সংঘর্ষ নয়, বরং কর্মকর্তা ও আনসার সদস্যদের বেধড়ক মারপিটে যশোর শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে বন্দীদের হতাহতের ঘটনা ঘটেছে। হাসপাতালে ভর্তি কিশোর বন্দীরা এমনটাই দাবি করেছে। পাশাপাশি পুলিশ ও প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাও প্রাথমিকভাবে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
এছাড়া ঘটনার প্রায় ৬ ঘণ্টা পর বিষয়টি জানা গেছে বলেও নিশ্চিত করেছেন পুলিশের খুলনা রেঞ্জের অতিরিক্ত ডিআইজি একেএম নাহিদুল ইসলাম।
এর আগে বৃহস্পতিবার দুপুরের ওই ঘটনায় যশোর শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রের ৩ বন্দি নিহত ও আরও ১৪ জন আহত হন। নিহতরা হলেন, বগুড়ার শিবগঞ্জের তালিবপুর পূর্ব পাড়ার নান্নু পরমানিকের ছেলে নাঈম হোসেন (১৭), একই জেলার শেরপুর উপজেলার মহিপুর গ্রামের আলহাজ নুরুল ইসলাম নুরুর ছেলে রাসেল ওরফে সুজন (১৮) এবং খুলনার দৌলতপুরের মহেশ্বরপাশা পশ্চিম সেনপাড়ার রোকা মিয়ার ছেলে পারভেজ হাসান রাব্বি (১৮)।
বৃহস্পতিবার গভীর রাতে যশোর শিশু উন্নয়ন কেন্দ্র থেকে বের হয়ে পুলিশের খুলনা রেঞ্জের অতিরিক্ত ডিআইজি একেএম নাহিদুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, ‘এখানে আসলে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেনি। আজকের ঘটনাটি একপাক্ষীক।’
তিনি আরও বলেন, ঘটনাটি প্রায় ছয়ঘণ্টা পর জানা গেছে। স্থানীয় সংবাদকর্মীরাও ঘটনা জেনেছেন সন্ধ্যার পর, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে। তিনি নিজেও রাত ১০টার পর ঘটনা জেনে শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে এসেছেন। এখানে কী এবং কেন এমন ঘটনা ঘটেছে তা পুলিশ তদন্ত করবে। প্রশাসনের পক্ষ থেকেও তদন্ত হবে। আর ক্ষতিগ্রস্ত কিশোরদের স্বজনরা মামলা করলে পুলিশ মামলা নেবে। তদন্তাধীন ঘটনা হওয়ায় এরচেয়ে বেশিকিছু বলতে তিনি রাজী হননি।
রাতে শিশু উন্নয়ন কেন্দ্র থেকে বের হয়ে যশোরের জেলা প্রশাসক তমিজুল ইসলাম খান বলেন, কিভাবে এই কিশোররা হতাহত হলো তা তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। তদন্তের পরই পুরো বিষয়টি পরিষ্কার হবে।
এদিকে যশোর ২৫০ শয্যা হাসপাতালে ভর্তি বন্দী কিশোররা তুলে ধরে তাদের ওপর নির্যাতনের বর্ণনা। তারা জানায়, ‘ঘটনার সূত্রপাত ৩ আগস্ট, ঈদের দু’দিন পর। শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রের আনসার সদস্য নূর ইসলাম কয়েকজন কিশোরের চুল কেটে দিতে চান। কিন্তু কিশোররা চুল কাটতে রাজি না হওয়ায় তিনি কর্মকর্তাদের কাছে অভিযোগ করেন, ওই কিশোররা নেশা করে। এর প্রতিবাদে ওই দিন কয়েকজন কিশোর তাকে মারপিট করে।’
আহত কিশোরদের দাবি, ‘ওই ঘটনার সূত্র ধরে বৃহস্পতিবার দুপুর ১২টার দিকে ১৮ জন বন্দীকে রুম থেকে বাইরে বের করে আনা হয়। এরপর বিকেল ৩টা পর্যন্ত পালাক্রমে তাদেরকে লাঠিসোটা, রড ইত্যাদি দিয়ে বেধড়ক মারপিট করা হয়। পালাক্রমে এভাবে মারপিটের পর অসুস্থ হয়ে পড়লে তাদের ফেলে রাখা হয়। পরে কয়েকজন মারা গেলে সন্ধ্যার দিকে তাদের লাশ যশোর হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়।’
সূত্র জানায়, শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রের কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে আনসার সদস্য ও তাদের নির্দেশে কয়েকজন কিশোর ওই ১৮ জনকে বেধড়ক মারপিট করে। এতে অসুস্থ হয়ে পড়লে তাদের ফেলে রাখা হয়। কয়েকজন অচেতন থাকায় তারা অজ্ঞান হয়ে গেছে মনে করলেও পরে তারা বুঝতে পারে মারা গেছে। এরপর সন্ধ্যায় এক এক করে তাদের লাশ হাসপাতালে এনে রাখা হয়।
হাসপাতাল সূত্র জানায়, শিশু উন্নয়ন কেন্দ্র কর্তৃপক্ষ দীর্ঘসময় পর সন্ধ্যা ৭টায় রাব্বি, সুজন ও নাঈমকে যশোর জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে যান।
যশোর জেনারেল হাসপাতালের জরুরি বিভাগের চিকিৎসক অমিয় দাস বলেন, দেড় ঘণ্টার ব্যবধানে তিনটি মরদেহ আসে কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্র থেকে। সন্ধ্যা ৬টা ৩৮ মিনিটে নাইম হাসান, সাড়ে ৭টায় পারভেজ হাসান এবং রাত ৮টায় আসে রাসেলের মরদেহ।
এ চিকিৎসক বলেন, ‘একজনের মাথায় ভারী কোনো বস্তু দিয়ে আঘাতের চিহ্ন দেখা গেছে। অন্যদের শরীরে আঘাতের কোনো চিহ্ন এখনও শনাক্ত হয়নি।’
তিন কিশোরের মরদেহ হাসপাতাল মর্গে রয়েছে বলে খবর পেয়ে সেখানে সংবাদকর্মীরা ভিড় জমান। কিন্তু তখন হাসপাতালে শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রের কাউকে পাওয়া যায়নি। শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রের তত্ত্বাবধায়ক আব্দুল্লাহ আল মাসুদের নম্বরে একাধিকবার ফোন দিলেও তিনি রিসিভ করেননি।
পরে বক্তব্য নেয়ার জন্য সশরীরে উন্নয়ন কেন্দ্রে যাওয়া হলেও কর্তব্যরত আনসার সদস্যরা জানান, ভেতরে পুলিশ ছাড়া অন্য কারো প্রবেশ নিষেধ।
এক পর্যায়ে কেন্দ্রের প্রশিক্ষক মুশফিক দাবি করেন, ‘কয়েকদিন আগে সংশোধনাগারে শিশুদের দুই গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষে বেশ কয়েকজন আহত হয়। ওই ঘটনার জেরে বৃহস্পতিবার দুপুরের পর আবার সংঘর্ষ হয়। সংঘর্ষে নাইম, রাব্বি ও রাসেল হোসেন গুরুতর আহত হয়। যশোর ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসক তাদের মৃত ঘোষণা করেন।’
কেন্দ্রের সহকারী পরিচারক আব্দুল্লাহ আল মাসুদ দাবি করেন, সংঘর্ষে দশজন আহত হয়েছে।
এ সময় তারা সাংবাদিকদের কাছে দাবি করেন, শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে বন্দী পাভেল ও রবিউলের নেতৃত্বাধীন দুটি গ্রুপ রয়েছে। এই দুই গ্রুপ দুপুর দুইটার দিকে লাঠি ও রড নিয়ে সংঘাতে লিপ্ত হয়। এতে হাতহতের ঘটনা ঘটেছে।
যশোর পুলিশের ডিএসবি ডিআই-১ পুলিশ পরিদর্শক এম মশিউর রহমান জানান, শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে এই ঘটনা দুপুরে ঘটলেও লাশ হাসপাতালে আনা হয়েছে সন্ধ্যার পর।
ঘটনা জানাজানির পর রাতে শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে যান যশোরের জেলা প্রশাসক তমিজুল ইসলাম খান, পুলিশ সুপার আশরাফ হোসেনসহ পুলিশের কর্মকর্তারা। মধ্যরাতে খুলনা থেকে ঘটনাস্থলে আসেন পুলিশের খুলনা রেঞ্জের অতিরিক্ত ডিআইজি একেএম নাহিদুল ইসলাম।
প্রসঙ্গত, বালকদের জন্য দেশে দুটি শিশু উন্নয়ন কেন্দ্র আছে। যার একটি গাজীপুরের টঙ্গিতে, অন্যটি যশোর শহরতলীর পুলেরহাটে। কিশোর অপরাধীদের জেলখানায় না পাঠিয়ে সংশোধনের জন্য এই উন্নয়ন কেন্দ্রে রাখা হয়।
সমাজসেবা অধিদফতর এই কেন্দ্রের নিয়ন্ত্রক। যশোর কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রে প্রায়ই অঘটন ঘটে। লাশ উদ্ধার, মারপিটের ঘটনা এর আগেও ঘটেছে। সংশ্লিষ্টদের দায়িত্বে অবহেলা, দুর্নীতির কারণে প্রতিষ্ঠানটিতে অনিয়ম জেঁকে বসেছে। এর আগে একটি ঘটনার প্রেক্ষিতে জেলা প্রশাসন গঠিত তদন্ত কমিটি এই তথ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠানটি সুষ্ঠুভাবে চালানোর জন্য একগুচ্ছ সুপারিশ করেছিল। কিন্তু অবস্থার যে উন্নতি হয়নি বরং অবনতি হয়েছে, তিন লাশ উদ্ধারের মাধ্যমে তা প্রমাণিত হলো।