বিশ্বের শীর্ষ ধনী ও মাইক্রোসফটের প্রতিষ্ঠাতা বিল গেটস ২ বছর আগে মহামারি নিয়ে এক ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন। ২০১৮ সালে সেই ভবিষ্যদ্বাণীতে বিল গেটস বলেছিলেন, ‘শিগগির মহামারি আকারে এমন একটি সুপার ভাইরাস ছড়িয়ে পড়বে যার আক্রমণে প্রথম ছয় মাসে বিশ্বজুড়ে ৩৩ মিলিয়ন মানুষ মারা যাবে।’ সত্যিই অতি দ্রুত এলো মরণঘাতী করোনাভাইরাস।
ভাইরাস থেকে মুক্ত থাকতে নানা ধরনের সর্তকতা অবলম্বন করে এসেছেন বিল গেটস। বিশ্বকে দিয়েছেন নানা পরামর্শ। পৃথিবীর এমন ক্রান্তিলগ্নে ভাইরাস সম্পর্কিত অভিজ্ঞতার অনুভূতিগুলো ব্যক্ত করেছেন তিনি। সেই হৃদয়স্পর্শী কথা তুলে ধরা হলো মত ও পথের পাঠকদের জন্য।
আমি খুবই দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি এই জগতে যাই ঘটে তার পেছনে একটা পারমার্থিক বা আধ্যাত্মিক কারণ রয়েছে। করোনাভাইরাস নিয়ে আমার একান্ত অনুভবগুলো আমি আপনাদের সঙ্গে ভাগাভাগি করতে চাই।
১. আমাদের সংস্কৃতি, ধর্ম, পেশা, আর্থিক অবস্থা, খ্যাতি ইত্যাদির পরও প্রকৃতগতভাবে আমরা একই সমান। যে যত বড় খ্যাতিমান কিংবা ক্ষমতাবান হোন না কেন- যেকোনো সময় আপনি কঠিন সংকটে পড়ে যেতে পারেন। ভাইরাস এই জিনিসটিই আমাদের খুব ভালো করেই বুঝিয়ে দিয়েছে। যদি আপনি বিশ্বাস না করেন- তবে টম হ্যাংকস অথবা প্রিন্স চার্লসকে দেখেই তা বুঝতে পারবেন।
২. আমরা সবাই একে অপরের সাথে দারুণভাবে সম্পৃক্ত। জগতের সব কিছুই একটি অনুবন্ধনে আবদ্ধ। সীমান্তরেখাগুলো আসলেই মিথ্যা। এগুলোর মূল্য কত কম তা এই ভাইরাস বুঝিয়ে দিয়েছে। আপনারা ভালো করেই দেখেছেন- সীমান্ত পাড়ি দিতে ভাইরাসের ভিসা, পাসপোর্ট কোনো কিছুই লাগে না।
৩. গৃহের স্বল্প সময়ের এই বন্দিত্বকে যদি আপনার নিপীড়ন মনে হয়- তবে একটু ভালোভাবে বোঝার চেষ্টা করুন- যারা সারা জীবন ধরে এমন নিপীড়নের মাঝ দিয়ে যাচ্ছে- তাদের জীবনটা কেমন।
৪. নিজের স্বাস্থ্যের কী যে মূল্য- এটা এই ভাইরাস বুঝিয়ে দিয়েছে। অথচ এই স্বাস্থ্যটাকে আমরা কত অবহেলা করি। নানা রকমের রাসায়নিক উপাদানসমৃদ্ধ খাদ্য না খেলে, পানীয় পান না করলে আমাদের চলে না। আমরা যদি আমাদের শরীরের যত্ন না নিই তবে অবশ্যই আমরা অসুস্থ হবো।
৫. ভাইরাস বুঝিয়ে দিয়েছে- জীবন খুবই সংক্ষিপ্ত। যেকোনো সময় জীবনের ইতি হয়ে যেতে পারে। এই সংক্ষিপ্ত জীবনের উদ্দেশ্য হচ্ছে বয়স্ক আর শিশুদের বেশি করে যত্ন নেয়া। এদের এক দল পৃথিবী দেখার জন্য, আরেক দল পৃথিবী থেকে বিদায় নেয়ার জন্য তৈরি হচ্ছে। তাই, এদেরকে বেশি করে সময় দিতে হবে। জীবন বাঁচাতে টয়লেট রোল কিনে ঘরে ভর্তি করে ফেলাটাই জীবনের উদ্দেশ্য নয়।
৬. ভাইরাস স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে- কত স্বার্থপর আমরা। জড়বাদী, ভোগবাদী আর বিলাসের সমাজই আমরা তৈরি করেছি। সংকটময় মুহূর্তে বোঝা যায়- জীবনের সবচেয়ে প্রয়োজনীয় জিনিসগুলো হচ্ছে- খাদ্য, পানি ও ওষুধ। দামি বাড়ি, গাড়ি ও লাক্সারিয়াস রিসোর্ট নয়। পৃথিবীর সবচেয়ে দামি বাড়ি ও গাড়ি একজন মানুষকে বাঁচাতে পারে না। যেমন পারে- ওষুধ, খাবার ও পানি।
৭. ভাইরাস দেখালো নিজের পরিবার আর আপনজনকে আমরা কত অবহেলা করি। আমরা যখন নিজ থেকে ঘরে ফিরিনি, আপনজনদের সময় দিইনি। ভাইরাস জোর করেই আমাদের প্রিয়জনদের কাছে ফেরালো। প্রিয়জনদের সাথে নতুন করে দৃঢ় সম্পর্ক তৈরি করার সুযোগ তৈরি করে দিলো।
৮. আমাদের আসল কাজ- কারো না কারো চাকর হয়ে শুধু চাকরি করাই নয়। এই জন্যই আমাদেরকে সৃষ্টি করা হয়নি। মানব সৃষ্টির আসল কাজ হলো- মানুষ মানুষের পাশে থাকবে, মানুষ মানুষকে রক্ষা করবে, মানুষ মানুষের কাছ থেকে উপকৃত হবে।
৯. ক্ষমতা, খ্যাতি, বিত্তের দম্ভ- এসব কিছুই নিমিষেই যেকোনো সময় চুপসে যেতে পারে। বড় কোনো শক্তির কাছে নয়। অতি ক্ষুদ্র এক আণুবীক্ষণিক ভাইরাসের কাছে। পুরো দুনিয়াটাকে অচলাবস্থায় নিয়ে যেতে পারে খালি চোখে অদেখা এক ভাইরাস। তাই আমাদের সব রকমের দম্ভকে যেন আমরা সবসময় নিয়ন্ত্রণের মাঝেই রাখি।
১০. আমাদের ইচ্ছাশক্তির পূর্ণ স্বাধীনতা রয়েছে। আমরা ভালো হবো না মন্দ হবো, স্বার্থপর হবো না পরার্থপর হবো, ভালোবাসবো না ঘৃণা করবো, সাহায্য করবো না ছিনিয়ে নেব, দান করবো না গ্রহণ করবো, সাহায্য করবো না নিপীড়ন করবো- এসব কিছু করার পূর্ণ স্বাধীনতা সবারই আছে। সংকট আমাদের আসল স্বরূপ বের করে দেয়।
১১. আমরা সাবধান হবো নাকি শুধুই শংকিত হবো- এটাও ভাইরাস আমাদের মনে করিয়ে দেয়। এরকম অবস্থা অতীতেও হয়েছে। সুতরাং মনে রাখতে হবে পৃথিবীর কোনো সংকটই দীর্ঘস্থায়ী নয়। জীবন আবর্তিত হতে থাকবেই। প্রতিটি সংকটের পর সুসময় আসবেই। এই সংকটও কেটে যাবে। পৃথিবীর এখানেই শেষ নয়। কাজেই অতিরিক্ত আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে আমরা যেন নিজেদের আরও বেশি ক্ষতি করে না ফেলি।
১২. আমরা যেন নিজেদের শোধরাতে পারি। শিক্ষা নিতে পারি- এটা পৃথিবীর শেষ নয়। বরং এক নতুন পৃথিবী গড়ার সূচনা।
১৩. যে হারে কেনার ফলে দোকানের তাক থেকে থেকে টয়লেট রোল পর্যন্ত ফুরিয়ে গেল- ঠিক একইভাবে আমাদের অক্সিজেন দান করা অরণ্য ফুরিয়ে যাচ্ছে। এই অরণ্যকে আমাদের রক্ষা করতে হবে। প্রকৃতিকে অসুস্থ করে আমরা কোনোদিনই সুস্থ হতে পারব না। প্রকৃতিকে নিজের গৃহ মনে করতে হবে। আর ঘর অসুস্থ হলে আমরাও অসুস্থ হব।
১৪. এই ভাইরাস আমাদের বারবার স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে- আমরা যেন ভুলে না যাই। শিক্ষা গ্রহণ করে নিজেদের সংশোধন করি। অনেকেই করোনা ভাইরাসকে গ্রেট ডিজাস্টার হিসাবে দেখছেন। আমরা এটাকে আসলে গ্রেট কারেক্টর হিসাবেই দেখতে চাই।