করোনা ভাইরাসে প্রথম ৬০ দিনের হিসেবে বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশে সংক্রমিতের হার বেশি। আবার, সুস্থতার হারে বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত ১০টি দেশের সুস্থতার হারের ধারে কাছেও নেই বাংলাদেশ।
চিকিৎসকদের আক্ষেপ, চীনে করোনা আক্রান্ত হওয়ার ঘটনা জানার পর তিন মাস সময় পেয়েছি আমরা। এরপরও লকডাউন যদি যথাযথভাবে বাস্তবায়ন হতো তাহলে সংক্রমণের হার নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হতো।
আইইডিসিআর এর তথ্য অনুযায়ী, গত ৮ মার্চ দেশে প্রথমবারের মতো একইসঙ্গে তিনজন কোভিড আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়। তার ঠিক দুইমাস অর্থাৎ ৬০ দিনের মাথায় গত ৬ মে শনাক্ত হন ৭৯০ জন আর মারা যান তিনজন। সেদিন পর্যন্ত এটাই ছিল দেশে একদিনে সর্বোচ্চ শনাক্ত হওয়া রোগী সংখ্যা।
সেদিন পর্যন্ত মোট রোগী শনাক্ত হন ১১ হাজার ৭২৯ জন, মারা যান ১৮৬ জন। এবং সুস্থ হন এক হাজার ৪০২ জন। যদিও সেটা অবশ্য মোট করোনা আক্রান্তের সংখ্যা প্রথম ৬০ দিনের হিসেবে বিশ্বের অন্যান্য সর্বাধিক সংক্রমিত দেশের তুলনাতে বেশি।
৬০ দিনে বাংলাদেশে করোনা রোগী সংক্রমণের সংখ্যা ওই একইসময় বিবেচনা করলে যুক্তরাজ্য ও রাশিয়ার চেয়ে বেশি এবং প্রায় যুক্তরাষ্ট্রের কাছাকাছি পৌঁছে যায়।
ওয়াল্ডোমিটারের হিসেব মতো, প্রথম ৬০ দিনে যুক্তরাষ্ট্রে করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ছিল ১৩ হাজার ৮৯৮ জন, আর যুক্তরাজ্য এবং রাশিয়াতে ছিল যথাক্রমে আট হাজার ৭৭ ও এক হাজার ৮৩৬ জন।
১১ মে পাওয়া গত ২৪ ঘণ্টার তথ্য অনুযায়ী, দেশে নতুন করে কোভিড-১৯ আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়েছেন এক হাজার ৩৪ জন, আর মারা গেছেন ১১ জন। দেশে মোট শনাক্ত হওয়া রোগীর সংখ্যা ১৫ হাজার ৬৯১ জন। ৬৪ জেলায় ইতোমধ্যে কোভিড আক্রান্ত রোগী ছড়িয়ে গেছে।
শুরুতে দেশের একটি ল্যাবরেটরিতে কোভিড-১৯ এর নমুনা পরীক্ষা হলেও রাজধানী ঢাকা এবং ঢাকার বাইরে মোট ৩৭টি ল্যাবে এখন নমুনা পরীক্ষা হচ্ছে। ১১ মে পাওয়া গত ২৪ ঘণ্টার তথ্য অনুযায়ী, দেশের ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষা হয়েছে সর্বোচ্চ সাত হাজার ২০৮ জনের নমুনা।
সুস্থতার হারেও পিছিয়ে
সুস্থতার হারে বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত ১০টি দেশের সুস্থতার হারের কাছে ধারেও নেই বাংলাদেশ। ভয়াবহ এই তথ্যটিই প্রমাণ করে দেশে কোভিড নিয়ে সরকারের সচেতনতা ও সংবেদনশীলতার মাত্রাকে।
গত ৫ মে পর্যন্ত দেশে সুস্থতার হার ছিল ২৪ দশমিক ৫৬ শতাংশ। যা কিনা করোনায় বহির্বিশ্বে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত ইতালির অর্ধেকেরও কম! ইতালিতে করোনাআক্রান্ত প্রথম ৬০ দিনে সুস্থতার হার ছিল ৫৫ দশমিক ৭৫। অন্যদেশগুলোতে একই সময়ে সুস্থতার হার ইতালির চেয়েও বেশি।
তুলনামূলক মৃত্যুর চিত্র
করোনার প্রাদুর্ভাব দেখা দেওয়ার প্রথম ৬০ দিনের পর্যবেক্ষণে মৃত্যুর ঘটনা ছিল রাশিয়াতে সবচেয়ে কম। সেখানে মারা গিয়েছিলেন ৯ জন। একই সময়ে যুক্তরাষ্ট্রে দ্বিতীয় সর্বনিম্ন মারা যান ২৩৯ জন। এরপর জার্মানিতে ২৬৭ জন।
আর বাংলাদেশে একই সময়ে মারা গেছেন ১৮৬ জন। এই সংখ্যা রাশিয়ার চেয়ে বেশি তবে যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে কম। ফলে করোনায় সর্বাধিক আক্রান্ত দেশগুলোর মধ্যে প্রথম ৬০ দিনে মৃত্যুর সংখ্যায় দ্বিতী সর্বনিম্ন অবস্থান এখন বাংলাদেশের।
পরিসংখ্যানের এই তথ্যটি খানিকটা স্বস্তিদায়ক হলেও বাস্তবে অভিযোগ হচ্ছে জেলা হাসপাতালগুলোতে সীমিত যন্ত্রপাতি ও অপর্যাপ্ত জনবলের কারণে জটিল রোগীদের প্রয়োজনীয় চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব হয়নি। তা সম্ভব হলে মৃত্যুর এই হার আরও কমানো সম্ভব ছিল।
এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশের বেশিরভাগ কোভিড ডেডিকেটেড হাসপাতালে ট্রায়াজ ব্যবস্থাপনা সুচারুভাবে না মানা, আইসিইউগুলোতে ভেন্টিলেশন ব্যবস্থার অভাব এবং রোগীর বিভিন্ন জটিলতায় প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক না থাকার বিষয়টি এ দেশের স্বাস্থ্য খাতের ব্যবস্থাপনার সীমাবদ্ধতা ও যথাযথ নজরদারির অভাবকে স্পষ্ট করে তুলেছে। প্রসঙ্গত বাংলাদেশে করোনাতে প্রথম মৃত্যু হয় গত ১৮ মার্চ।
আবার পরিসংখ্যান অনুযায়ী, আমেরিকাতে সংক্রমণের সংখ্যা ১১ হাজার হতে সময় লেগেছে ৬০ দিন, যুক্তরাজ্যে ৬২ দিনে সে সংখ্যা হয়েছে আর রাশিয়াতে ১১ হাজার রোগী হয়েছে ৭১ দিনে। অন্যদিকে, ফ্রান্সে ১১ হাজার রোগী হয়েছে ৫৭ দিনে, তুরস্কে ২১ দিনে।
দেশে গত ৮ মার্চ রোগী শনাক্ত হওয়ার পর থেকে ৩১ মার্চ পর্যন্ত রোগী সংখ্যা ছিল ৫১জন, এপ্রিলে সেটা ছিল ১৫০ জন। মে মাসের প্রথম পাঁচ দিনে তিন হাজার ২৬২ জন শনাক্ত হন। অর্থাৎ গড়ে প্রতিদিন ৬৫০ জন করে সংক্রমিত হয়েছেন। ৮ মার্চ তিনজন শনাক্ত হওয়ার পর বাংলাদেশের এক হাজার রোগীর সংখ্যা অতিক্রম করতে সময় লেগেছে মাত্র ৩৮ দিন এবং তার ঠিক চারদিন পর ১৮ এপ্রিল আক্রান্তের সংখ্যা দুই হাজার অতিক্রম করেছে।
জানতে চাইলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম গণমাধ্যমকে বলেন, সংক্রমণের হার বেশি হয়েছে চীন থেকে আসা ৩১২ জনকে হোম কোয়ারেন্টিনে পাঠিয়ে দেওয়ার ঘটনায়। তাদের বাড়িতে পাঠানো হয়েছে। কিন্তু সেটা কতোটা কার্যকর হয়েছে সেটা বড় প্রশ্ন। আমি স্পষ্ট করে বলতে চাই, তাদের হোম কোয়ান্টিনে কার্যকর হয়নি বলেই সংক্রমণের হার বেড়েছে।
তিনি বলেন, টোলারবাগে লকডাউন ঠিকমতো করাতে সেটা কন্টেন্ট হয়েছে কিন্তু তারপর আর কোথাও লকডাউন ঠিকমতো হয়নি। যার কারণে ঢাকা সিটিতে যথেষ্ট সংক্রমণ হয়েছে,সেখান থেকে ছড়িয়েছে পুরোদেশে।
লকডাউন ঠিকমতো কন্ট্রোল করতে পারলে এই সংক্রমণ হতো না, বলেন অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম।