করোনা প্যান্ডামিকে দেশের সাধারণ জনগণ ভোগছেন নানা ধরনের সামাজিক ও অর্থনৈতিক সমস্যায়। বিশেষ করে এই মহামারিতে সবচেয়ে বেশি মাশুল গুণছে নিম্নবিত্ত এবং নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারগুলো। বহু কষ্টে গড়া সামান্য সঞ্চয় ও ব্যবসা হারিয়ে অনেকেই আজ সর্বশান্ত। এই ক্রান্তিকালে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে পুরোনো আরেকটি সামাজিক সমস্যা, আর সেটা হলো বাল্যবিবাহ। আমাদের সামাজিক প্রেক্ষাপটে এখনও অনেক পরিবারে একটি ছেলেকে অর্থোপার্জনের ও পরিবারের দায়িত্ব গ্রহণের যোগ্য এবং কন্যাকে পরিবারের জন্য বোঝা হিসেবেই বিবেচনা করা হয়। তাই অভাব-অনটনে থাকা পরিবারগুলো কন্যা সন্তানকে বিয়ের বয়স হওয়ার পূর্বেই বিয়ে দিয়ে দেয়। অবশ্য অনেক সময় অভাবের কাছে নতি স্বীকার করেও মা-বাবা তাদের কন্যাকে বাল্যবিবাহ দিতে বাধ্য হন। করোনা মহামারিতে সারাদেশে দীর্ঘদিন ধরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় বাল্যবিবাহের মতো এই অভিশাপ আরও প্রকট আকার ধারণ করছে।
সম্প্রতি পার্লামেন্টারিয়ান ফর গ্লোবাল অ্যাকশন (পিজিএ) আমার কাছে একটি পত্র লিখেছে; তাতে তারা জানিয়েছে, করোনাভাইরাস বিস্তারের এ সময় বাংলাদেশে আশংকাজনক হারে বাল্যবিবাহ বেড়ে গেছে এবং এই হার প্রায় ৮৪%। আমি বিষয়টি নিয়ে দেশের অভ্যন্তরেও অনেকের সঙ্গে কথা বলেছি; তাদের বক্তব্যেও একই চিত্র ফুটে উঠেছে। এই পরিস্থিতি নিঃসন্দেহে আমাদের জন্য উদ্বেগজনক।
একথা সত্য, বিভিন্ন দেশে কর্মরত প্রবাসী শ্রমিকসহ নানা পেশায় নিয়োজিত ব্যাক্তিবর্গ এ সময়টায় দেশে ফিরেছেন। সমাজ বাস্তবতায় প্রবাসে কর্মরত ছেলের ‘পাত্র’ হিসেবে চাহিদা বেশি হওয়ায় অবরুদ্ধ অবস্থায়ই কন্যার বিয়ে সম্পন্ন করারা চেষ্টা করছেন অনেক অভিভাবক। এছাড়াও চলমান পরিস্থিতিতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও বেসরকারি সংস্থাগুলোর নজরদারিও তুলনামূলকভাবে কম হচ্ছে। আর সেই সুযোগও কাজে লাগাচ্ছেন অনেকে। মানুষের চলাফেরা আগের চেয়ে অনেকটা সীমিত হয়ে পড়ায় সমাজের দরিদ্র অনেক অভিভাবকই এ সময়ে মেয়ের বিয়ে নিয়ে ভাবছেন। কারণ এই্ সময়ে খুব বেশি মানুষকে আপ্যায়ন করতে হচ্ছে না বলে বিয়েতে খরচ অনেকাংশেই কমে যাচ্ছে।
আমরা লক্ষ্য করছি সম্প্রতি নারী ও শিশু নির্যাতন আইন-২০০০ এর সংশোধনী এমনভাবে আনা হয়েছে যেখানে অনেক ক্ষেত্রে বাল্যবিবাহে উদ্যোগীদের সফলকাম হওয়ার সুযোগ আছে। সুতরাং এই সংশোধনীটাকে পুনরায় সংশোধন করে পূর্বাবস্থায় নিয়ে যাওয়ার জোর দাবি জানাচ্ছি। পাশাপাশি আমাদের পরামর্শ হলো স্কুল-কলেজ পরিচালনার ক্ষেত্রে প্রস্তাবনাগুলো এমনভাবে করা যাতে ছাত্র-ছাত্রীরা অধ্যয়ন ও এক্সট্রা কারিকুলাম এক্টিভিটির সাথে ন্যাস্ত থাকে।
মনে রাখতে হবে, বাল্যবিবাহের ফল কখনোই একজন কিশোরীর জন্য মঙ্গলজনক নয়। না শারীরিক দিক থেকে, না মানসিক দিক থেকে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বাল্যবিবাহ মেয়ে শিশুদের কাছ থেকে তাদের ভালোভাবে বেঁচে থাকার অধিকারই কেড়ে নেয়। হয়তো মেয়ের জন্য একটি সুন্দর জীবনের আশায় অভিভাবকরা তাকে বিয়ে দেন। কিন্তু এতে করে অধিকাংশ ক্ষেত্রে সেই কিশোরীকে সইতে হয় অমানবিক নির্যাতন; যা প্রতিহত করার অধিকারও থাকে না কিশোরীটির। তাছাড়া একজন কিশোরী যখন গর্ভবতী হয় তখন তার মৃত্যুঝুঁকি একজন প্রাপ্তবয়স্ক মায়ের তুলনায় অন্তত চার গুণ বেড়ে যায়। তাই বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে প্রশাসনিক তৎপরতা বৃদ্ধির পাশাপাশি এর কুফল সম্পর্কে সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টির এখনই সময়।