মা-মেয়ে নির্যাতনের ঘটনায় সেই চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে মামলা

কক্সবাজার প্রতিনিধি

‘গরু চুরির মামলায়’ কারাগারে নির্যাতিত মা-মেয়ে

কক্সবাজারের চকরিয়ায় গরু চুরির অপবাদে মা-মেয়েসহ পাঁচজনকে রশি দিয়ে বেঁধে নির্যাতনের আলোচিত ঘটনায় অভিযুক্ত ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান মিরানুল ইসলামের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন ভিকটিম পারভিন আক্তার। মামলায় চেয়ারম্যানসহ চারজনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাত আরও ২০/৩০ জনকে আসামি করা হয়েছে।

মঙ্গলবার বিকালে চকরিয়া থানায় মামলাটি করেন পারভিন আক্তার। মামলা (নং-২২) জিআর ৩৫৭।

universel cardiac hospital

চকরিয়া থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মো. হাবিবুর রহমান মামলার বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেন, ভুক্তভোগী পারভিন আক্তার বাদী হয়ে থানায় একটি এজাহার দায়ের করেন। ওই এজাহারটি মামলা হিসেবে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। এই মামলায় ইতিমধ্যে তিনজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। বর্তমানে তারা জেলহাজতে রয়েছে। এই মামলার অন্যতম আসামি চেয়ারম্যান মিরানুল ইসলামকে গ্রেপ্তারে পুলিশ অভিযান শুরু করেছে।

বাদী পারভিন আক্তার চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া পৌরসভার আদিলপুর গ্রামের মৃত আবুল কালামের স্ত্রী। তারা বর্তমানে পটিয়া উপজেলার ৬নং ইউপির ৯নং ওয়ার্ডের শান্তিরহাট কুসুমপুর শহীদের বাড়ির ভাড়া বাসায় থাকেন।

গত ২১ আগস্ট চকরিয়ার হারবাং ইউনিয়নে কথিত গরু চুরির অভিযোগে মা-মেয়েসহ পাঁচজনকে রশি দিয়ে বেঁধে নির্যাতন করে কিছু অতিউৎসাহী লোকজন। পরে তাদের প্রকাশ্যে সড়কে ঘুরিয়ে স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদে নিয়ে আসা হলে ইউপি চেয়ারম্যান মিরানুল ইসলাম মিরানের নেতৃত্বে দ্বিতীয় দফায় মারধরসহ লাঞ্ছনা করা হয়। এমনকি চেয়ারম্যানের নির্দেশে কথিত গরু চুরির মামলা দিয়ে আদালতের মাধ্যমে পুলিশ তাদেরকে জেলহাজতেও পাঠায়।

ঘটনার একদিন পর মা-মেয়েকে রশি দিয়ে বেঁধে নির্যাতনের বিষয়টি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হলে পুরো দেশজুড়ে তোলপাড় শুরু হয়।

বাদী পারভিন আক্তার জানান, দুই বছর আগে তার স্বামী আবুল কালাম মারা যান। সংসারে দুই ছেলে ও পাঁচ মেয়ে রয়েছে। ছোট মেয়ে বেবি আক্তারের শ্বশুরবাড়ি চকরিয়া উপজেলার ডুলাহাজারা ইউনিয়নের মালুমঘাট হাইদারনাশি গ্রামে। সেখানে যাওয়ার উদ্দেশে তারা পটিয়া শান্তিরহাট থেকে মাইক্রোবাস যোগে সাতকানিয়া কেরানিহাট পর্যন্ত আসেন।

পারভিন জানান, তারা কেরানিহাট থেকে সিএনজি অটোরিকশা ভাড়া নিয়ে মেইন রোড দিয়ে চকরিয়া আসার পথে দুপুর দেড়টায় চকরিয়া মহাসড়কের হারবাং বৃন্দাবনখিল লালব্রিজ এলাকায় পৌঁছলে দুটি মোটর সাইকেলে করে ছয়জন লোক এসে তাদের সিএনজি অটোরিকশাটি ধাওয়া করতে থাকে। এক পর্যায়ে সিএনজি চালক ভয়ে হারবাং স্টেশন থেকে পশ্চিম দিকে রাস্তা দিয়ে চলতে শুরু করে। কিন্তু মোটরসাইকেলে থাকা ছয়জনসহ আরও লোকজন সিএনজিটি ধাওয়া করে হারবাং দক্ষিণ পহরচাঁদা এলাকা দিয়ে নির্মাণাধীন রেললাইনের রাস্তার পাশে এনে তাদেরকে আটক করে।

তিনি বলেন, আমরা (মা-মেয়েসহ পাঁচজন) সিএনজি থেকে নেমে শোর-চিৎকার শুরু করলে আশপাশের লোকজন জড়ো হয়। এসময় আমাদেরকে পেছনে ধাওয়া করে আসা মোটরসাইকেল আরোহীরাসহ আরও কয়েকজন ঘটনাস্থলে পৌঁছে আমাদেরকে আটক করে এবং ভীতিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করে। ওই সময় মোটরসাইকেলে করে আসা লোকজন ও অজ্ঞাত লোকজন আমাদের বিরুদ্ধে মিথ্যে গরু চুরির অপবাদ দিয়ে মা-মেয়েসহ পাঁচজনকে বেধম মারধর, শ্লীলতাহানি ও নির্যাতন করে। এক পর্যায়ে আমাদের কাছে থাকা ব্যবহৃত স্বর্ণালংকার, নগদ ৫০ হাজার টাকা ও মোবাইল সেট লুট করে নিয়ে যায়। এরপর আমাদেরকে চুরির মিথ্যা অপবাদে কোমড়ে রশি দিয়ে বেঁধে বিভিন্ন ধরনের মানহানিকর, আপত্তিকর ও অশ্লীল গালিগালাজ দিয়ে রাস্তায় ঘুরিয়ে চেয়ারম্যানের নির্দেশে বিকাল ৫.৩০ টায় ইউনিয়ন পরিষদের কার্যালয়ে নিয়ে আসে।

ঘটনার বিবরণে বাদী পারভীন আক্তার আরও জানান, চেয়ারম্যান মিরানুল ইসলাম তাদের কোনো কথা না শুনে ইউপি কার্যালয়ে দ্বিতীয় দফায় তাদেরকে কাঠের চেয়ার ও লাঠি দিয়ে মারধর ও নির্যাতন করেন। এক পর্যায়ে তার মেয়ে সেলিনা আক্তার সেলির তলপেটে লাথি মারেন এবং অকথ্য ভাষায় গালিগালাজও করেন।

প্রাপ্ত তথ্যে আরও জানা গেছে, চুরির অপবাদে চেয়ারম্যান মিরানুল ইসলামের নির্দেশে মা পারভিন আক্তার (৪০), ছেলে মো. এমরান (২১), তার বন্ধু ছুট্টো (৩৫), দুই মেয়ে সেলিনা আক্তার সেলি (২৮) ও রোজিনা আক্তারকে (২৩) পুলিশের কাছে সোপর্দ করে। কথিত গরুর মালিক দাবিদার মাহবুবুল আলমকে দিয়ে থানায় সাজানো একটি মামলা করেন। ওই মামলায় পুলিশ তাদেরকে গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতের মাধ্যমে গত শনিবার (২২ আগস্ট) জেলহাজতে পাঠায়।

চকরিয়া আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি অ্যাডভোকেট মো. ইলিয়াছ আরিফ জানান, রোববার সন্ধ্যায় ঘটনাটি তুলে ধরে চকরিয়া জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের বিচারক রাজিব কুমার দেবের আদালতে আসামিদের জামিনের জন্য প্রার্থনা করেন তার নেতৃত্বে কোর্টের আইনজীবীরা। এ সময় আদালতের বিচারক আসামিদের আদালতে উপস্থিত করার জন্য নির্দেশ দেন। পরে পুলিশ সোমবার সকালে মা পারভীন আক্তার, মেয়ে সেলিনা আক্তার সেলি ও রোজিনা আক্তারসহ পাঁচজনকে আদালতে উপস্থিত করেন। এ সময় আদালত মা-মেয়েসহ তিনজনকে জামিন দেয়। অন্য দুজনের জামিন নামঞ্জুর করে জেলহাজতে পাঠানোর নির্দেশ দেয়। তারা দুজন হলেন মো. ছুট্টো (২৭) ও মো. এমরান (২১)।

এদিকে, মা ও দুই মেয়েসহ পাঁচজনকে রশি বেঁধে নির্যাতনের ঘটনা গত শুক্রবার সন্ধ্যা থেকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়ে পড়লে প্রশাসনের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের টনক নড়ে। এমনকি বিষয়টি ইলেক্ট্রনিক্স মিডিয়া, জাতীয়, আঞ্চলিক ও স্থানীয় পত্রিকা এবং অনলাইন মাধ্যমে ফলাও করে প্রচারিত হলে বিষয়টি চকরিয়ার সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট রাজিব কুমার দেবের নজরে আসে। তিনি জনস্বার্থে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে একটি মামলা গ্রহণ করেন। মামলাটি চকরিয়া সার্কেলের সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার কাজী মতিউল ইসলামকে সাত কার্যদিবসের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন দেয়ার জন্য নির্দেশনা দেন। নির্দেশনা পাওয়ার পর তিনি ঘটনাস্থলে সরেজমিনে তদন্তও শুরু করেছেন।

ঘটনাটি ইলেক্ট্রনিক্স, প্রিন্ট মিডিয়া ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হওয়ার পর স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মো. কামাল হোসেন ৩ সদস্য বিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেন। কমিটিতে কক্সবাজারের স্থানীয় সরকার বিভাগের ডিডিএলজি (উপ-সচিব) শ্রাবস্তি রায়কে আহ্বায়ক ও চকরিয়ার সহকারী কমিশনার (ভূমি) তানভীর হোসেন এবং হারবাং ইউনিয়নের উপজেলা ট্যাগ অফিসারকে তদন্ত কমিটির সদস্য করা হয়েছে। তাদেরকে তিন কার্যদিবসের প্রতি মধ্যে সরেজমিনে তদন্ত করে প্রতিবেদন দেয়ার জন্য নির্দেশনা দেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে তদন্ত কমিটি গত সোমবার সরেজমিনে ঘটনাস্থল পরিদর্শন ও প্রত্যক্ষদর্শীদের বক্তব্য গ্রহণ করেন। এছাড়াও চকরিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সৈয়দ শামসুল তাবরীজ নিজেও একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে সরেজমিনে গিয়ে তদন্ত কাজ শুরু করেন।

ঘটনায় ভিডিও ফুটেজ দেখে থানা পুলিশ সোমবার বিকালে হারবাংয়ের মাহবুবুল হকের ছেলে নজরুল ইসলাম, ইমরান হোসেনের ছেলে জসিম উদ্দিন, জিয়াবুল হকের ছেলে নাছির উদ্দীনকে গ্রেপ্তার করেছে।

ভুক্তভোগীদের আইনি সহায়তা দেয়া ন্যাশনাল হিউম্যান রাইটস কমিশনের সহকারী ডাইরেক্টর মো. শাহ পরাণ বলেন, এটি একটি ন্যাক্কারজনক ঘটনা। এই ধরনের ঘটনা কোনোভাবেই মেনে নেয়া যায় না। এজন্য আমাদের পক্ষ থেকে ভুক্তভোগীদের আইনি সহায়তা দেয়া হচ্ছে। ইতিমধ্যে এজন্য আমরা একজন আইনজীবী নিয়োগ দিয়েছি।

চকরিয়া সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের আইনজীবী ও এপিপি অ্যাডভোকেট শহিদুল্লাহ এই মামলাটি পরিচালনা করবেন বলেও তিনি জানান।

শেয়ার করুন

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে