জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আত্মস্বীকৃত খুনি আব্দুল মাজেদের ফাঁসি কার্যকরের পর ভয়ঙ্কর আরেক খুনি রিসালদার মোসলেহ উদ্দিনকে ভারতে আটকের খবর জানিয়েছে দেশটির গণমাধ্যম। কথিত আছে, রিসালদার সরাসরি বঙ্গবন্ধুকে গুলি করে হত্যা করে। তাছাড়া জেলহত্যায়ও জড়িত ছিলো এই খুনি। নারকীয় দুই হত্যার পর জিয়াউর রহমানের আর্শীবাদে তেহরান ও জেদ্দা দূতাবাসে দায়িত্ব পান। এরপর জার্মানিতে রাজনৈতিক আশ্রয় নেন। সেখান থেকে ভারতের উত্তর চব্বিশ পরগনায় বসবাস শুরুর পর ‘ইউনানী ফার্মেসীর’ ব্যবসা শুরু করেছিলেন। নিজের নামও পরিবর্তন করে রেখেছিলেন রফিকুল ইসলাম। পাঁচ ছেলে ও এক মেয়ের জনক এই আত্মস্বীকৃত খুনি।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। যে কয়েকজন সেনা কর্মকর্তা এই হত্যার মিশনে অংশ নেয় তার মধ্যে রিসালদার মোসলেহউদ্দিন অগ্রভাগে ছিলেন। গুলির শব্দ শুনে বঙ্গবন্ধু যখন বিষয়টি জানার জন্য নিচে নামছিলেন সেই সময় সিঁড়িতে বঙ্গবন্ধুকে নিজহাতে গুলি করে হত্যা করে এই মোসলেহ উদ্দীন।
নৃসংশ হত্যার পর অবস্থান
বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর অন্য খুনীদের সাথে তিনিও বঙ্গভবনে দায়িত্বপালন করেন। জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় আসার পর তাকে তেহরান ও জেদ্দা দূতাবাসে দায়িত্ব দিয়ে পাঠান। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর অন্য খুনীদের সাথে তিনিও দেশ ছেড়ে থাইল্যান্ড হয়ে পাকিস্তানে পালিয়ে যান। এরপর জার্মানিতে রাজনৈতিক আশ্রয় নেন। তার কয়েকবছর পর চলে আসেন ভারতে এবং উত্তর চব্বিশ পরগনার ঠাকুরনগর এলাকায় স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন।
৭৫-এ বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর নরসিংদী জেলার শিবপুরের দত্তেরগাঁও এলাকায় বাড়ি করে স্থায়ীভাবে বসবাস করছিলেন মোসলেহউদ্দিন। ৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার তদন্ত শুরু হলে তার বাড়িসহ বেশকিছু সম্পত্তি রাষ্ট্রের অনুকূলে বাজেয়াপ্ত করা হয়। খুনি রিসালদার মোসলেহ উদ্দিন পালিয়ে যান। সর্বশেষ ২০১৮ সালে সে দেশে এসে পরিবারের সঙ্গে কয়েকদিন ছিলেন বলেও বিভিন্ন গণমাধ্যমের খবরে বলা হয়েছে।
ক্যাপ্টেন আব্দুল মাজেদের মাধ্যমে রিসালদারের খোঁজ: বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনী ক্যাপ্টেন (বরখাস্ত) আব্দুল মাজেদ পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হবার পর গোয়েন্দাদের জিজ্ঞাসাবাদে মোসলেহ উদ্দীন সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য জানায়। এসময় গোয়েন্দারা মোসলেহ উদ্দীনের স্ত্রী ও সন্তানদের জিজ্ঞাসাবাদ করে। তার অবস্থান সম্পর্কে নিশ্চিত হয় গোয়েন্দারা। তবে হঠাৎ করেই নিখোঁজ হন মোসলেহ উদ্দীন। উত্তর চব্বিশ পরগনার ঠাকুরনগর রেলস্টেশন এলাকায় অপরিচিত কিছু ব্যক্তির সাথে তাকে সর্বশেষ দেখা যায়।
গত ৭ এপ্রিল মিরপুরের বাসা থেকে মাজেদকে গ্রেপ্তার করে আইনশৃঙ্খলাবাহিনী। মার্চে তিনি ভারত থেকে দেশে আসেন। ১১ এপ্রিল রাতে তাকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হয়। মাজেদের সঙ্গে ভারতে নিয়মিত যোগাযোগ ছিল খুনি রিসালদারের।
রিসালদার নাম বদলে রফিকুল ইসলাম:
বিভিন্ন গণমাধ্যমে খবর এসেছে, বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনি রিসালদার মোসলেহ উদ্দিন নিজের নাম-পরিচয় বদলে ফেলেছেন। তার নতুন নাম রফিকুল ইসলাম খান। পরিবারের সদস্যরা বর্তমানে এ নামেই তার পরিচয় দেয়। তাঁর ছেলে-মেয়ে ও পুত্রবধূ নতুন নামেই তাদের বাবার পরিচয় দিচ্ছে। এমনকি তাদের পিতার নামের স্থানে রফিকুল ইসলাম খানের নামেই পরিবারের সব সদস্য জাতীয় পরিচয়পত্র পান।
ভারতে বসবাস:
দীর্ঘদিন উত্তর চব্বিশ পরগনার গোবরডাঙ্গার ঠাকুরনগর এলাকার চাঁদপাড়া রোডের একটি বাড়িতে বসবাস করতেন মোসলেহউদ্দীন। এই এলাকায় ডাক্তার দত্ত নামে পরিচিত ছিলেন এবং ‘ইউনানী ফার্মেসী’ নামে একটি প্রতিষ্টানে আয়ুর্বেদ ও হোমিও চিকিৎসা করতেন। ঠাকুরনগর রেলস্টেশনের এক নম্বর প্লাটফরমের পিছনে একটি বাড়িতে তার নিয়মিত যাতায়াত ছিল। ওই বাড়ির একটি মেয়েকে তিনি নিজ খরচে বিয়ে দিয়ে সহযোগিতা করেন। দীর্ঘদিন তিনি ওই এলাকায় বসবাস করছিলেন।
এদিকে গত ১২ এপ্রিল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল গণমাধ্যমকে জানিয়েছিলেন, বঙ্গবন্ধু হত্যায় পলাতক পাঁচ আসামির মধ্যে দুইজন গোয়েন্দাদের নজরদারিতে রয়েছে। তাদের বিষয়ে সুনির্দিষ্ট তথ্য সরকারের কাছে আছে। তাদের দেশে ফিরিয়ে আনতে সর্বোচ্চ চেষ্টা চলছে বলেও জানান তিনি।
তবে রিসালদার মোসলেহ উদ্দিন গ্রেপ্তার হয়েছে কি-না সে বিষয়টি তিনি এখনো নিশ্চিত করে বলতে পারেননি।
বাকি আসামিরা কোথায়?
বঙ্গবন্ধুকে স্বপরিবারে হত্যার ৩৪ বছর পর ২০০৯ সালের ১৯ নভেম্বর বর্বরোচিত এই হত্যাকাণ্ডের বিচার শুরু হয়। খুব ধীরে দীর্ঘ বারো বছরে নিম্ন আদালত থেকে শুরু করে আইনের প্রতিটি ধাপ স্বচ্ছতার সঙ্গে অতিক্রম করে সর্বোচ্চ আদালতের মাধ্যমে স্বঘোষিত খুনিদের মৃত্যুদণ্ডের রায় দেওয়া হয়।
মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ১২ আসামির মধ্যে কারাবন্দি পাঁচ আসামির ২০১০ সালের ২৮ জানুয়ারি দিবাগত রাতে ফাঁসি কার্যকর হয়। তারা হলেন- সৈয়দ ফারুক রহমান, সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খান, মুহিউদ্দিন আহমেদ, বজলুল হুদা ও এ কে এম মহিউদ্দিন আহমেদ। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত অন্য ছয় আসামি পলাতক ছিলেন। তাদের মধ্যে আবদুল মাজেদকে ৭ এপ্রিল গ্রেপ্তার হন এবং ১১২এপ্রিল ফাঁসির রায় কার্যকর হয়।
পলাতক বাকি পাঁচজনের মধ্যে লে. কর্নেল (অব.) খন্দকার আব্দুর রশিদ (বরখাস্ত) লিবিয়া ও বেলজিয়ামে অবস্থান করছেন। বেশিরভাগ সময় লিবিয়াতে থেকেই ব্যবসা-বাণিজ্য করছেন। লে. কর্নেল (অব.) শরীফুল হক ডালিম (বরখাস্ত) পাকিস্তানে অবস্থান করছেন বলে জানা গেছে। লে. কর্নেল (অব.) এ এম রাশেদ চৌধুরী (বরখাস্ত) যুক্তরাষ্ট্রের লস অ্যাঞ্জেলেসে, লে. কর্নেল (অব.) এন এইচ এমবি নূর চৌধুরী (বরখাস্ত) কানাডায় রয়েছেন। আর রিসালদার মোসলেম উদ্দিন ভারতের ছিলেন বলে তথ্য ছিল আগে থেকে।