দুয়ারে নতুন বছর। বিভিন্ন কারণে ২০২০ সাল মহাকালের ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে থাকবে। করোনা ভাইরাসের উৎপত্তি, মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়া, মৃত্যুর মিছিল, ভ্যাকসিনের প্রত্যাশা ইত্যাদি এ বছর ছিল আলোচিত বিষয়। বিশে বিষময় এমন একটি বছরে করোনা ভাইরাস ছাড়াও বেশ কিছু ঘটনা আলোচিত-সমালোচিত হয়েছে বছরের বিভিন্ন সময়। আমাদের অর্জন, হতাশা, বেদনা, প্রাপ্তি, প্রত্যাশা পূরণের সেই ঘটনাগুলো আরেকবার দেখে নিতেই এই আয়োজন। এই পর্বে থাকছে বিভিন্ন দেশের বিখ্যাত অনেক মানুষদের মধ্যে যারা মৃত্যুবরণ করেছেন তাদের কয়েকজনের পরিচিতি ( খেলা ও বিনোদন দুনিয়ার প্রয়াতদের আলোচনা সংশ্লিষ্ট সালতামামির লেখায় রয়েছে) । গ্রন্থনা ও সম্পাদনা করেছেন ফয়জুল আল আমীন
প্রণব মুখার্জি
ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি এ বছরের ৩১ আগস্ট পৃথিবী থেকে বিদায় নেন। মস্তিষ্কের অস্ত্রোপচারের পর তিন সপ্তাহের বেশি সময় ধরে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন তিনি। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল প্রায় ৮৫ বছর।
এর আগে গত ৯ আগস্ট রাতে দিল্লির বাড়িতে বাথরুমে পড়ে গুরুতর আহত হন প্রণব মুখার্জি। পর দিন সকাল থেকে তার স্নায়ুতে কিছু সমস্যা দেখা দেয়। চিকিৎসকদের পরামর্শে দ্রুত ভর্তি করা হয় হাসপাতালে। এমআরআই করে দেখা গেছে মাথার ভেতর রক্ত জমাট বেঁধে রয়েছে। জরুরি ভিত্তিতে অস্ত্রোপচারের সিদ্ধান্ত নেন চিকিৎসকরা। কিন্তু অস্ত্রোপচারের পর অবস্থার উন্নতি হয়নি। ১৩ আগস্ট থেকে তিনি গভীর কোমায় চলে যান।
প্রণব মুখার্জি দীর্ঘ দিন ধরে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত ছিলেন। হাসপাতালে ভর্তির পর ধরা পড়ে তিনি করোনায় আক্রান্ত। এমন অবস্থাতেই ওই দিন রাতে দীর্ঘ অস্ত্রোপচার হয় তার। এর পরেই ভেন্টিলেশনে রাখা হয়েছিল প্রণব মুখার্জিকে। অস্ত্রোপচারের আগে নিজের করোনা সংক্রমিত হওয়ার খবর টুইট করে জানিয়েছিলেন তিনিই।
হোসনে মোবারক
এবছরের শুরু দিকে মিসরের সাবেক প্রেসিডেন্ট হোসনে মোবারক কায়রোর একটি হাসপাতালে মারা যান। প্রায় ৩০ বছর ধরে ক্ষমতায় থাকা সাবেক এই প্রেসিডেন্ট ৯১ বছর বয়সে মারা যান।
১৯৮১ সালে প্রথমবার মিসরের ক্ষমতায় আসেন হোসনি মোবারক। ২০১১ সালের জানুয়ারিতে শুরু হওয়া ১৮ দিনের অভ্যুত্থানে ১১ ফেব্রুয়ারি ক্ষমতাচ্যুত হন তিনি। কিন্তু অভ্যুত্থানের দিনগুলোতে তার নির্দেশে নিরাপত্তা বাহিনীর গুলিতে ২৩৯ জন বিক্ষোভকারী নিহত হন বলে আদালতে প্রমাণিত হয়। ফলে ২০১২ সালে নিম্ন আদালত তাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়। পরবর্তীকালে দেশটিতে গণতন্ত্রের সুবাতাস বয়ে যায়। দেশটিতে সাধারণ নির্বাচনে বিজয়ী হন মোহাম্মদ মুরসি। কিন্তু তিনি তৎকালীন সেনাপ্রধান আবদেল ফাতাহ সিসির হাতে ক্ষমতাচ্যুত হন। পরে জোর করে ক্ষমতা দখল করা স্বৈরশাসক সিসি সাবেক স্বৈরাচার হোসনে মোবারকের মুক্তিতে ভূমিকা রাখেন। সিসি সরকার তাকে আপিল বিভাগের রায়ে বেকসুর খালাস দেয়। ২০১৭ সালের মার্চে মুক্তি পান তিনি।
১৯২৮ সালে জন্ম নেয়া হোসনে মোবারক তরুণ বয়সে মিসরের বিমান বাহিনীতে পাইলট হিসেবে যোগ দেন। ১৯৭৩ সালে আরব-ইসরায়েল যুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন তিনি। পরে এক দশকেরও কম সময়ের মধ্যে প্রেসিডেন্ট হয়ে যান তিনি। তৎকালীন প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাতের হত্যাকাণ্ডের পর ক্ষমতাসীন হন মোবারক।
- আরও পড়ুন >> ফিরে দেখা ২০২০: বিশ্বের ক্ষমতাধর যত নারী
ইসরায়েল-ফিলিস্তিন শান্তি প্রক্রিয়াতেও ভূমিকা রাখেন তিনি। তার আমলে মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ মিত্র হয়ে ওঠে মিসর। এ সময় মিসর শত শত কোটি ডলারের সামরিক সহায়তা পেলেও বেকারত্ব, দারিদ্র্য ও দুর্নীতি বাড়তে থাকে। আর এর জের ধরেই আরব বসন্তের অভ্যুত্থানে ক্ষমতা ছাড়তে হয় তাকে।
কুয়েতের আমির শেখ সাবাহ
এ বছরের শেষদিকে কুয়েতের আমির শেখ সাবাহ আল-আহমেদ আল-সাবাহ ৯১ বছর বয়সে মারা যান। অসুস্থ হয়ে কুয়েতের হাসপাতালে কিছুদিন ভর্তি থাকার পর গত জুলাইয়ে উন্নত চিকিৎসার জন্য শেখ সাবাহ যুক্তরাষ্ট্রে গিয়েছিলেন। সেখানেই হাসপাতালে তার মৃত্যু হয়।
শেখ সাবাহ ২০০৬ সাল থেকে কুয়েতের আমির হিসেবে দায়িত্ব পালন করে এসেছেন। আর প্রায় ৫০ বছর ধরে দেশটির পররাষ্ট্র নীতি তদারক করেছেন তিনি।
১৯৯০-৯১ সালে ইরাকের কুয়েত আগ্রাসনকে সমর্থন দেওয়া দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক পুনঃস্থাপনে ভূমিকার জন্য সাবাহকে বলা হত ‘আরব কূটনীতির ডিন’।
তাছাড়া, আঞ্চলিক নানা বিরোধ নিস্পত্তিতেও মধ্যস্ততাকারীর ভূমিকা পালন করেছিলেন শেখ সাবাহ আল-আহমেদ আল-সাবাহ।সম্প্রতি সৌদি আরব ও এর মিত্র দেশ এবং কাতারের মধ্যকার কূটনৈতিক অচলবস্থা নিরসনে কাজ করেছিলেন তিনি। সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ থেকেও কুয়েতকে দূরে সরিয়ে রেখেছিলেন সাবাহ। যুদ্ধে জড়ানোর বদলে দেশটিতে মানবিক ত্রাণ সহায়তার জন্য বেশ কিছু দাতা সম্মেলন আয়োজন করেছিলেন কুয়েতের এই আমির।
২০০৬ সালে কুয়েতের তৎকালীন আমির শেখ সাদ আল-আবদুল্লাহর পদত্যাগের পর জানুয়ারিতে ক্ষমতায় এসেছিলেন শেখ সাবাহ আল-আহমেদ আল-সাবাহ।
এর আগে তিনি কুয়েতের আরেক সাবেক আমির শেখ জাবের আল-আহমেদ আল-জাবের আল-সাবাহর অধীনে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছিলেন। এরও আগে ১৯৬৩ থেকে ১৯৯১ সাল পর্যন্ত এবং ১৯৯২ থেকে ২০০৩ সাল পর্যন্ত কুয়েতের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্বও পালন করেছিলেন শেখ সাবাহ।
বিশ্বের ষষ্ঠ বৃহত্তম তেলের ভান্ডার এবং যুক্তরাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ মিত্রদেশ কুয়েত। দেশটির ৪৮ লাখ জনসংখ্যার ৩৪ লাখই বিদেশি।
গত ২৬০ বছর ধরে কুয়েত শাসন করছে সাবাহ পরিবার।দেশটির রাজনৈতিক বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দিয়ে থাকেন আমিরই। পার্লামেন্ট বাতিল করা কিংবা ভেঙে দিয়ে নির্বাচন ডাকার ক্ষমতাও থাকে আমিরের হাতে।