন্তু দুজনের অবস্থানের ভেতর দূরত্বটা আকাশ ও পাতালের। লালন হচ্ছেন প্রান্তবর্তী এলাকা ও সমাজের মানুষ, রামমোহন হচ্ছেন একেবারে কেন্দ্রের। রাজধানী কলকাতা স্বভাবতই জয়ী হয়েছে, রামমোহনের ভাষাই স্থায়ী হয়েছে, তার বাইরে যেতে পারেনি।

বাংলা ভাষাতে মধ্যবিত্তের কর্তৃত্বই টিকে রইল; সে বন্ধন তার পক্ষে ছিন্ন করা সম্ভব হলো না। সংখ্যার দিক থেকে বাংলার সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ মুসলমান, তাদের জীবন প্রথম দিককার বাংলা সাহিত্যে তুলনামূলকভাবে কম এসেছে; তার কারণ, তাদের বেশির ভাগই ছিল কৃষক এবং শিক্ষাবঞ্চিত। পরে মুসলমান সমাজের ভেতরও একটা মধ্যবিত্ত শ্রেণি গড়ে উঠেছে। হিন্দু মধ্যবিত্তের মতো এরাও ছিল আত্মসচেতন। ফার্সি যেহেতু মুসলমান শাসকদের ভাষা ছিল, তাই এই মধ্যবিত্ত চাইল বাংলা ভাষাতে ফার্সি ও আরবি শব্দের ব্যবহার কিছুটা হলেও দৃশ্যমান থাকুক। সংস্কৃতের আধিপত্য তাদের কাছে ছিল মর্মপীড়ার কারণ। হিন্দু মধ্যবিত্ত ও মুসলমান মধ্যবিত্তের মধ্যকার দ্বন্দ্বটা রাজনীতিতে সাম্প্রদায়িকতা তৈরি করেছে; দেখা গেল ওই সাম্প্রদায়িকতা ভাষাতেও চলে এসেছে। ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদ এসে বাঙালিকে ঐক্যবদ্ধ রাখতে পারত, সেখানে ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদ বাঙালিকে দুই ভাগে খাড়াখাড়ি ভাগ করে দিয়ে শেষ পর্যন্ত সাতচল্লিশের সর্বনাশা দেশভাগ সম্পন্ন করল।

দেশভাগ হওয়ায় বাংলার সাহিত্য, সংস্কৃতি, ভাষা সব কিছুরই ক্ষতি হয়েছে। পূর্ববঙ্গের ইতিহাসটা আমাদের কাছে বিশেষভাবে পরিচিত। রাষ্ট্র সেখানে ভাষার ওপর হস্তক্ষেপ ঘটিয়েছে; এবং সেই ক্ষতিকর কাজে মধ্যবিত্ত শ্রেণির একাংশকে ব্যবহার করেছে। চেষ্টা হয়েছে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার; বাংলাকে ফার্সি-আরবি শব্দে অস্বাভাবিকরূপে ভারাক্রান্ত করে তুলতে। হরফ বদলানো, ভাষা সহজীকরণ, রবীন্দ্রনাথকে বাদ দেওয়া, নজরুলকে সংশোধন করা—সব আপাত-অবিশ্বাস্য ঘটনা ঘটেছে; রাষ্ট্রীয় অনুগ্রহলোভী মধ্যবিত্তের একাংশই তৎপরতা দেখিয়েছে এসব কাজে।

অবশ্য সফল হয়নি। বাংলাই রাষ্ট্রভাষা হয়েছে। বাঙালি একটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছে। কিন্তু ভাষা এখনো মধ্যবিত্তের শ্রেণি-সীমানার মধ্যেই আবদ্ধ হয়ে রয়েছে। জনগণের বিপুল অংশ শিক্ষাবঞ্চিত; অক্ষরজ্ঞানসম্পন্ন লোকের সংখ্যা বেড়েছে, কিন্তু শিক্ষিতের হার যে বেড়েছে তা বলা যাবে না। আর শিক্ষিত মধ্যবিত্তের অনেকেই বাংলার চেয়ে ইংরেজির ব্যবহারকেই বীরত্বপূর্ণ কাজ বলে মনে করে। তাদের কথাবার্তায় ইংরেজি শব্দ তো বটেই, ইংরেজি বাক্যাংশ, এমনকি বাক্যও চলে আসে, অতি অনায়াসে। ছেলে-মেয়েদের ইংরেজি মাধ্যমে লেখাপড়া শেখাতে পারলে মা-বাবা আহ্লাদিত হন। উচ্চশিক্ষায় বাংলা ভাষার প্রচলন নেই; উচ্চ আদালতে বাংলা ভাষা নিষিদ্ধ।

মোটকথা, বাংলা এখনো মধ্যবর্তিতাতেই আটক আছে। তার দৃষ্টি ওপরের দিকে। চর্যাপদের আদি কবি বাঙালি হওয়াটাকে সম্মানজনক মনে করেননি; আজকের মধ্যবিত্তেরও ওই একই দশা। কিন্তু আমাদের বিকাশ, সমৃদ্ধি, সম্মান সব কিছুই তো নির্ভর করছে ঐক্যের ওপর; এবং ঐক্য আসবে না—যদি বাংলা ভাষাকে সবার ভাষা না করতে পারি। সে পথে প্রধান অন্তরায়টি রাজনৈতিক। রাষ্ট্রীয় কারণেই বাংলা ভাষার মধ্যবর্তিতা ঘটেছে; সেটা ছিন্ন করতে হলে রাষ্ট্রের চরিত্রে পরিবর্তন আনা চাই। অর্থাৎ রাষ্ট্রকে জনগণের রাষ্ট্রে পরিণত করতে হবে। সেটা যে এখনো ঘটেনি তার একটা বড় প্রমাণ বাংলা ভাষার খণ্ডিত ব্যবহার।

লেখক : ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

শেয়ার করুন

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে