বৃদ্ধা রাবেয়ার অব্যাহতির রায়ে সংবাদকর্মীর প্রশংসা

নিজস্ব প্রতিবেদক

বৃদ্ধা রাবেয়া খাতুন
বৃদ্ধা রাবেয়া খাতুন। ফাইল ছবি

অস্ত্র মামলায় আসামি হয়ে দেড় যুগের বেশি আদালতের বারান্দায় ঘুরতে থাকা বৃদ্ধা রাবেয়া খাতুনকে অব্যাহতি দেওয়া সংক্রান্ত হাইকোর্টের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ করা হয়েছে। রাবেয়ার বিরুদ্ধে করা মামলা ও তার মুক্তির বিষয়ে দেওয়া রায়ে একজন সংবাদকর্মীর ভূমিকার কথা তুলে ধরা হয়েছে।

দৈনিক সমকালের সাংবাদিক ওয়াকিল আহমেদ হিরনের প্রশংসা করে হাইকোর্ট বলেছেন, একজন সাংবাদিকের দায়িত্ব শুধু সংবাদ পরিবেশনই নয়, বরং সত্যকে উন্মোচিত করে জাতির সামনে উপস্থাপন করা। তিনি সত্যিকার অর্থে একজন উপযুক্ত সংবাদকর্মী হিসেবে মহান দায়িত্ব পালন করেছেন।

universel cardiac hospital

রায় প্রকাশের পর আইনজীবীরাও বলেছেন, এটি একটি যুগান্তকারী রায়।

হাইকোর্টের বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন ও বিচারপতি মো. রিয়াজ উদ্দিন খান এর সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ ২০১৯ সালের ৩০ অক্টোবর সংক্ষিপ্ত রায় ঘোষণা করেছিলেন। প্রায় এক বছর পর সম্প্রতি ওই রায়ের ৩৩ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি প্রকাশ করা হয়েছে।

ওই সময় হইকোর্টে নিম্ন আদালতে সংশ্লিষ্ট মামলার বিচারকের পক্ষে ছিলেন সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি এএম আমিন উদ্দিন (বর্তমান অ্যাটর্নি জেনারেল), অন্যদিকে এপিপি শাহাবুদ্দিন মিয়ার পক্ষে ছিলেন বারের সাবেক সম্পাদক ব্যারিস্টার এএম মাহবুব উদ্দিন খোকন।

রায়ে হাইকোর্ট বলেন, ২০১৯ সালের ২৫ এপ্রিল দৈনিক সমকালের প্রথম পৃষ্ঠায় প্রকাশিত প্রতিবেদনটি প্রকাশের জন্যে যিনি সংগ্রহ করেছেন তিনি সত্যিকার অর্থে একজন উপযুক্ত সংবাদকর্মী হিসেবে মহান দায়িত্ব পালন করেছেন। একজন সাংবাদিকের দায়িত্ব শুধু সংবাদ পরিবেশনই নয়, বরং সত্যকে উন্মোচিত করে জাতির সামনে উপস্থাপন করা।

রায়ে বলা হয়েছে, দীর্ঘ ১৭ বছর যাবত মামলার বিচার কার্যক্রম পরিচালনায় ‘এবিউস অব দ্য প্রসেস অব দ্য কোর্ট’ সুস্পষ্ট প্রতীয়মান। বিধায় উক্ত মামলার পরবর্তী কার্যক্রম বাতিল করা হলো। ফলে বৃদ্ধা রাবেয়া খাতুনকে এ মামলায় আর আদালতে আসতে হবে না। আইনজীবী মো. আশরাফুল আলম নোবেল হাইকোর্টকে একজন অ্যামিকাস কিউরি’র (আদালতের বন্ধু) মতো সহায়তা করেছেন বলে রায়ে উল্লেখ করা হয়।

রায়ের অনুলিপি আইন ও বিচার বিভাগের সচিবকে পাঠানোর নির্দেশনা দিয়ে বলা হয়, তাদের অধীনস্থ জেলা ও দায়রা জজ আদালত এবং ট্রাইব্যুনালে দশ বছর বা তার অধিককাল বিচারাধীন মামলার প্রতিবেদন সংগ্রহ করে তিনটি তালিকা প্রস্তুত করতে হবে।

প্রথমত, দশ বছর বা তার অধিক এবং ১৫ বছরের কম সময়কাল বিচারাধীন মামলা। দ্বিতীয়ত, ১৫ বছর বা তার অধিক এবং তৃতীয়ত, ২০ বছর পর্যন্ত বিচারাধীন এবং ২০ বছরের অধিককাল বিচারাধীন মামলার তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে ৬ মাসের মধ্যে সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রারের কাছে তা জমা দিতে বলা হয়েছে।

এ ছাড়া রায়ের অনুলিপি পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) এবং ডিএমপি কমিশনারের কাছেও যাবে। পাশাপাশি তেজগাঁও থানার তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মাজহারুল ইসলামের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেন আদালত। আদালতের নির্দেশনা প্রতিপালন করে তার একটি প্রতিবেদন সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেল কার্যালয়ের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট আদালতে জমা দেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে।

রাবেয়া খাতুনের মামলার আইনজীবী আশরাফুল আলম নোবেল বলেন, ফৌজদারি মামলায় বিচারের ক্ষেত্রে অনিচ্ছাকৃত বিলম্বের বিষয়ে এবং বিচারপ্রার্থীর দ্রুত বিচার পাওয়া সাংবিধানিক অধিকার রক্ষায় সুপ্রিম কোর্ট ও উপমহাদেশের বিভিন্ন আলোচিত মামলা ও রেফারেন্স পর্যালোচনা করে হাইকোর্ট এই রায়ের সিদ্ধান্ত দিতে সম্মত হয়েছেন।

২০১৯ সালের ২৫ এপ্রিল দৈনিক সমকালের প্রথম পৃষ্ঠায় ‘আদালতের বারান্দায় আর কত ঘুরবেন তিনি’ শিরোনামে একটি সংবাদ প্রকাশ পায়।

ওইদিন রাবেয়া খাতুন সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন, ১৮ বছর ধরে আদালতে হাজিরা দেন, কিন্তু মামলা শেষ হয় না।

রায়ে ঢাকা মহানগর বিশেষ ট্রাইব্যুনাল-২ এর বিচারক আল মামুন ও আদালতের সহকারী পিপি শাহাবুদ্দিন মিয়াকে সতর্ক করে হাইকোর্ট বলেন, ‘তাদের অদক্ষতা ও অবহেলার কারণে মামলাটি এ পর্যন্ত এসে পৌঁছেছে। যা খুবই দুঃখজনক।’

২০০২ সাল থেকে ঢাকার আদালতে মানিকগঞ্জের বৃদ্ধা রাবেয়া খাতুনের বিরুদ্ধে অস্ত্র মামলাটি চলছিল। এরপর দৈনিক সমকালে সংবাদ প্রকাশের পর জনস্বার্থে হাইকোর্টে আপিল করা হয়। ২০১৯ সালের ৩০ এপ্রিল আদালত প্রথমে মামলার কার্যক্রম স্থগিত করে রুল জারি করেন। একই বছরের ১৫ অক্টোবর মামলাটি চূড়ান্ত শুনানি শেষে আদালত রুল যথাযথ ঘোষণা করে রাবেয়া খাতুনের ক্ষেত্রে মামলাটি বাতিল করেন।

রাজধানীর ৩/ক, গার্ডেন রোড থেকে অবৈধ বিদেশি পিস্তল ও ছয় রাউন্ড গুলি নিজ হেফাজতে রাখার অপরাধে ২০০২ সালের ২ জুন তেজগাঁও থানার এসআই আবদুর রাজ্জাক বাদী হয়ে রাবেয়া খাতুনসহ তিনজনের বিরুদ্ধে মামলা করেন। গ্রেফতারের পর ছয় মাস কারাগার ভোগ করে জামিন পান রাবেয়া। পরে তাকেসহ দুই আসামি জুলহাস ও মাসুদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে ২০০৩ সালের ২৪ মার্চ শুরু হয় মামলার বিচার।

কিন্তু ১৪ বছর আদালতে জুলহাসের কোনো উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়নি। এরইমধ্যে ২০১৪ সালে মামলার তদন্ত কর্মকতাও (আইও) মারা যান। সেই মামলা থেকে মুক্তি পেতে ঢাকার আদালতের বারান্দায় ১৮ বছর ধরে ঘুরছিলেন এই অশীতিপর মানুষটি। ২০১৯ সালের ৩০ অক্টোবর চূড়ান্ত রায়ে বৃদ্ধা রাবেয়াকে মামলা থেকে অব্যাহতি দেন হাইকোর্ট।

উল্লেখ্য, সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপচারিতায় রাবেয়া খাতুন দাবি করেন তার বয়স ১০৪। কিন্তু পুলিশের করা ২০০২ সালের মামলায় রাবেয়ার বয়স ৬০ বছর উল্লেখ করা হয়েছে।

যদিও রাবেয়ার আইনজীবী মেহেদী হাসান পলাশ জানান, আসামির বয়স ৮০ বছরের বেশি। পুলিশ সাধারণত মামলার সময় আসামির বয়স অনেকক্ষেত্রে কম লিখে থাকে।

শেয়ার করুন

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে