বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়া নভেল করোনাভাইরাসের প্রভাবে নানামুখী সঙ্কটে দেশের তৈরি পোশাক খাত। একের পর এক বাতিল হচ্ছে অর্ডার। আসছে না নতুন অর্ডার। বন্ধ হচ্ছে রফতানি। এভাবে চলতে থাকলে পোশাক খাত ভয়াবহ পরিস্থিতির মধ্যে পড়বে, যা সামাল দেয়া কঠিন বলছেন এ খাতের সংশ্লিষ্টরা।
তাদের মতে, করোনা এখন চীন ছাড়িয়ে ইউরোপ, আমেরিকাসহ বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। এটি দীর্ঘমেয়াদি হলে দেশের প্রধান রফতানি আয়ের তৈরি পোশাক খাত ঝুঁকির মধ্যে পড়বে। নতুন করে অর্ডার আসছে না। আগের ক্রয়াদেশ স্থগিত রাখার পরামর্শ দিচ্ছেন বিদেশি ক্রেতারা। এতে পণ্য শিপমেন্ট বন্ধ হলে সঙ্কটে পড়বেন পোশাক মালিকরা। এভাবে চলতে থাকলে সামনে শ্রমিকদের বেতন-বোনাস দিতে সমস্যা হবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন তারা।
পোশাক খাতের পরিস্থিতি বিষয়ে জানতে চাইলে এ খাতের সবচেয়ে বড় সংগঠন ‘বাংলাদেশ গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিজিএমইএ)’ সভাপতি ড. রুবানা হক গণমাধ্যমকে বলেন, বর্তমানে তৈরি পোশাক খাত গভীর সঙ্কটের মধ্যে পার করছে। একের পর এক পোশাক কারখানার ক্রয়াদেশ বাতিল হচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে সামনে এ খাত ভয়াবহ পরিস্থিতির মধ্যে পড়বে।
তিনি বলেন, অর্ডার কমে যাওয়ায় মিয়ানমার ও কম্বোডিয়া ইতোমধ্যে তাদের কর্মী ছাঁটাই শুরু করেছে। কিন্তু আমরা কর্মী ছাঁটাই করব না। কারণ শ্রমিক আমাদের বেশি গুরুত্ব। শ্রমিকের কথা চিন্তা করে আমরা ক্রেতাদের বলছি আপনারা অর্ডার বাতিল করবেন না। এখন এ মুহূর্তে যদি ক্রয়াদেশ বাতিল করতে শুরু করে; শিপমেন্ট করতে না দেয় তাহলে শ্রমিকের বেতন-বোনাস নিয়ে সামনে সাংঘাতিক বিপদের মধ্যে পড়বে।
করোনার ধাক্কা সামলানোর মতো সক্ষমতা পোশাক খাতে আছে কি না- জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমাদের এক্সপোর্ট ইমপোর্টের ব্যবসা। এটি যদি বন্ধ থাকে তাহলে যে ক্ষতি হবে তা সামলানোর মতো সক্ষমতা আমাদের কারো নেই। যদি রফতানি বন্ধ থাকে তাহলে আমাদের ব্যবসাই তো বন্ধ হয়ে যাবে। তাহলে আমরা কী করব। আমরা অর্থ সঙ্কটে পড়ব, যা সামাল দেয়া সম্ভবও নয়। কারণ আমাদের অন্য কোনো ব্যবসা নেই।
বেশকিছু প্রতিষ্ঠানের ক্রয়াদেশ স্থগিত
কয়েক দিনে বেশকিছু প্রতিষ্ঠানের ক্রয়াদেশ স্থগিত করা হয়েছে জানিয়ে ড. রুবানা হক বলেন, এ পর্যন্ত বড় বড় ২০টি কারখানা ক্রয়াদেশ স্থগিত করার কথা জানিয়েছে। এর মধ্যে লিড বায়ার রয়েছে অন্তত সাতজন। প্রত্যেক বায়ার বলছেন, আপনারা একটু অপেক্ষা করুন। পূর্ব অভিজ্ঞতা বলছে অপেক্ষা করা মানেই এটি বাতিল। কারণ ক্রেতারা কোনো সময় বলেন না আমরা পণ্য কিনব না। তারা বলেন, একটু অপেক্ষা করেন। পরে তৈরি করেন। এখন চাহিদা কম বিক্রি কম। পরে নেবো। কিন্তু সরাসরি কখনই বলেন না আমরা নেবো না। পরে যদি নেয়ও এখনকার দাম দেবে না। ডিসকাউন্ট চাইবে।
এমন পরিস্থিতিতে আপনাদের করণীয় কি? জানতে চাইলে রুবানা হক বলেন, আমরা এ অবস্থা সরকারকে জানিয়েছি। আমাদের নীতিসহায়তা দরকার ও অন্যান্য সুবিধা দেয়ার কথা বলেছি। সরকারের পক্ষ থেকে আশ্বাস দেয়া হয়েছে বলে জানান তিনি।
পণ্য তৈরিতে কাঁচামালের সমস্যা আছে কি না- জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমাদের নিট কাপড়ে প্রায় ৮৫ শতাংশ নিজেরাই তৈরি করি। এটিতে সমস্যা হচ্ছে না। তবে নন-কটন বেশি দামের পণ্যের কাঁচামাল কিছু সঙ্কট রয়েছে। এছাড়া পোশাক খাতের যেসব পণ্য আমদানি হয় তার ৪৯ শতাংশ আসে চীন থেকে। যন্ত্রপাতি কাঁচামালের সঙ্কটে গত দেড় মাস বিশাল ধাক্কা খেয়েছি। এটি কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করছি। কিন্তু এ সময় ক্রেতারা সমস্যা করছে। এতে উভয় সঙ্কটে পড়ছে বলে জানান এ পোশাক মালিকদের নেতা।
বিজিএমইএর তথ্য বলছে, দেশে বর্তমানে পোশাক কারখানা রয়েছে চার হাজার ৫৬০টি। যেখানে কর্মীর সংখ্যা প্রায় ৪০ লাখ। দেশের মোট রফতানির পোশাকের অবদান ৮৩ দশমিক ২৫ শতাংশ। তবে হোমটেক্স, টেরিটাওয়েলসহ এ খাতের অন্যান্য রফতানির উপখাত হিসাব করলে তৈরি পোশাক খাতের অবদান ৮৫ শতাংশ ছাড়িয়ে যাবে। এক দশক ধরে দেশের জিডিপি ৬ শতাংশের ওপর থাকার পেছনে সবচেয়ে বড় অবদান রয়েছে এ পোশাক খাত। তৈরি পোশাকের নেতিবাচক প্রভাব পড়ে পুরো অর্থনীতিতে।
- চট্টগ্রাম জেলা এই মুহূর্তে সর্বোচ্চ ঝুঁকিতে আছে : সিভিল সার্জন
- দেশে করোনায় আক্রান্ত আরও ৩ জন : আইইডিসিআর
রফতানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) হালনাগাদ প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, ২০১৯-২০ অর্থবছরে (জুলাই-ফেব্রুয়ারি) তৈরি পোশাক খাতের রফতানি আয় কমেছে। অর্থবছরের ফেব্রুয়ারি শেষে পোশাক রফতানি করে বাংলাদেশ আয় করেছে ২ হাজার ১৮৪ কোটি ৭৪ লাখ ডলার, যা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ১৩ দশমিক ৪৫ শতাংশ কম। একই সময়ে রফতানি প্রবৃদ্ধিও কমেছে ৫ দশমিক ৫৩ শতাংশ।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সহ-সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান বলেন, করোনাভাইরাস নিয়ে কথা বলা যাবে না। ইউরোপ, আমেরিকায় এটি দেখা দিয়েছে। এর প্রভাব দীর্ঘায়িত হলে আমাদের রফতানি বাণিজ্য ভয়াবহ রূপ নেবে।
তিনি বলেন, আগের তুলনায় আমাদের ব্যবসা কমে গেছে। এর মধ্যে যদি ক্রয়াদেশ স্থগিত হয় তাহলে বড় সঙ্কটের মধ্যে পড়বে। আগামীতে ব্যবসা টিকিয়ে রাখা মুশকিল হবে। তাই ক্রয়াদেশ প্রত্যাহার না করার আহ্বান জানান। পাশাপাশি চলমান দুরবস্থা থেকে উত্তরণে জরুরি ভিত্তিতে এ খাতের জন্য নগদ প্রণোদনা দেয়ার দাবি জানান এ তৈরি পোশাক উদ্যোক্তা।