অন্যরকম একটা পৃথিবী দেখছে বিশ্বের ৭৫৫ কোটি মানুষ। যে বিশ্বের দুই শতাধিক দেশের জীবনযাত্রা এক সুতোয় গাঁথা। লকডাউন, কোয়ারেন্টিন, আইসোলেশন, সোশ্যাল ডিসট্যান্সিং- এসব তাদের ভাষা। ‘স্টে হোম, স্টে সেফ’ তাদের নীতি। চলাফেরা, অবসর কাটানো এমনকি জীবনের অন্যান্য কাজগুলোও হয়তো একই রকম। পৃথিবীর তাবড় তাবড় দেশও আজ তাদের অর্থনীতি নিয়ে তটস্থ। চীন থেকে ইতালি, ইতালি থেকে যুক্তরাষ্ট্র- কেউই বাদ যাচ্ছে না এই তালিকা থেকে। এ সবই প্রাণঘাতী কোভিড-১৯ তথা করোনাভাইরাসের প্রভাব। যাই হোক, আমি বৈশ্বিক পরিস্থিতির দিকে যাব না। আমি আমার প্রসঙ্গে ফিরি।
গত ১৮ মার্চ বাংলাদেশ ও ভারতে একই ধরণের পৃথক দুটি সংবাদ ভাইরাল হয়। একই ধরণের এ কারণে বলছি, উভয় সংবাদই ধর্মীয় বিশ্বাসের সঙ্গে সম্পর্কিত। এর মধ্যে বাংলাদেশের সংবাদটি ছিল ‘ব্রাহ্মণবাড়িয়া এক ইসলামী বক্তার জানাজায় বহু মানুষের ভিড়’ (বিবিসি বাংলা); অন্যদিকে ভারতীয় সংবাদ হলো ‘লকডাউন শিকেয়ে, ষাঁড়ের শেষযাত্রায় কয়েকশো মানুষের জমায়েত!’ (আনন্দবাজার পত্রিকা)।
প্রকৃতপক্ষে, প্রথা-বিশ্বাস-ধর্ম- এই তিনটি বিষয়ের মধ্যে বড় একটি মিল রয়েছে। কার্য সম্পাদনের ক্ষেত্রে প্রতিটির রাজধর্মই হলো- বিজ্ঞানসম্মত বা যুক্তিসই হোক বা না হোক, এগিয়ে চলা। হয়তো এ কারণেই যুক্তরাষ্ট্রের থিওলজিক্যাল সেমিনারির উ”চপদস্থ এক যাজক লিখে গিয়েছেন, “অসংখ্য লোক রয়েছেন, যারা ‘এক ধর্মীয় বিশ্বাসে’ বিশ্বাসী এবং যারা নিজেদের যুক্তি করার ক্ষমতাকে কাজে না লাগানোর জন্য ধর্ম পালন করে। তারা প্রমাণ ছাড়াই সবকিছুকে সহজে বিশ্বাস করে নেয়।’’
কথাগুলো বলার উদ্দেশ্য হলো- ধর্মের প্রতি মানুষ উন্মাদ। সে মানুষ মুসলিম হোক, হিন্দু হোক, কিংবা বৌদ্ধ-খ্রীষ্টান-জৈন। আর এ কারণেই করোনায় উদ্ভূত পরিস্থিতিতে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় মাওলানা যুবায়ের আহমেদ আনাসারীর জানাজায় স্রোতের মতো জড়ো হওয়া যেমন লাখো মানুষের কাছে গর্হিত কাজ মনে হয়নি; তেমনি ভারতের তামিলনাড়ুতেও গায়ে গা লাগিয়ে ষাঁড়ের শেষকৃত্যে যোগ দেয়াকে কারো মধ্যে অপরাধবোধ তৈরি হয়নি। হ্যাঁ, আমি উভয় কাজেই দুই ধর্মের মানুষের আবেগকে সমর্থন করি; কিন্তু বৈশ্বিক মহামারীকালে সেই আবেগের প্রকাশভঙ্গি তারা যেভাবে দেখিয়েছেন, সেটা নিঃসন্দেহে দুর্ভাগ্যজনক।
যাই হোক, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ঘটনার পর সার্কেল সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) ও ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে (ওসিকে) প্রত্যাহার করা হয়েছে। চট্টগ্রাম রেঞ্জেরে অতিরিক্ত ডিআইজিকে প্রধান করে তিন সদস্যবিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। প্রাথমিকভাবে বিবিসির খবর থেকে যতটুকু জানা যাচ্ছে তা হলো ‘মাওলানা আনসারীর ওই জানাজায় এলাকার স্থানীয় মানুষ কম অংশ নিয়েছেন। বেশিরভাগ এসেছেন হবিগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ ও নরসিংদী থেকে। কারণ এই হুজুরের বেশিরভাগ সমর্থক হাওর এলাকার গ্রামগুলো। এসব এলাকায় বছরের বেশিরভাগ সময় নৌকা চলাচল করে। এই ব্যক্তিরা নৌকায় করে এই সমাবেশে এসেছিলেন।… আবার অনেকে পিক-আপ, ভ্যানগাড়ি, ইজি বাইক, সাইকেল চালিয়ে ভিন্ন ভিন্ন জেলা থেকে জানাজায় এসেছেন। কিন্তু এ সময় তাদের মহাসড়কে কোন বাঁধা দেয়া হয়নি।’
আসলে আমার কাছে মনে হয়, পুরো ব্যাপারটাই যেন ‘অন্নদামঙ্গল’ কাব্যে ভারতচন্দ্র রায় গুণাকরের বক্তব্যের মত হয়ে দাঁড়িয়েছে- নগর পুড়িলে কি দেবালয় এড়ায়? সাধারণ ছুটি পেয়ে বাস-ট্রেন-লঞ্চসহ সব ধরনের গণপরিবহণে ঠেসে বাড়ি যাওয়া; আচমক গার্মেন্ট খোলার সিদ্ধান্তে পোশাক শ্রমিকদের দল বেঁধে ঢাকায় আসা ও ফিরে যাওয়া; হাজার হাজার মানুষের সমাগম দিয়ে সকালের কারওয়ান বাজার শুরু হওয়া; দূরত্ব তো দূরে থাক, হুমড়ি খেয়ে একযোগে সরকারি-বেসরকারি ত্রাণ সংগ্রহ করা- এ সবই তো আমাদের ফেনীতে শত মানুষের দোয়া মাহফিল, যশোরে ৫ শতাধিক লোকের সমাগমে ধুমধামের বিয়ে এবং সর্বশেষ ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় হাজার হাজার মানুষকে জড়ো করতে উৎসাহ যুগিয়েছে।
আসলে জানাজা এবং অন্যান্য গণজমায়েতে কেন হচ্ছে; কোন এলাকায় বেশি হচ্ছে, কোন এলাকায় কম; জনস্রোত ঠেকাতে প্রশাসন কী করতে পারত, কী করছে না; স্থানীয় রাজনীতিবিদ কিংবা গণ্যমান্য ব্যক্তিদেরই-বা করণীয় কী- ধর্মীয় গোঁড়ামি কিংবা সামাজিকতার উন্মাদনায় এসব প্রশ্নের উত্তর খোঁজা আমার উদ্দেশ্য নয়। তাছাড়া অন্তত ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ক্ষেত্রে সেই উত্তর খোঁজার সময় চলেও গেছে। তবে একটা বিষয় এখনও চলছে দেদারছে; আর তা হলো- ব্রাহ্মণবাড়িয়া নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে চলা অগণিত মানুষের ‘অঘোষিত যুদ্ধ’। ফেসবুক খুললেই ভেসে উঠছে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মানুষ ‘ঝগড়াটে’, ‘বর্বর’, ‘অশিক্ষিত’সহ নানা অসংখ্যা বিদ্রুপ-গালিগালাজ। যে বিদ্রুপ থেকে নিজেকে বিরত রাখতে পারছেন না বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, নামকরা সাংবাদিক, টকশো ব্যক্তিত্বসহ নাম-পেশা না জানা অনেকে। ব্যাপারটা এমন হয়ে দাঁড়িয়েছে যে, নির্দিষ্ট এ জেলার সম্মানহানির প্রশ্নে যেন সবাই একতার মিছিল গড়েছি।
হ্যাঁ, মানছি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ঘটনা ছোট নয়; কিন্তু ফ্লু জাতীয় ভাইরাসের ক্ষেত্রে একজন ব্যক্তির লকডাউন অমান্যও কি কাম্য? নিশ্চয়ই না। আমাদের মনে রাখতে হবে, গোটা বিশ্বের ২৫ লাখ মানুষের শরীরে ঘুরে বেড়ানো এই ভাইরাসের সংক্রামক কিন্তু একজনই। যদিও নিয়ম না মানায় শুধু ঢাকা শহরেই সম্প্রতি তিন হাজার ৪৪৫টি মামলা হয়েছে (১৭ এপ্রিল পর্যন্ত)। জরিমানা আদায় করা হয়েছে ৬৩ লাখ ৪১ হাজার টাকা।
জাতির চরম এই বিপর্যয়ের মুখে এখনও পত্রিকায় আগের মতই অগণিত নেতিবাচক খবর পড়তে হয়। ‘দুই গ্রামবাসীর কয়েক ঘন্টাব্যপী রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ (সঙ্গত কারণেই জেলা ও উপজেলা উহ্য)’; গণধর্ষণ শেষে জঙ্গলে ফেলে রাখা কিংবা ফেসবুকে লাইভ করে স্ত্রীকে জবাই করার ঘটনা ঘটেছে। অথচ অনেক ক্ষেত্রে এসব ঘটনার জেলা-উপজেলার নাম তো তো দূর, ঘটনাটাই ঠিকমত জানিনা।
যাই হোক, এসব কথা বলার উদ্দেশ্য ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ঘটনাকে জায়েজ করা কিংবা কাউকে ছোট করা নয়, বরং ভালো-মন্দ মিলিয়েই গড়ে উঠেছে বাংলাদেশের বিভাগ-জেলা-উপজেলাগুলো। তাই আঞ্চলিকতার প্রশ্নে কেউ কাউকে তিরস্কার করবে; নিশ্চয়ই এটা কাম্য নয়। আসলে স্যাটায়ারের (ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ) চর্চা যখন সিরিয়াসলি শুরু হয়, তখন এর চেয়ে অসহায়ত্ব-বিড়ম্বনা আর থাকে না। তাছাড়া স্যাটায়ার বোঝার মানসিক পরিপক্বতাও সবসময় সবার মাঝে থাকে না। ফলে পরিচিত-অপরিচিতজনের মাঝে তিক্ততা বাড়ে, সমাজ-সামাজিকতায় অশান্তি তৈরি হয় এমনকি অনেক সময় তা খুনোখুনিতে গিয়ে ঠেকে। মামলা-মোকদ্দমার ঘটনা তো ইতোমধ্যেই ঘটেছে। আসলে নিজের সম্মানটা অটুট রেখে স্যাটায়ারকে (বিদ্রুপ) হেসে উড়িয়ে দিতে হয়। কিন্তু গত ক’দিন ধরেই ব্রাহ্মণবাড়িয়া নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যা চলছে; চাইলেই কি তা হেসে উড়ানো যায়? আমার তো তা মনে হয় না।
বাংলাদেশের ‘সাংস্কৃতিক রাজধানী’ হলো ব্রাহ্মণবাড়িয়া। সংগীত, শিল্প ও সংস্কৃতি সাহিত্যের পীঠস্থানরূপে পরিচিতি পেয়েছে এই জেলা। উল্লেখ করতেই হয়- সংগীতজ্ঞ ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ,অন্নপূর্ণা দেবী, সৈয়দ আব্দুল হাদী, ভাষাসৈনিক ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত, ঔপন্যাসিক অদ্বৈত মল্লবর্মণ, কবি আল মাহমুদ, বারো ভূঁইয়া নেতা ঈসা খাঁ-সহ অসংখ্য জ্ঞানী-গুণীর জন্মও এই তিতাস বিধৌত ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়।
প্রতিটি অঞ্চলেরই নিজস্ব একটা বৈশিষ্ট্য আছে, থাকবে। কোন এক বইয়ে পড়েছিলাম, প্রতি সাত কিলোমিটার অন্তর অন্তর মানুষের আচরণ-স্বভাব ও সামাজিকতায় পরিবর্তন থাকে। ব্রাহ্মণবাড়িয়া আপনার জেলার মত হতে পারবে না, আবার আপনার জেলাও ব্রাহ্মণবাড়িয়া হতে পারবে না। অঞ্চলভেদে ভালো খারাপের পরিমাণগত পার্থক্যও থাকতে পারে। তাই বলে স্যোশাল মিডিয়ায় ‘তুই ব্রাহ্মণবাড়িয়া’ ধরণের তুচ্ছাতিতুচ্ছ বিদ্রুপ নিশ্চয়ই আমাদের পরিহার করা উচিত। কারণ, যদি প্রশ্ন করি- ওইদিন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সন্তান মাওলানা যুবায়ের আহমেদ আনাসারী না হয়ে তার মত কিংবা তার চেয়েও জনপ্রিয় অন্য জেলার কোনো ইসলামী বক্তা কিংবা সম্মানিত ব্যক্তি মারা যেতেন; তাহলে সেই জেলায় এমন জনস্রোত হত না; সেই নিশ্চয়তা কি দেওয়া যায়?
লেখক: উপাচার্য, গ্রিন ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ