৪২ বছরে পা রাখল ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়

বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিবেদক

৪২ বছরে পা রাখল ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়
ফাইল ছবি

ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় (ইবি) স্বাধীনতার পর দেশের প্রথম বিদ্যাপীঠ। কুষ্টিয়া থেকে ২২ ও ঝিনাইদহ থেকে ২৪ কিলোমিটার দূরে শান্তিডাঙ্গা-দুলালপুর নামক স্থানে অবস্থিত বিশ্ববিদ্যালয়টি আজ ৪২ বছরে পা রাখল।

দীর্ঘ ৪১ বছরের পথ চলায় নানা চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে স্বগৌরবে উচ্চশিক্ষার প্রদীপ্ত মশাল জ্বালিয়ে যাচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়টি। ইসলামিক ও আধুনিকতার সমন্বয়ে পরিচালিত এটি এমন একটি বিশ্ববিদ্যালয় যা দেশের প্রতিটি প্রান্তে উচ্চশিক্ষা বিস্তারে কাণ্ডারীর ভূমিকা পালন করছে।

universel cardiac hospital

প্রতিষ্ঠাকাল থেকে বর্তমান

১৯৭৯ সালের ২২ নভেম্বর প্রতিষ্ঠিত হয় ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়। ১৯৮৩ সালের ১৮ জুলাই এক আদেশে বিশ্ববিদ্যালয়টিকে গাজীপুর বোর্ড বাজারে এবং ১৯৯০ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি অপর এক আদেশে কুষ্টিয়া শহরে স্থানান্তর করা হয়।

১৯৮৫-৮৬ শিক্ষাবর্ষে দুটি অনুষদের অধীন চারটি বিভাগে আটজন শিক্ষক ও তিনশ ছাত্র ভর্তির মাধ্যমে শুরু হয় একাডেমিক কার্যক্রম।

১৯৯২ সালের ১ নভেম্বর শান্তিডাঙ্গা-দুলালপুরের সবুজ চত্বরে মাটির সড়ক আর সবুজ গাছপালার মধ্যে গড়ে ওঠে দুটি ভবন। ভবন দুটি নিয়েই শুরু হয় মূল ক্যাম্পাসের কার্যক্রম। বর্তমানে ৮টি অনুষদের অধীন ৩৪টি বিভাগে ১৫ হাজার ৩৮৪ শিক্ষার্থী অধ্যয়ন করছেন।

অন্যান্য অনুষদে বিভাগ বৃদ্ধি পেলেও ধর্মতত্ত্ব অনুষদে প্রতিষ্ঠাকালীন তিন বিভাগই রয়ে গেছে।

বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্তমানে শিক্ষক রয়েছেন ৩৯৭ জন, কর্মকর্তা ৪৫৯, সহায়ক কর্মচারী ১৭৭, সাধারণ কর্মচারী ১৭৭, এমফিল গবেষক ২৬৫ এবং ৩৩৮ জন পিএইচডি গবেষক রয়েছেন। এছাড়া এখানে ১টি ইন্সটিটিউট ও ১টি ল্যাবরেটরি স্কুল অ্যান্ড কলেজ রয়েছে।

বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৩তম উপাচার্য হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ড. শেখ আবদুস সালাম এবং উপ-উপাচার্য হিসেবে ইবির ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক ড. শাহিনুর রহমান (দ্বিতীয় মেয়াদে) নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করছেন। তবে কোষাধ্যক্ষ পদটি টানা তিনমাস ধরে শূন্য রয়েছে।

ক্যাম্পাস যেন মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি ভাস্কর্য

মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এবং জাতির পিতার আদর্শের স্মারক বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৭৫ একরের প্রতি ইঞ্চিতে দৃশ্যমান। এ লক্ষ্যে প্রধান ফটকের সন্নিকটে ‘মৃত্যুঞ্জয়ী মুজিব’ ম্যুরাল স্থাপিত হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে বঙ্গবন্ধু হল ফটকের সামনে গত ১৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ম্যুরাল ‘মুক্তির আহ্বান’ ও ‘শাশ্বত মুজিব’ উদ্বোধন করা হয়েছে।

এছাড়া প্রধান ফটকের উত্তরে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি ভাস্কর্য ‘মুক্তবাংলা’, দক্ষিণে শহীদ মিনার ও স্মৃতিসৌধ বিদ্যমান। কেন্দ্রীয় মিলনায়তনের নাম ‘বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমান মিলনায়তন’ করা হয়েছে। এছাড়া বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে উচ্চতর গবেষণার্থে বঙ্গবন্ধু চেয়ার প্রফেসর নিয়োগ দেয়া হয়েছে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারে মুক্তিযুদ্ধ কর্নার, বঙ্গবন্ধু কর্নার এবং একুশে কর্নার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

উন্নয়ন ও অগ্রগতির চিত্র

৫৩৭ কোটি টাকার মেগাপ্রকল্পের আওতায় ক্যাম্পাসে ৯টি দশতলা ভবন যেখানে ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য ২টি করে মোট ৪টি আবাসিক হল ও একটি একাডেমিক ভবন রয়েছে। এছাড়া ১টি কেন্দ্রীয় বিজ্ঞান গবেষণাগার, ১২টি ভবনের ঊর্ধ্বমুখী সম্প্রসারণসহ বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজ শুরু হয়েছে।

মাত্র চারবার সমাবর্তন

৪১ বছরের ইতিহাসে সমাবর্তন অনুষ্ঠিত হয়েছে মাত্র চারবার। নিয়মিত সমাবর্তন না হওয়ায় বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্জিত ডিগ্রির সনদ আনুষ্ঠানিকভাবে হাতে নেয়ার সুযোগও হচ্ছে না অনেক শিক্ষার্থীর।

কোষাধ্যক্ষ ছাড়াই তিনমাস অতিবাহিত

বিশ্ববিদ্যালয়ে কোষাধ্যক্ষ পদটি টানা তিনমাস ধরে শূন্য হয়ে আছে। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড চরমভাবে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। উপাচার্যের নির্বাহী ক্ষমতাবলে অর্থনৈতিক কার্যক্রম পরিচালনা করলেও কিছু কিছু কাজে জটিলতা সৃষ্টি হচ্ছে বলে জানা গেছে।

এছাড়া কাজের অতিরিক্ত হিসেবে আটকে থাকা বিভিন্ন ফাইলে স্বাক্ষর করছেন তিনি। অতিদ্রুত এ পদটিতে নিয়োগ দেয়া হোক এমন প্রত্যাশা সচেতন শিক্ষক-শিক্ষার্থী সবার।

আবাসন সঙ্কট

বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের আবাসন ব্যবস্থায় রয়েছে ৮টি হল। এর মধ্যে ৫টি ছাত্রদের এবং ৩টি ছাত্রীদের। যা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই নগন্য। বর্তমানে ২৪ শতাংশ শিক্ষার্থী আবাসিক হলে অবস্থানের সুযোগ পাচ্ছেন।

এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের আশপাশের বিভিন্ন বাসাবাড়ি ও মেসে থাকছেন কয়েক হাজার শিক্ষার্থী। আর সিংহভাগ শিক্ষার্থী কুষ্টিয়া-ঝিনাইদহ শহরে থেকে পড়ালেখা চালিয়ে যাচ্ছেন। শিক্ষক-কর্মকর্তাদেরও ক্যাম্পাসে আবাসন ব্যবস্থা অপর্যাপ্ত।

পরিবহন সঙ্কটে শিক্ষার্থীরা

শহরে অবস্থানকারী শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা যাতায়াতের জন্য একমাত্র পরিবহনের ওপর নির্ভরশীল। বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবহন পুলে বাস-মিনিবাস ১৬টি, এসি কোস্টার ৬টি ও ২টি এ্যাম্বুলেন্স রয়েছে। পর্যাপ্ত পরিবহন না থাকায় বিশ্ববিদ্যালয়কে ভাড়ায় চালিত পরিবহনের ওপর নির্ভর করতে হয়।

বিশ্ববিদ্যালয়ের বাজেটের প্রায় ৮ শতাংশ পরিবহন খাতে ব্যয় হলেও প্রতিষ্ঠার ৪১ বছরেও পরিবহন ভোগান্তি কাটেনি শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের।

পরিবহন সমস্যার স্থায়ী সমাধান ও অদক্ষ চালক দ্বারা গাড়ি চালানো এবং মেয়াদোত্তীর্ণ বাসসমূহে শিক্ষার্থী পরিবহন ব্যবস্থা বন্ধ করার দাবি জানিয়েছেন শিক্ষার্থীরা।

সেশনজট রয়েই গেল

৪২ বছরে দাঁড়িয়েও সেশনজটের কবল থেকে মুক্ত হয়নি বিশ্ববিদ্যালয়টি। স্নাতক পর্যায়ে ২৫টি বিভাগের মধ্যে ১৫টি বিভাগের ফল প্রকাশিত হলেও বাকি ১০ বিভাগের শিক্ষার্থীদের ফল প্রকাশিত হতে এখনও কয়েক ধাপ বাকি। এর মধ্যে ম্যানেজমেন্ট বিভাগের শিক্ষার্থীরা অফিসিয়ালি ফলাফল হাতে পায়নি বলে জানা গেছে।

এছাড়া স্নাতকোত্তরে ২২টি বিভাগের মধ্যে মাত্র ২টি বিভাগের ফল প্রকাশিত হয়েছে। বাকি ২০ বিভাগের ফল প্রকাশ হতে কয়েক ধাপ বাকি আছে। এক্ষেত্রে ম্যানেজমেন্ট ও পরিসংখ্যান বিভাগের ২০১৩-১৪ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থীদের এখনও চূড়ান্ত পরীক্ষা শুরুই হয়নি।

অপ্রাপ্তির লম্বা খাতা

প্রতিষ্ঠার ৪২ বছরেও শিক্ষার্থীদের অপ্রাপ্তির শেষ নেই। বিশ্ববিদ্যালয় দিবসে তারা তুলে ধরেছেন নানা অপ্রাপ্তির কথা।

চলমান শিক্ষাবৃত্তির পরিমাণ বৃদ্ধিকরণ, গবেষণা খাতে বরাদ্দ বৃদ্ধি, মেধাবী ও অস্বচ্ছল শিক্ষার্থীদের শিক্ষাবৃত্তির আওতায় আনা, অনতিবিলম্বে প্রাতিষ্ঠানিক ইমেইল প্রদানে কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ, শিক্ষাত্তোর সার্টিফিকেট উত্তোলন পদ্ধতি সহজ ও আধুনিকায়ন করা, ছাত্র-শিক্ষক নোংরা রাজনীতির নাগপাশ থেকে বেরিয়ে এসে সুস্থ ধারার রাজনীতি চর্চাকরণ, ইকসু গঠন ও নির্বাচন দিতে কার্যকরী উদ্যোগ গ্রহণ, কেন্দ্রীয় ক্যাফেটেরিয়া ও হলের ডাইনিং গুলোতে খাবার ও পরিবেশের মান বৃদ্ধিকরণ, শিক্ষার্থীদের ব্যবহার্য প্রত্যেক ভবনের টয়লেট সংস্করণ, সকল ধর্মাবলম্বীদের প্রার্থনা ও ধর্মীয় কার্যাদি পালনের জন্য আলাদা আলাদা উপাসনালয় নির্মাণ, সকল প্রকার বর্ধিত ফি প্রত্যাহার করাসহ বিভিন্ন দাবি জানান তারা।

বিশ্ববিদ্যালয় দিবসে উপাচার্য অধ্যাপক শেখ আবদুস সালাম প্রত্যাশা ব্যক্ত করে বলেন, স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের অতীত ঐতিহ্য শুধু সমুন্নত রাখাই নয়, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বিশ্ববিদ্যালয়ের সুনাম ও মর্যাদা বৃদ্ধি করতে জ্ঞানচর্চা ও গবেষণায় শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা আরও বেশি করে মনোনিবেশ করবেন।

শেয়ার করুন

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে