জানুয়ারির ২ তারিখ ভোরবেলা খবরটি দেখে একেবারে স্তব্ধ হয়ে গেলাম। ভেবেছিলাম রাক্ষুসী ২০২০ সালটি আমাদের সব প্রিয়জনকে নিয়ে বুঝি শান্ত হয়েছে, নতুন বছরেও যে সেটি এসে হানা দেবে বুঝতে পারিনি। বছরের একেবারে শুরুতেই আমাদের আয়শা আপা যাকে এই দেশের সবাই ‘নারীনেত্রী আয়শা খানম’ হিসেবে চেনে, তাকে নিয়ে গেল। আমরা অনেকদিন থেকেই জানি তার শরীর ভালো না, ক্যান্সার শরীরে বাসা বেঁধেছে, তিনি মাঝে মাঝেই হাসপাতালে যাচ্ছেন এবং আসছেন। মাত্র কয়েক সপ্তাহ আগে কী কারণ জানা নেই, তার সাথে আমাদের কথা বলার ইচ্ছা করল। আমার স্ত্রী ফোন করেছে, তিনি ফোন ধরেছেন অনেক্ষণ তার সাথে কথা হয়েছে, তিনি তার স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে কথা বলেছেন। এত বড় একজন মানুষ কিন্তু তার সাথে আমার খুব একটা সহজ সম্পর্ক ছিল। আমার সাথে সবসময় কৌতুক করতেন, পরিহাস করতেন! আমার স্ত্রীর সাথে তার আরও বেশি ঘনিষ্ঠতা ছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের মেয়েদের কিংবা মহিলা শিক্ষকদের অসংখ্য সমস্যা নিয়ে আমার স্ত্রী মহিলা পরিষদের সাহায্য নিয়েছে এবং আমরা সবসময় মহিলা পরিষদ বলতেই অন্য সবার আয়শা খানম এবং আমাদের আয়শা আপাকে বুঝেছি। (আমি জানি এ ধরনের লেখালেখিতে একজন গুরুত্বপূর্ণ মানুষকে তার সঠিক নাম এবং পরিচয় দিয়ে সম্বোধন করা উচিত, কিন্তু তাকে সবসময় যেভাবে আপনজন হিসেবে আয়শা আপা বলে এসেছি সেভাবে না লিখে পারছি না, পাঠকরা নিশ্চয়ই ক্ষমা করে দেবেন।)
আমি কতবার কত বিচিত্র কারণে যে আয়শা আপার সাহায্য নিয়েছি সেটি বলে শেষ করতে পারব না। একটা উদাহরণ দিলে বোঝা যাবে। একবার একটি মেয়ে অনেক কষ্ট করে তার কোনো এক বান্ধবীর সাহায্য নিয়ে আমাকে একটি চিঠি পাঠাল। চিঠিতে লেখা সে লেখাপড়ায় খুবই ভালো কিন্তু তার পরিবার হঠাৎ করে পুরোপুরি মৌলবাদী হয়ে শুধু যে তাকে বোরকা পরিয়ে আপাদমস্তক ঢেকে ফেলিয়েছে তা নয়, তার লেখাপড়াও বন্ধ করে দেবে বলে ঠিক করেছে। সে এখন কীভাবে তার লেখাপড়া চালিয়ে যাবে, আমার কাছে সেটি জানতে চেয়ে মোটামুটি একটা হৃদয়বিদারক চিঠি লিখেছে। এ রকম সময় যা করতে হয় আমি তাই করলাম, আয়শা আপাকে ফোন করে তার সাহায্য চাইলাম। আয়শা আপা বললেন, পরিবার আসলেই যদি তার পড়াশোনা বন্ধ করে দেয় তাহলে তাকে মহিলা পরিষদের হোস্টেলে এনে রেখে পড়াশোনা করানো যাবে, আপাতত সে নিজেই পরিবারকে বোঝানোর চেষ্টা করুক। আমি মেয়েটিকে সেটাই বললাম, সে পরের পরীক্ষায় এমন ভালো করার চেষ্টা করুক যেন নেহায়েৎ পাষণ্ড না হলে কেউ তার লেখাপড়া বন্ধ করার কথা চিন্তাও করতে না পারে। আর যদি সত্যি বন্ধ করে ফেলা হয় আমরা তার পড়ার ব্যবস্থা করে দেব! মেয়েটি কোমর বেঁধে লেগে গেল, সত্যি সত্যি মেয়েটির অসাধারণ ভালো ফলাফল দেখে তার পরিবার শেষ পর্যন্ত লেখাপড়া বন্ধ করেনি। ইউনিভার্সিটির ডিগ্রি নিয়ে, বিসিএস পাস করে সরকারি চাকরি নিয়ে, পছন্দের ছেলেটিকে বিয়ে করে সে এখন স্বামী-পুত্র নিয়ে চমৎকার একটা জীবনযাপন করছে, সবকিছু সম্ভব হয়েছে শুধু আয়শা আপা সাহস দিয়েছেন দেখে।
আরেকবার আমার স্ত্রী প্রফেসর ইয়াসমীন হকের খুব কাছের একজন তরুণী শিক্ষক হঠাৎ করে রহস্যময়ভাবে মারা গেছে, অনেক বুঝিয়েও তার পরিবারের সদস্যদের পোস্টমর্টেম করানোর জন্য রাজি করানো গেল না, তাহলে রহস্যের একটুখানি হলেও কিনারা হতো। মেয়েটিকে কবর দেয়ার কিছুক্ষণ পর হঠাৎ করে পরিবারের বোধোদয় হলো, তারা বুঝতে পারল খুব ভুল হয়ে গেছে, পোস্টমর্টেম করা প্রয়োজন ছিল। আবার আয়শা আপার কাছে ছুটে যাওয়া হলো, আয়শা আপা তার মহিলা পরিষদের শক্তিশালী টিম লাগিয়ে দীর্ঘ আইনি জটিলতার ভেতর দিয়ে গিয়ে তার দেহটিকে কবর থেকে তুলে পোস্টমর্টেম করে দেয়ার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। শুধু এটিই নয় যখনই বিশ্ববিদ্যালয়ে ধর্ষণের মতো কোনো ভয়াবহ ঘটনা ঘটে যেত, তখন আমরা সবাই সবার আগে আয়শা আপার কাছে ছুটে যেতাম। আমরা জানতাম বিশাল মহীরুহের মতো তিনি এই দেশের সব নির্যাতিতা মেয়েদের বুক আগলে রক্ষা করতেন।
শুরুতে বলেছিলাম যে আয়শা আপার সাথে আমার একটা সহজ সম্পর্ক ছিল, তার একটা কারণও আছে। ১৯৯৮-৯৯ সালের দিকে জার্মানি থেকে বাঙালিদের একটা সংগঠন নারীনেত্রী আয়শা খানম, সঙ্গীতশিল্পী ফরিদা পারভীনের সাথে আমাকেও সেখানকার একটা সেমিনারে আমন্ত্রণ জানিয়েছে। তখন আয়শা আপার সাথে আমার পরিচয় হয়েছে, একসাথে ভিসা নিতে জার্মান অ্যাম্বাসিতে গিয়েছি। দুইজন পাশাপাশি বসে ফর্ম পূরণ করে জমা দেয়ার পর আবিষ্কার করা হলো আমি ফর্মের ভেতর পুরুষ/মহিলা অংশে নিজেকে ‘মহিলা’ হিসেবে টিক দিয়ে বসে আছি! মনে আছে আমি তখনই আয়শা আপাকে বলেছিলাম, “আপনি নিশ্চয়ই অসম্ভব প্রভাবশালী একজন নারীনেত্রী, তাই শুধু পাশে বসে ফর্ম ফিলআপ করার সময় আপনার প্রভাবে আমি জলজ্যান্ত পুরুষ হয়ে নিজেকে নারী হিসেবে ঘোষণা করে বসে আছি!”
জার্মানিতে গিয়ে বেশ কয়েকদিন আয়শা আপাকে খুব কাছে থেকে দেখার সুযোগ পেয়েছি। আমি জানতাম তিনি তরুণ বয়সে ছাত্র রাজনীতি করেছেন, জার্মানিতে গিয়ে আমি তার সেই পরিচয় টের পেতে শুরু করলাম। আয়োজকরা আমাদের নানা শহরে নিয়ে যেত, সেখানে ফরিদা পারভীনের অপূর্ব লালনগীতির আগে আমাকে আর আয়শা আপাকে কিছু বলতে হতো। আমি কী বলতাম এতদিন পর আর মনে নেই, কিন্তু মনে আছে, দর্শকদের সাথে আমি মুগ্ধ হয়ে আয়শা আপার বক্তব্য শুনতাম। রাজনীতির পুরো বিষয়টি নিয়ে তার খুব স্বচ্ছ একটা ধারণা ছিল। মনে আছে, আয়োজকরা মাঝেমাঝেই আমাদের স্থানীয় রেডিও স্টেশনে নিয়ে যেত, সেখানে আমাদের ইন্টারভিউ দিতে হতো। দেশে থাকলে দেশের সমস্যা নিয়ে গলা ফাটিয়ে চেচামেচি করি কিন্তু বিদেশের মাটিতে ভুলেও দেশ সম্পর্কে একটিও খারাপ মন্তব্য করি না।
সেই দিনগুলোর কথা মনে হলে এখন মাঝেমাঝে আমার একটু খারাপ লাগে, কারণ আমি অনেক সময়েই আমার নিজের ইচ্ছাটুকু জোর করে আয়শা আপার ওপর চাপিয়ে দিয়েছিলাম, তিনি সেগুলো সস্নেহে সহ্য করেছেন। যেমন: গটিনজেন বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে তাকে টেনে ওয়েবার এবং গাউসের ভাস্কর্য দেখিয়েছি, রীতিমতো জোর করে এই বিজ্ঞানী এবং গণিতবিদের গল্প শুনিয়েছি, দীর্ঘ পথ হাঁটিয়ে তাকে ম্যাক্স প্লাংকের মতো বড় বিজ্ঞানীদের সমাধি দেখানোর জন্য সমাধিক্ষত্রে নিয়ে গেছি। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে লুকিয়ে থাকা বালিকা অ্যানি ফ্রাংকের ডাইরির কথা কে না জানো। যে বার্গেন বেলসেন কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে সে মারা গিয়েছিল সেটা দেখার জন্য তাকে নিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ড্রাইভ করে গিয়েছি, অ্যানি ফ্রাংকের গণকবরটি দেখে এসেছি। আমার এইসব বিচিত্র কৌতুহল তিনি সহ্য করেছেন।
- আরও পড়ুন >> নতুন বছরের নতুন প্রত্যাশা ।। ড. আতিউর রহমান
অনেকদিন একসাথে থাকার জন্য আয়শা আপার সাথে খুব সহজ একটা সম্পর্ক হয়েছিল। ঢাকা ফিরে এসে তাঁর পুরো পরিবারের সাথে আমাদের পুরো পরিবারের একটি ঘনিষ্ঠতা হয়েছিল। মনে আছে, আয়শা আপার স্বামী মর্ত্তুজা ভাইয়ের এলাকার একটা স্কুল স্থাপনের অনুষ্ঠানে যোগ দেয়ার জন্য আমি তার সাথে নেত্রকোনা গিয়েছিলাম। সেখানে অনুষ্ঠানের যে ছবিটি তোলা হয়েছিল সেই ছবিটি বড় করে আমার বাসায় টানানো আছে। প্রচণ্ড বৃষ্টির মাঝে নেত্রকোনায় একটা গাড়ি দুর্ঘটনায় যখন একেবারে হঠাৎ করে মর্ত্তুজা ভাই মারা গেলেন আমরা একেবারে স্বজন হারানোর ব্যথায় কাতর হয়েছিলাম। দেখতে পেলাম হঠাৎ করে আয়শা আপা একা হয়ে গেলেন, তার সমস্ত সময় তিনি তখন এই দেশের নারীদের পেছনে দিতে শুরু করলেন।
আমাদের দৈনন্দিন জীবনে আমি ছাত্র-শিক্ষকদের দেখি, মাঝে মাঝে কবি সাহিত্যিক বুদ্ধিজীবীদেরও দেখি কিন্তু কাছে থেকে একজন নেতা বা নেত্রীকে দেখার সুযোগ পাই না। আয়শা আপা আমাকে সেই সুযোগটি করে দিয়েছিলেন। তারা কীভাবে কথা বলে, সিদ্ধান্ত নেয়, নেতৃত্ব দেয় আমি সেটা দেখতে পেরেছিলাম। সেই তরুণ বয়সে রাজনীতি করেছেন, মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছেন, সেই সময়ে একজন কমবয়সী তরুণীর জন্য বিষয়টি কতো বিপদসংকুল ছিল আমরা কি এখন সেটি কখনো অনুভব করতে পারব?
সারাটি জীবন মেয়েদের অধিকার নিয়ে কাজ করেছেন। আমার কিংবা আমার স্ত্রীর যখনই কোনো মেয়েকে আলাদাভাবে সাহায্য করতে হয়েছে কিংবা কারও পাশে দাঁড়াতে হয়েছে, তখন যদি কোনো সাহায্যের প্রয়োজন হয়েছে আমরা সবসময় জেনে এসেছি যে, আমাদের পাশে আয়শা আপা আছেন। তাকে বললেই কোনো না কোনো ব্যবস্থা হয়ে যাবে। হঠাৎ করে আমারা একা হয়ে গেলাম। একেবারেই একা।
লেখক: শিক্ষাবিদ ও কথাসাহিত্যিক।
জানুয়ারি ৫, ২০২১