করোনা ভাইরাসের প্রভাবে কাঁচামাল সংকটে পড়েছে দেশের তৈরি পোশাক কারখানাগুলো৷ দেখা দিয়েছে রপ্তানি আদেশ কমে যাওয়ার শঙ্কাও৷ পরিস্থিতি উন্নতি না হলে বিপাকে পড়বে তৈরি পোশাক শিল্প৷
ওমেগা স্টাইল লিমিটেড নামে বাংলাদেশের একটি তৈরি পোশাক কারখানার মালিক আমিরুল ইসলাম৷ তিনি এখন লোকসানে ক্রেতাদেরকে পোশাক দিতে বাধ্য হচ্ছেন৷ যখন ক্রয় আদেশ নিয়েছেন তখন কাঁচামালের যে দাম ছিল এখন তা বেড়ে গেছে৷ করোনা পরিস্থিতি অব্যাহত থাকলে কারখানাই বন্ধ করে দেবে হবে বলে আশঙ্কা তার৷
আমিরুল ইসলাম বলেন, ‘তৈরি পোশাকের ৮০ ভাগ ফেব্রিক আসে চীন থেকে৷ এখন করোনার কারণে তাদের সরবরাহ অর্ধেকে নেমে এসেছে৷ আমরা স্থানীয় বাজার এবং কিছু বিকল্প সোর্স থেকে উচ্চমূল্যে কাপড় সংগ্রহ করছি৷ তাতে তো আমাদের উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে৷ আবার যে পরিমাণ অর্ডার পেয়েছি সেই পরিমাণ উৎপাদন করাও কঠিন হয়ে যাচ্ছে৷ এটা এখন উভয় সংকট৷’
বাংলাদেশের কারখানাগুলো নিট ও ওভেন এই দুই ধরনের পোশাক তৈরি করে৷ করোনায় মূলত ওভেন পোশাকের কারখানাগুলোই বেশি বিপাকে পড়ছে৷ সেই তুলনায় নিট পোশাকের কারখানাগুলোতে প্রভাব কম বলে জানান তিনি৷ ‘কারণ এখন ৮৫ ভাগ সুতাই আমাদের দেশে উৎপাদিত হয়৷ তবে তাদের ডায়িং-এর কেমিক্যাল চীন থেকে আসে৷ আর সব ধরনের পোশাকের জন্য বোতাম, জিপার, লেবেলসহ আরও যে অ্যাক্সেসরিজ আছে, তার ৮৫ ভাগই আসে চীন থেকে৷ ফলে সব মিলিয়ে পুরো পোশাক শিল্পই এখন সংকটের মুখে আছে,’ বলেন আমিরুল৷
পোশাক শিল্পের মালিকরা এখন করেনার কারণে তিন ধরনের সংকট দেখতে পাচ্ছেন৷ সরবরাহ কমে যাওয়ায় কাঁচামালের দাম বাড়ছে৷ যার কারণে বেড়ে গেছে উৎপাদন খরচ৷ কাঁচামাল সংকটে সময়মত পণ্য সরবরাহও করতে পারছেন না তারা৷
সম্প্রতি বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্পের রপ্তানিতে মন্দাভাব চলছে৷ রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর হালনাগাদ প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৯-২০ অর্থবছরের প্রথম আট মাসে এই খাত থেকে আয় হয়েছে দুই হাজার ১৮৪ কোটি ৭৫ লাখ ডলার, যা গত বছরের একই সময়ের চেয়ে পাঁচ দশমিক পাঁচ-তিন ভাগ কম৷
তৈরি পোশাক কারখানার মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ এই পরিস্থিতি মোকাবেলায় সরকারের সহায়তা চেয়েছে৷ আপৎকালীন তহবিল গঠন, ঋণের নিশ্চয়তা স্কিমসহ আরও কয়েকটি দাবি জানিয়েছে তারা গতমাসে৷ লিখিত আবেদনে সংগঠনটি বলেছে, গত অর্থবছরে চীন থেকে এক হাজার ৩৬৩ কোটি ডলারের পণ্য ও কাঁচামাল আমদানি হয়েছে৷
তার মধ্যে সুতা, কাপড় ও অন্যান্য কাঁচামাল রয়েছে ৫০২ কোটি ডলারের৷ সব মিলিয়ে পোশাক খাতের ৪৬ ভাগ কাঁচামাল আসে চীন থেকে৷ করোনা ভাইরাস যদি অব্যাহত থাকে, তাহলে পোশাক খাতে মারাত্মক প্রভাব পড়বে৷ চীন থেকে জাহাজ না আসায় আমদানি প্রায় ৫০ ভাগ কমে গেছে বলেও উল্লেখ করেন তারা৷
বিজিএমইএ’র সভাপতি রুবানা হক বার্তা সংস্থা ডয়চে ভেলেকে জানান, ‘এরই মধ্যে অ্যাক্সেসোরিজ-এর দাম শতকরা ৫০ ভাগ বেড়ে গেছে৷ আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যে চীন থেকে স্বাভাবিক গতিতে কাঁচামাল আসা যদি শুরু না হয় তাহলে আমরা সময়মত উৎপাদন এবং সরবরাহ করতে পারব না৷ এমনকি ডায়িং-এর খরচও বেড়ে যাচ্ছে৷ দুই-তিন মাসের মধ্যে এর ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব পড়বে৷’
তিনি বলেন, ‘যেহেতু কাঁচামালের জন্য আমরা চীনের ওপর নির্ভরশীল তাই কাঁচামাল আসলেও দেরিতে আসছে৷ উৎপাদন, শিপমেন্ট আটকে যাচ্ছে৷ নগদ অর্থেরও সংকট তৈরি হচ্ছে৷’
তিনি জানান, করোনা ভাইরাসের প্রকোপ তৈরি পোশাকের বিশ্ব বাজারে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে৷ যুক্তরাষ্ট্রের খুচরা বাজারে চাহিদা কমেছে শতকরা তিন দশমিক এক ভাগ৷
তবে অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বাড়িয়ে কাঁচামাল সমস্যার আপৎকালীন সমাধানের পথে হাঁটছেন উদ্যোক্তারা৷ আমিরুল ইসলাম বলেন, ‘এখন আমরা কাঁচামালের স্থানীয় উৎপাদকদের সঙ্গে বৈঠক করে উৎপাদন দ্বিগুণ করে বেশি দাম দিয়ে পরিস্থিতি সামাল দেয়ার চেষ্টা করছি৷ কিন্তু সেটা হয়তো দুই-এক সপ্তাহ পারা যাবে৷ রাতারাতি তো নতুন ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ ইন্ডাস্ট্রি গড়ে তোলা যাবে না৷ আমাদের এটাই বড় সমস্যা৷’
এফবিসিসিআই’র সহ সভাপতি এবং বিজিএমইএ’র সাবেক সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান বলেন, ‘আমরা চীন থেকে এখনো কাঁচামাল পাচ্ছি৷ চীন হয়তো শেষ পর্যন্ত কাঁচামালের সররবরাহ অব্যাহত রাখতে পারবে৷ আর বিকল্পও আমরা খুঁজছি৷ কিন্তু আমাদের ভয় হচ্ছে ইউরোপ নিয়ে৷ সেখানে যদি করোনা ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে পড়ে তাহলে পোশাকের চাহিদা অনেক কমে যাবে৷ মানুষ যদি ঘর থেকে বেরই না হতে পারে তাহলে পোশাক কিনবে কীভাবে? তখন কাঁচামাল থাকলেও আমাদের কোনো লাভ হবে না৷ এরই মধ্যে উৎপাদন কমেছে৷ কিছু কারখানা অর্ডার হারিয়েছে৷’
বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানির বড় অংশই যায় ইউরোপে৷ ইতালি, জার্মানিসহ কয়েকটি দেশে এরিমধ্যে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়েছে৷ সিদ্দিকুর রহমান বলেন, ‘জার্মানির পর যুক্তরাষ্ট্র এবং যুক্তরাজ্য আমাদের বড় বাজার৷ সবখানেই করোনা আছে৷ তবে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়লে আমাদের পোশাক শিল্প বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়বে৷’
কারখানাগুলোর ক্ষতির বিষয়ে নিয়মিত তথ্যের জন্য বিজিএমইএর পক্ষ থেকে এরইমধ্যে একটি সেল খোলা হয়েছে৷ তবে এখনো সেখানে পরিপূর্ণ তথ্য আসা শুরু হয়নি৷
২০১৮-১৯ অর্থবছরে বাংলাদেশ তিন হাজার ৪১৩ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানি করেছে৷ যা মোট রপ্তানির ৮০ ভাগেরও বেশি৷ এই খাতে কোনো সংকট তৈরি হলে তার প্রভাব পড়বে তাই গোটা রপ্তানি বাণিজ্যে৷
সূত্র : ডয়চে ভেলে