আজব দেশের আবার রাজনীতি। মার্কিন মুলু্লকে ট্রাম্পের কাণ্ড-কারখানায় সারা বিশ্ব যখন হতবাক, তখন বাংলাদেশেও একটা ছোটখাটো কাণ্ড ঘটে গেছে। আমেরিকায় একজন মানুষকে পাগলামিতে পেয়েছে, বাংলাদেশে পাগলামিতে পেয়েছে একটা রাজনৈতিক দলকে। দলটি বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি)। এই দলের একটানা ১৩ বছর যিনি সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন এবং এখন পার্টির উপদেষ্টা পদে আছেন, তাঁকে একটি সাপ্তাহিক কাগজে কলাম লিখে নিজস্ব মত ব্যক্ত করার দায়ে ছয় মাসের জন্য ওই পদ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। এই নেতার নাম কমরেড মনজুরুল আহসান খান।
চার্চিল বলেছেন, ‘কোনো কোনো সময় কোনো কোনো দল ও জাতিকে কানেকটিভ ম্যাডনেসে পেয়ে বসে।’ সিপিবিকেও এই একই রোগে ধরেছে কি না জানি না। মনজুরুল আহসান খানের অপরাধ, তিনি তাঁর কলামে হাসিনা সরকারের বিভিন্ন সাফল্যের প্রশংসা করেছেন। তাঁর কলামটির শিরোনাম ‘বাংলাদেশের পঞ্চাশ বছর’। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশ নিয়ে তাঁকে লিখতে হয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা লাভ থেকে যমুনা ও পদ্মা সেতু নির্মাণ ইত্যাদি উন্নয়ন কার্য দ্বারা দেশ যেভাবে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে এগিয়ে চলেছে তার তিনি প্রশংসা করেছেন।
মনজুরুল আহসান খান তাঁর নিবন্ধে শেখ হাসিনার একটি বিরোধী দলের নেতা হয়েও হাসিনা সরকারের উন্নয়নকাজের সাফল্যকে স্বীকৃতি দিয়েছেন। তিনি বাড়িয়ে কিছু লেখেননি। যা বাস্তব সত্য তা-ই তুলে ধরেছেন। দেশ যে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়েছে, যমুনা ও পদ্মা সেতু যে নির্মিত হয়েছে, দেশ যে ক্রমেই এগিয়ে চলেছে তা কি অসত্য কথা? যদি অসত্য কথা না হয়, তাহলে একটি বিরোধী দলের নেতা হয়ে তিনি যে সরকারের সাফল্যগুলোর স্বীকৃতি দিলেন এটা তো বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটা ইতিবাচক দিক। বিদেশে প্রতিপক্ষের সাফল্যকে স্বীকৃতি দিয়ে কোনো রাজনৈতিক নেতা বক্তৃতা-বিবৃতি দিলে তিনি বাহবা পান। আর বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি সত্য কথা বলার সাহস দেখানোর জন্য তাদের তিন দফা সভাপতির দায়িত্ব পালনকারী নেতার মুখে কালি লেপে দিল। এই কালি কি তাদের সবার মুখে লাগেনি?
ব্রিটেনে টোরি পার্টি ও লেবার পার্টির মধ্যে আদর্শগত তীব্র বিরোধের কথা সবারই জানা। এই টোরি পার্টিতে চার্চিল যখন নেতা, তখন প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দলের নেতা ক্লিমেন্ট এটলি চার্চিলের জন্মদিনের পার্টিতে এসে তাঁকে শ্রদ্ধা জানিয়ে বলেছিলেন, ‘সিজারকে কবর দিতে আসিনি, শ্রদ্ধা জানাতে এসেছি।’ লেবার পার্টির নেতা শ্রদ্ধা জানাচ্ছেন টোরি পার্টির নেতাকে, তাঁকে সিজারের সঙ্গে তুলনা করছেন। তাতে তাঁর দল বা দেশের কেউ এটলির প্রতি রুষ্ট হয়নি, দল তাঁকে নেতার পদ থেকে সাময়িকভাবে অব্যাহতি দেয়নি, বরং তাঁর প্রশংসা করেছে।
সিপিবির বর্তমান আওয়ামী লীগবিদ্বেষকে আমার এক বন্ধু ‘তালাক নেওয়া স্ত্রীর স্বামীবিদ্বেষের’ সঙ্গে তুলনা করেছেন। নইলে এমন কী হলো, স্বাধীনতার আন্দোলন, স্বাধীনতার যুদ্ধ, স্বাধীন দেশে গঠনমূলক কর্মকাণ্ড, গণঐক্যজোট গঠন, বাকশালে যোগদান ইত্যাদি সব কাজে আওয়ামী লীগের ছায়া সহচর হয়ে থাকার পর আজ কয়েক বছর যাবৎ সিপিবির এই প্রচণ্ড আওয়ামী লীগবিদ্বেষ, হাসিনাবিদ্বেষের কারণ কী? আজকাল তো সিপিবির কাছে মস্কো বা দিল্লি থেকে কোনো ‘ওহি’ আসে বলে জানি না। তাহলে যে কমিউনিস্ট পার্টি পাকিস্তান আমলে গণতন্ত্রের ওপর আঘাত এলে নিজেদের অস্তিত্ব ভুলে সমমনা দলগুলোর সঙ্গে ঐক্য গড়ে সংগ্রামে নেমেছে, আজ সেই দল ঐক্যের নামে ভয় পায় কেন? অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র গঠনে আওয়ামী লীগের সহযোগী দল হতে এত আপত্তি কেন? বাম গণতান্ত্রিক ঐক্য গড়ার নামে কিছু নামসর্বস্ব দল নিয়ে জনগণকে বারবার প্রতারণা করা কেন? আগে না হয় ‘পিতৃভূমি’ সোভিয়েত ইউনিয়নের স্বার্থে জাতীয় স্বার্থকে উপেক্ষা দেখানো হতো। এখন কাদের স্বার্থে সিপিবি দেশে আওয়ামী লীগকে সঙ্গে নিয়ে সাম্প্রদায়িকতাবিদ্বেষী ও ধর্মান্ধতাবিরোধী ঐক্যজোট গঠনে এত বিমুখ?
হতে পারে আওয়ামী লীগ আজ সঠিক পথে চলছে না। বঙ্গবন্ধুর আদর্শ থেকেও আওয়ামী লীগ অনেক পিছিয়ে এসেছে। তাহলেও তো আওয়ামী লীগকে সঠিক পথে ধরে রাখার দায়িত্ব কমিউনিস্ট পার্টির। পঞ্চাশের দশকে সাম্প্রদায়িকতা ও অসাম্প্রদায়িকতার আদর্শের মধ্যে আওয়ামী লীগ ঘুরপাক খাচ্ছিল, তখনো আওয়ামী লীগকে অসাম্প্রদায়িক চরিত্র ধারণে সাহায্য করেছে কমিউনিস্ট পার্টি। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের ধর্মনিরপেক্ষ ও সমাজতান্ত্রিক চরিত্র গঠনে সাহায্য জুগিয়েছে, পথ দেখিয়েছে কমিউনিস্ট পার্টি। ছয় দফার আন্দোলনে ১১ দফার শক্তি যোগ করেছে কমিউনিস্ট পার্টি। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছে। বঙ্গবন্ধুর শোষিতের বিপ্লবে যোগ দেওয়ার জন্য বাকশালে আত্মবিলুপ্তি পর্যন্ত ঘটিয়েছে সিপিবি। কমিউনিস্ট পার্টিকে বলা হলো আওয়ামী লীগের পাইলট জেট। অর্থাৎ আওয়ামী লীগের মতো বিরাট জাহাজকে কমিউনিস্ট পার্টিই সামনে পথ দেখিয়ে টেনে চলে, সেই আওয়ামী লীগের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর কমিউনিস্ট পার্টির হঠাৎ একযোগে চলা ‘বৈজ্ঞানিক ভুল’ বলে মনে হলো কেন?
আওয়ামী লীগ শ্রেণি সংগঠন নয়, একটি পশ্চিমা ধাঁচের গণতান্ত্রিক দল। অনেকটা ব্রডবেজ চার্চের মতো। এখানে পাজিতাজি পুণ্যবান সবারই স্থান রয়েছে। তবু এই দল জনগণের দ্বারা সমর্থিত দেশের সবচেয়ে বড় দল। এই দলকে বাদ দিয়ে বাংলাদেশে কোনো গণ-আন্দোলনই গড়ে তোলা সম্ভব নয়। অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রের কথা, এমনকি ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শের কথা আওয়ামী লীগ এখনো বলে। আওয়ামী লীগের বিকল্প গণতান্ত্রিক দল, বিকল্প গণতান্ত্রিক নেতৃত্ব কমিউনিস্ট পার্টিও আজ পর্যন্ত গড়ে তুলতে পেরেছে কি?
আজ দেশে যখন ধর্মান্ধতা ও হিংস্র মৌলবাদ আবার মাথা তুলেছে, তখন ঐক্যবদ্ধভাবে এই দানবকে প্রতিহত করার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেছে আওয়ামী লীগের এককালের জাতশত্রু ওয়ার্কার্স পার্টি, জাসদ, বাসদ প্রভৃতি দল। তারা মহাজোট গঠন করেছে। আর আওয়ামী লীগের পরিচিত ও পুরনো রাজনৈতিক সঙ্গী ও বন্ধু আজ ‘একলা চলার’ নীতি গ্রহণ করে না পারছে বিকল্প বাম গণতান্ত্রিক শক্তি গড়ে তুলতে, না পারছে হিংস্র মৌলবাদীদের রুখে দিতে। তারা তাদের একলা চলার বক্তব্য দিয়ে শক্তি জোগাচ্ছে বিএনপি-জামায়াত-হেফাজত গোষ্ঠীকে। এই সত্যটি কি তারা এত দীর্ঘ কয়েক বছরেও উপলব্ধি করতে পারেনি?
স্বাধীনতাসংগ্রামের গেরিলা যোদ্ধা এবং সিপিবির সাবেক সভাপতি ও বর্তমানে উপদেষ্টা (ছয় মাসের জন্য অব্যাহতিপ্রাপ্ত) কমরেড মনজুরুল আহসান খানের নিবন্ধটি আমি পড়েছি। তাতে নতুন কথা কিছু নেই। আর দশজন যেমন ভাষাসংগ্রাম থেকে স্বাধীনতার যুদ্ধ পর্যন্ত বাংলাদেশের ইতিহাস পর্যালোচনা করেন, তিনিও তেমনি করেছেন। শুধু বাংলাদেশের সাম্প্রতিক সময়ের উন্নয়নের সাফল্যের জন্য হাসিনার নেতৃত্বের প্রশংসা করেছেন। এই প্রশংসা দেশে-বিদেশে শেখ হাসিনার শত্রুরাও করেছেন। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় হাসিনার নেতৃত্ব আজ স্বীকৃত এবং প্রতিষ্ঠিত। তাঁর সবচেয়ে বড় সাফল্য তিনি ’৭১-এর যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করেছেন এবং শাস্তি দিয়েছেন। বাংলাদেশের রাজনীতি থেকে ভারতবিদ্বেষের বিষবাষ্প দূর করতে সক্ষম হয়েছেন। একটি আধাবুর্জোয়া গণতান্ত্রিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগ তার গণতান্ত্রিক দায়িত্ব যতটা সম্ভব পালন করেছে। এখন সমাজতান্ত্রিক পথ তৈরির দায়িত্ব তো কমিউনিস্ট ও তাদের সমমনা দলগুলোর। তাদের আন্তর্জাতিক সংযোগও আছে। তাদের শক্তিশালী শ্রমিক ফ্রন্ট, ছাত্রফ্রন্ট ছিল। আজ কিছু নেই। জনগণ থেকে তারা সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন। আওয়ামী লীগের মতো বড় দলের সহযোগিতা ছাড়া ধর্মান্ধতায় আচ্ছন্ন একটা জাতিকে তারা ধর্মনিরপেক্ষ সমাজতন্ত্রের পথে কী করে এগিয়ে নিয়ে যাবেন?
গণতন্ত্র, বাকস্বাধীনতার নামে যে সিপিবি অনবরত চিৎকার করে, তাদের নিজের ঘরেই বাকস্বাধীনতা নেই, ভিন্নমত পোষণের অধিকার নেই, এটা খুবই কৌতুকের কথা। কমরেড মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম ব্যক্তিগতভাবে আমার বন্ধু। মুক্তিযোদ্ধা এবং খাঁটি সাম্যবাদী। তিনিই এখন বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সভাপতি। তাঁর নেতৃত্বে কমিউনিস্ট পার্টি মনজুরুল আহসান খানের মতো একজন পরীক্ষিত কমিউনিস্ট নেতার বিরুদ্ধে সম্পূর্ণ অবিবেচক শাস্তিমূলক ব্যবস্থা কী করে গ্রহণ করেন তা আমি বুঝতে অক্ষম। তাঁর লেখার কোন অংশ বা কোন বক্তব্য সিপিবির নীতি ও আদর্শের সঙ্গে সাংঘর্ষিক, তা-ও সিপিবি নেতারা বলেননি। শুধু ঢালাওভাবে মনজুরুল আহসান খানের লেখার এক অংশ তাঁদের নীতিবিরোধী বলা হয়েছে। সিপিবির সাবেক সভাপতি তাঁর রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও সহিষ্ণুতা দ্বারা তাঁর দলের এই হঠকারী নীতি মেনে নিয়েছেন।
আমি আমার জীবনে অবিভক্ত ও বিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টিকে কখনো যথাসময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে দেখিনি। ভারতে সিবিআই সেই ব্রিটিশ আমল থেকে যে ভুল করে চলছে, সেই একই ভুলের পুনরাবৃত্তি করে চলেছে সিপিবি। মহামতি মার্ক্স সাহেব তাদের সহায় হোন।
লন্ডন, সোমবার, ১১ জানুয়ারি ২০২১