মোমেন-জয়শঙ্কর ফোনালাপ: ঢাকা-দিল্লি সম্পর্কে গতি ফেরাতে তৎপরতা

নিজস্ব প্রতিবেদক

মোমেন-জয়শঙ্কর
ফাইল ছবি

ঢাকা ও দিল্লির মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্কে গতি ফেরাতে তৎপরতা শুরু হয়েছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন সোমবার ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুব্রামনিয়াম জয়শঙ্করের সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলেছেন। তারা চলতি মাসের শেষের দিকে দুই দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ের ‘জয়েন্ট কনসালটেটিভ কমিশন’ (জেসিসি) বৈঠক অনুষ্ঠানের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। ভারতের পররাষ্ট্র সচিব হর্ষ বর্ধন শ্রিংলার বাংলাদেশ সফরের পর দুই দেশের মন্ত্রীরা টেলিফোনে কথা বলেন।

আগামী ১৩ থেকে ১৮ সেপ্টেম্বর ঢাকায় বিজিবি ও বিএসএফ প্রধানদের বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে। এতে সীমান্ত হত্যাসহ সীমান্তের বিভিন্ন ইস্যুতে আলোচনা হবে।

বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাস সংক্রমণের ফলে মহামারি পরিস্থিতিতে দুই প্রতিবেশী দেশের মধ্যে পারস্পরিক যোগাযোগ স্থবির হয়ে পড়েছে। বিশেষ করে বিমান, রেল ও সড়ক পথে জনগণের চলাচল বন্ধ রয়েছে।
কোভিড পরিস্থিতি এবং কোভিডপরবর্তী অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারে দুই দেশের সহযোগিতা এগিয়ে নিতে মোদির বার্তা নিয়ে গত ১৮ আগস্ট দুই দিনের সফরে ঢাকায় আসেন শ্রিংলা। তিনি গণভবনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন। এ সময় ঢাকায় ভারতের বিদায়ী হাইকমিশনার রীভা গাঙ্গুলি দাশ উপস্থিত ছিলেন। সেখানে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে গতি ফেরাতে জেসিসি বৈঠক অনুষ্ঠানের সিদ্ধান্ত হয়।

বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে জেসিসি বৈঠক ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে দিল্লিতে অনুষ্ঠিত হয়। স্বাভাবিক কারণে এ বছর ঢাকায় জেসিসি বৈঠক হওয়ার কথা। ফলে ঢাকায় অনুষ্ঠেয় বৈঠকে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জয়শঙ্করকে আমন্ত্রণ জানাতে টেলিফোন করেন বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন।

সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, আগামী ১৭ সেপ্টেম্বর থেকে ভারতের পার্লামেন্টের অধিবেশন শুরু হবে। এ কারণে বাংলাদেশ সফরে আসার ব্যাপারে অপারগতা প্রকাশ করেছেন জয়শঙ্কর। তাই শেষ পর্যন্ত ভার্চুয়াল বৈঠকের সিদ্ধান্ত নিয়েছে দুই দেশ।

জানতে চাইলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন সোমবার টেলিফোনে যুগান্তরকে বলেন, আমি ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলেছি। আগামীতে আমাদের মধ্যে উচ্চপর্যায়ে বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে। আমরা অমীমাংসিত ইস্যুতে আলোচনা করব। এতে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক আরও ত্বরান্বিত হবে। এ ব্যাপারে বিস্তারিত আর কিছু বলেননি তিনি।

ঢাকায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক সংক্ষিপ্ত সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়- পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্করের সঙ্গে টেলিফোনে আলাপকালে মন্ত্রী পর্যায়ের ৬ষ্ঠ জয়েন্ট কনসালটেটিভ কমিশনের সভা ভার্চুয়াল প্লাটফর্মে অনুষ্ঠিত হওয়ার বিষয়ে তারা নীতিগতভাবে সম্মত হয়েছেন।

এই সভা চলতি মাসের শেষে অনুষ্ঠিত হবে বলে আশা করা হচ্ছে। এতে আরও বলা হয়, করোনার কারণে ভারতে আন্তর্জাতিক ভ্রমণের নিষেধাজ্ঞা শিথিল হওয়ার পর সর্বপ্রথম বাংলাদেশ সফরের আগ্রহ প্রকাশ করেছেন এস জয়শঙ্কর।

দুই পররাষ্ট্রমন্ত্রীর মধ্যে টেলিফোনে আলাপের পর ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর তাদের আলোচনা প্রসঙ্গে একটি টুইট করেন।

টুইটে জয়শঙ্কর লেখেন- পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেনের সঙ্গে উষ্ণ আলোচনা হয়েছে। আমাদের জয়েন্ট কনসালটেটিভ কমিশন দ্রুত অনুষ্ঠানে একমত হয়েছি। আমাদের নেতারা যে উচ্চাভিলাষী লক্ষ্য নির্ধারণ করেছেন তা অর্জন করতে আমরা নিবিড়ভাবে কাজ করা অব্যাহত রাখব।

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি তার ‘প্রতিবেশী প্রথম’ নীতির আলোকে প্রতিবেশীদের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদারের নির্দেশ দিয়েছেন।

গালওয়ান সীমান্তে ভারত-চীন উত্তেজনার পরিপ্রেক্ষিতে ভূ-রাজনীতিতে আলোড়নের মধ্যে দিল্লির সাউথ ব্লক সক্রিয় হয়েছে। ভারতের জোরালো কূটনীতির ইঙ্গিত দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী জয়শঙ্করের সম্প্রতি প্রকাশিত ‘দ্য ইন্ডিয়া ওয়ে’ বইতে দেয়া হয়েছে।

দিল্লির সক্রিয় কূটনীতির ফলে বাংলাদেশের গোমতি নদী দিয়ে ভারতের পণ্যবাহী কার্গোর পরীক্ষামূলক চলাচল সফলভাবে সম্পন্ন হওয়ায় দুই পররাষ্ট্রমন্ত্রী টেলিফোন আলাপে সন্তোষ প্রকাশ করেন। অন্যান্য ইস্যুতেও বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পৃক্ততা বাড়াবে দিল্লি।

হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ নেপালে মাওবাদী নেতা পুষ্পকমল দাহল প্রচণ্ডের সমর্থনপুষ্ট প্রধানমন্ত্রী কে পি শর্মা অলির সরকারের সঙ্গেও বিরোধ নিষ্পত্তির চেষ্টা করবে দিল্লি।

ভারত ও নেপাল উভয় দেশই কালাপানি নামের একটি স্থানকে নিজেদের মানচিত্রে অন্তর্ভুক্ত করায় বিরোধ দেখা দিয়েছে। ভারতের অভ্যন্তরে নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন (সিএএ) এবং আসামে নাগরিকপঞ্জি (এনআরসি) নিয়ে উত্তেজনায় বাংলাদেশেও অস্বস্তি দেখা দিয়েছিল।

সীমান্ত হত্যা ও পানিবণ্টন ঢাকার অগ্রাধিকার

কূটনৈতিক সূত্রে জানা গেছে, আগামী ২৯ কিংবা ৩০ সেপ্টেম্বর ভার্চুয়াল জেসিসি বৈঠক হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তার আগে চলতি মাসের মাঝামাঝি ভারতের হাইকমিশনার রীভা গাঙ্গুলি দাশ ঢাকায় তার দায়িত্ব পালন শেষে দিল্লি ফিরে যাচ্ছেন। এ মাসের শেষে ঢাকায় আসছেন নতুন ভারতীয় হাইকমিশনার বিক্রম দোরাইস্বামী।
জেসিসি বৈঠকে সাধারণত দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের সার্বিক বিষয় পর্যালোচনা করা হয়ে থাকে। তবে বাংলাদেশের তরফে সীমান্ত হত্যা ও পানিবণ্টন ইস্যুতে বেশি অগ্রাধিকার দেয়া হবে।

সম্প্রতি বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেনের সঙ্গে ভারতের পররাষ্ট্র সচিব হর্ষ বর্ধন শ্রিংলার বৈঠকে বাংলাদেশ সীমান্ত হত্যা বেড়ে যাওয়ায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।

বাংলাদেশ বলেছে, এমন হত্যাকাণ্ড যে কোনো চুক্তির বিরোধী। এ পরিপ্রেক্ষিত্রে জেসিসি বৈঠকের আগেই দুই দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর প্রধান পর্যায়ে বৈঠক হচ্ছে।

ঢাকায় আগামী ১৩ থেকে ১৮ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠেয় বৈঠকে যোগ দিতে বিএসএফের একটি বড় প্রতিনিধি দল বিশেষ বিমানে ঢাকায় আসছেন। তাছাড়া জেসিসি বৈঠকের এজেন্ডায় অভিন্ন নদীর পানিবণ্টন অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। ফলে জেসিসি বৈঠক থেকে দুই দেশের যৌথ নদী কমিশনের বৈঠকের দিনক্ষণ নির্ধারিত হতে পারে। বাংলাদেশ তিস্তার পানিচুক্তি সই করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।

বাংলাদেশের অগ্রাধিকারে আরেকটি বড় ইস্যু রোহিঙ্গা সংকট। ভারত জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে অস্থায়ী সদস্য নির্বাচিত হওয়ায় রোহিঙ্গা সংকট নিরসনে বাংলাদেশ প্রতিবেশী এ দেশটির সহায়তা চাইবে।

জেসিসি বৈঠকে ভারতের দেয়া ঋণের বাস্তবায়ন নিয়ে পর্যালোচনা করা হতে পারে। ভারত এ পর্যন্ত আট বিলিয়ন ডলারের ঋণ বাংলাদেশকে দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। এছাড়াও অক্টোবরের শেষনাগাদ বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় ভিত্তিতে বিমান যোগাযোগ চালু করা যায় কিনা- সে বিষয়ে জেসিসি বৈঠকে আলোচনা হবে। ‘বাবল ট্রাভেল’ চালুর এ প্রস্তাব শ্রিংলা বাংলাদেশকে দিয়েছেন।

শেয়ার করুন

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে