এ ধরনের অমানবিকতা বড় বেদনাদায়ক ।। আহমদ রফিক

আহমদ রফিক
আহমদ রফিক। ফাইল ছবি

খাদ্য, আবাসন, বস্ত্র, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ইত্যাদি কিছু মৌলিক মানবিক অধিকারের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ স্বাস্থ্যসেবা, সুস্পষ্ট ভাষায় চিকিৎসাসেবা, যা রোগাক্রান্ত মানুষকে মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করে। খাদ্যাভাবে মৃত্যু কিছুটা দীর্ঘ প্রক্রিয়া—কিন্তু বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে চিকিৎসাসেবার অভাব তাত্ক্ষণিক মৃত্যুর কারণ। এটা নিত্য অভিজ্ঞতা।

আপাতত সমগ্র বিশ্ব করোনাভাইরাসজনিত মহামারি নিয়ে শুধু ভীত ও আতঙ্কিতই নয়, করোনা রোগী শনাক্তকরণ ও চিকিৎসা নিয়ে মহাব্যস্ত উদ্বেগ-উত্কণ্ঠা নিয়ে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া অর্থাৎ চীন, কোরিয়া, ভিয়েতনাম থেকে ইউরোপ এখন কিছুটা স্বস্তির মুখে, যদিও প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের খেয়ালিপনার কারণে যুক্তরাষ্ট্রে এখনো করোনা আক্রমণ ও মৃত্যু ঊর্ধ্বমুখী।
তেমনি ভারত। এমনকি বাংলাদেশ। তবে বাংলাদেশের জনসংখ্যার তুলনায় শনাক্ত রোগীর সংখ্যা প্রকৃত মহামারির রূপ ধারণ করেনি। কিন্তু করতে কতক্ষণ? তার মূল কারণ—এ পর্যন্ত বহু লিখিত, বহু কথিত এ বিষয়ে অব্যবস্থাপনা ও সমন্বয়হীনতা। তাই দেখা যাচ্ছে, প্রতিদিনই করোনায় আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে, মৃত্যুর সংখ্যাও বাড়ছে।

universel cardiac hospital

প্রতিদিনের দৈনিক পত্রিকায় একই খবর—করোনার আক্রমণ বেড়ে চলেছে। সেই সঙ্গে চলছে এ সম্পর্কে ইতিবাচক-নেতিবাচক আলোচনা, সমালোচনা ও লেখালেখি। কারণ নিয়ে, ব্যবস্থাপনা নিয়ে।

এসব নিয়ে একটি দৈনিকের সম্পাদকীয় স্তম্ভে লেখা হয়েছে : ‘বাংলাদেশে স্বাস্থ্যসেবা খাতে সমন্বয়হীনতা, পেশাদারির অভাব ও নিয়ন্ত্রণহীনতা শুধু করোনা চিকিৎসা নয়, সামগ্রিকভাবে চিকিৎসাসেবাকে হুমকির মুখোমুখি করে তুলেছে।’ অর্থাৎ করোনা আতঙ্কের কারণে হোক বা অন্য যেকোনো কারণে হোক, অন্যান্য জটিল ও গুরুতর রোগে আক্রান্ত রোগী সবাই চিকিৎসা পাচ্ছে না—মানুষ তার মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।

দুই.

এই প্রবণতা সর্বাধিক বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলোতে; এবং এ ঘটনা আজকের নয়, করোনা সংক্রমণের শুরু থেকেই এজাতীয় ঘটনার খবর সংবাদপত্রে প্রকাশিত হচ্ছে, এ বিষয়ে লেখালেখি হচ্ছে, স্বাস্থ্য বিভাগের প্রতি আবেদন জানানো হচ্ছে; কিন্তু তাতে অবস্থার বিশেষ কোনো উন্নতি হয়েছে বলে মনে হয় না। হলে আজকে যে অমানবিক ঘটনা উপলক্ষে এ লেখা, তা লিখতে হতো না।

খবরটি আমাকে গভীরভাবে বেদনাহত করেছে : ‘সাত হাসপাতাল ঘুরে বিনা চিকিৎসায় মৃত্যু’/অতিরিক্ত সচিব গৌতম আইচ’। তাঁর মেয়ে ডাক্তার ‘সুস্মিতা আইচ’।

সরকারের একজন উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তার যদি চিকিৎসার অভাবে বেহাল দশায় করুণ মৃত্যু ঘটে, তো অনুমান করতে পারি এ সময় আমাদের মতো সাধারণ মানুষ হঠাৎ গুরুতর রোগে আক্রান্ত বলে তাদের অবস্থা কী হতে পারে। তিনি অবশ্য শেষ মুহূর্তে কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি হতে পেরেছিলেন, কিন্তু ততক্ষণে অবস্থা নিয়ন্ত্রণের বাইরে। অতএব, মৃত্যু।

পাঠক, ভাববেন না প্রয়াত মি. আইচ অতিরিক্ত সচিব বিধায় এ কথাগুলো বলছি। না, বলছি এ কারণে যে তিনি একজন রোগাক্রান্ত মানুষ, যথাসময়ে সঠিক চিকিৎসাসেবা পেলে হয়তো বা বেঁচেও যেতে পারতেন। একজন চিকিৎসকের পিতা হিসেবেও তাত্ক্ষণিক চিকিৎসার মানবিক অধিকারটুকু তাঁর প্রাপ্য ছিল। তিনি তা পাননি।

ইতিমধ্যে এক চাকমা তরুণ থেকে একাধিক বিভিন্ন সম্প্রদায়ভুক্ত নর-নারী করোনা-বহির্ভূত রোগ নিয়ে বেসরকারি হাসপাতালের দ্বারে দ্বারে ঘুরে চিকিৎসা না পেয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন। সংবাদপত্রে এ খবরগুলো পড়ে মর্মাহত হয়েছি, এ বিষয়ে আমার দু-একটি লেখাও প্রকাশিত হয়েছে।

আমরা স্বাস্থ্য বিভাগের প্রতি আহ্বান জানিয়েছি, যাতে এ ধরনের করুণ বিয়োগান্ত ঘটনা আর না ঘটে, সে ব্যাপারে সুষ্ঠু ব্যবস্থা নিতে। প্রয়োজনে বর্তমান বিশেষ পরিস্থিতিতে অন্য রোগীদের সুষ্ঠু চিকিৎসাসেবা-সংক্রান্ত সাময়িক নীতি প্রণয়ন জরুরি বলে মনে হয়, যা বিশেষভাবে বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলোর ক্ষেত্রে প্রয়োজন হবে। ইতিমধ্যে করোনা রোগীর চিকিৎসার জন্য কয়েকটি হাসপাতাল সুনির্দিষ্ট করা হয়েছে। দরকার সেখানে সুদক্ষ চিকিৎসাসেবার জন্য পর্যাপ্ত উপকরণাদি সরবরাহ।

তিন.

সন্দেহ নেই, বর্তমান পরিস্থিতিতে অর্থাৎ করোনা মারিতে করোনাক্রান্ত রোগী চিকিৎসাক্ষেত্রে অগ্রাধিকার পাবে (এর জন্য আলাদা ব্যবস্থা রয়েছে), কিন্তু তা অন্য গুরুতর অবস্থার রোগী বা যেকোনো রোগীকে অবহেলায়, বিনা চিকিৎসায় ফেলে রেখে নয়।

এটা চিকিৎসাশাস্ত্রের নিয়মনীতি-বহির্ভূত, সেই সঙ্গে মানবিক রীতিনীতি-বহির্ভূতও বটে। মৃত্যুর গুরুত্ব সর্বত্র একই মাত্রার, তা সে করোনার আক্রমণে হোক বা অন্য কোনো মারাত্মক রোগের গুরুতর আক্রমণে হোক। তাই চিকিৎসাসেবা নীতিগতভাবে সবার জন্য একই পাল্লায় নির্ধারিত হয়। যদিও আমরা জানি, করোনার মতো মহামারিজাতীয় রোগের চিকিৎসা ব্যবস্থাপনা মারিতাত্ত্বিক, সামাজিক কারণে অধিক গুরুত্ব পায়। পায় এর বিস্তারপ্রবণতা ও অধিকতর সংখ্যায় মৃত্যুর কারণে। আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় চিকিৎসাসেবার এই সব নীতিগত ও বস্তুগত দিকে ঘাটতি রয়েছে। বিশেষ করে উন্নত দেশগুলোর স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ও চিকিৎসাসেবার মান ও বিশেষভাবে পেশাদারির সঙ্গে বিচারে। কিন্তু দুঃখজনক ঘটনা হলো, এদিকে স্বাস্থ্য বিভাগের যথেষ্ট ব্যবস্থাপনা ও নজরদারি আছে বলে মনে হয় না।

এ প্রসঙ্গে আমার একটি ব্যক্তিগত ধারণার কথা বলি (তা ভুলও হতে পারে)। আমাদের চিকিৎসাভুবনে দক্ষতার যত না অভাব আছে, তার চেয়ে তুলনামূলক অভাব পেশাদারি মনোভাবের। এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম আছে জানি, তবু সাধারণ হিসাবে সুষ্ঠু পেশাদারির ক্ষেত্রে ঘাটতিটা বড়। সেই সঙ্গে সদিচ্ছার বিষয়টিও জড়িয়ে আছে।

চিকিৎসা পেশা যেহেতু মানুষের জীবন-মরণ সমস্যার সঙ্গে জড়িত, তাই এর মানবিক গুরুত্ব জীবিকার ঊর্ধ্বে। আমাদের দেশে স্বাস্থ্য খাতে বড় সমস্যা হলো, বেসরকারি খাতে চিকিৎসাব্যবস্থায় তার নীতি-আদর্শের চেয়ে বাণিজ্যিক চরিত্র বড় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এবং এটা দীর্ঘদিন থেকে।

এ ক্ষেত্রে দরকার স্বাস্থ্য বিভাগের কঠোর ও কঠিন নিয়ন্ত্রণ। দুর্বোধ্য কারণে এ নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রটিতে শিথিলতা রয়েছে। বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর স্বাস্থ্য ও চিকিৎসাসেবার সঙ্গে তুলনা করলে তা বোঝা যায়। আমাদের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলো কি উত্থাপিত বিষয়গুলো খতিয়ে দেখবে এবং ব্যবস্থা নেবে ঘটিত মৃত্যুগুলোর প্রতি মানবিক সুবিচারের কথা ভেবে?

সব শেষে একটি অপ্রিয় কথা, (যা নাকি বলতে নেই)—খাদ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিবের যেসব হাসপাতালের অবহেলায় মৃত্যু হলো, তার জন্য কি একটি সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ তদন্ত হওয়া উচিত নয়, এবং পূর্বোক্ত অনুরূপ অন্য মৃত্যুগুলোরও, এবং তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা গ্রহণ? যাতে এজাতীয় অমানবিক প্রবণতার প্রকাশ হাসপাতালগুলোতে বন্ধ হয়।

লেখক : কবি, গবেষক, ভাষাসংগ্রামী

শেয়ার করুন

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে