ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির আগমনে সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার ঈশ্বরীপুর ইউনিয়নের যশেরেশ্বরী কালীমন্দির এবং সংলগ্ন এলাকায় শুরু হয়েছে উৎসবের সাজে। চারদিকে সাজ সাজ রব চলছে। নেয়া হয়েছে তিন স্তরের নিরাপত্তা।
স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে বাংলাদেশ আসছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। ২৬ মার্চ তিনি ঢাকায় পৌঁছাবেন। ২৭ মার্চ ঈশ্বরীপুর যশেরেশ্বরী কালি মন্দির পরিদর্শন ও পূজা-অর্চনায় অংশ নেবেন।
হিন্দু সম্প্রদায়ের ৫১ শক্তিপীঠের মধ্যে শ্যামনগর উপজেলার যশোরেশ্বরী কালীমন্দির একটি শক্তিপীঠ। শক্তিপীঠের ৫১ খণ্ডর একখণ্ড দেখতে সাতক্ষীরা উপকূলের এই মন্দিরে আসছেন নরেন্দ্র মোদি।
এদিন সকাল ৯টা ৫০ মিনিটে সাতক্ষীরার সুন্দরবন ঘেঁষা শ্যামনগরের ঈশ্বরীপুরে অবস্থিত যশোরোশ্বরী দেবীমন্দির পরিদর্শন করবেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী। সেখানে ২০ মিনিট অবস্থান শেষে একইদিন ১০টা ১০ মিনিটে হেলিকপ্টারে প্রস্থান করবেন গোপালগঞ্জের উদ্দেশে।
নরেন্দ্র মোদির আগমন উপলক্ষে ঈশ্বরীপুর এ সোবহান মাধ্যমিক বিদ্যালয় মাঠে দুটি এবং পার্শ্ববর্তী স্থানে একটি হেলিপ্যাড প্রস্তুত করা হচ্ছে। তার আগমন উপলক্ষে মন্দির সংস্কারের কাজ চলছে পুরোদমে। মন্দির সংলগ্ন ঐতিহ্যবাহী ঈশ্বরীপুর বাজার মাঠে চলছে পাকাকরণের কাজ।
ভারতের প্রধানমন্ত্রীর আগমন উপলক্ষে ইতোমধ্যে একাধিকবার ভারত ও বাংলাদেশের পৃথক নিরাপত্তা টিম ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছে। জেলা প্রশাসন, জেলা পুলিশ, উপজেলা প্রশাসন, জনপ্রতিনিধিসহ বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিনিধি পরিদর্শন করছেন প্রতিনিয়ত। এলজিইডির তত্ত্বাবধানে এলাকার বিভিন্ন স্থানে সংস্কারে কাজ চলছে।
সরজমিনে গিয়ে দেখা যায়, মোদির আগমনে পল্লীবিদ্যুতের একটি ইউনিট উচ্চশক্তির ট্রান্সমিটার লাগানোর কাজ করছে। ওইদিন নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎসেবা দিতে তাদের কার্যক্রম থেমে নেই।
শ্যামনগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আ ন ম আবুজর গিফারী বলেন, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির শ্যামনগরে আগমন উপলক্ষে জেলা প্রশাসনের নির্দেশনা অনুযায়ী চলছে সকল ধরনের প্রস্তুতি। তার আগমন উপলক্ষে যশোরেশ্বরী মন্দিরে সংস্করণ কাজ চলছে। আমরা প্রতিনিয়ত স্থানটি প্রস্তুতে পরিদর্শন করছি।
শ্যামনগর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) নাজমুল হুদা বলেন, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির আগমন উপলক্ষে জেলা পুলিশ সুপারের নির্দেশনা মোতাবেক শ্যামনগর থানা পুলিশ প্রতিনিয়ত আগমনের স্থান পরিদর্শনসহ সবধরনের নিরাপত্তার বিষয়ে প্রস্তুতি রয়েছে।
শ্যামনগর উপজেলা মতুয়া সম্প্রদায়ের সভাপতি ও নকিপুর পাইলট মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক কৃষ্ণান্দ মুখার্জী জানান, নরেন্দ্র মোদির আগমনে মতুয়া সম্প্রদায়ের মধ্যে আনন্দের বন্যা বইছে।
যশোরেশ্বরী কালীমন্দিরের পুরোহিত দিলীপ মুখার্জি জানান, এ মন্দিরে প্রতি বছর শ্যামা কালীপূজা অনুষ্ঠিত হয়। এছাড়া প্রতি শনি ও মঙ্গলবার পূজা-অর্চনা হয়ে থাকে। এসব পূজা-অর্চনায় শত শত ভক্তের সমাগম ঘটে।
প্রসঙ্গত, শ্যামনগরে যশোরেশ্বরী কালীমন্দির প্রতিষ্ঠা সম্পর্কে ইতিহাস থেকে বিভিন্ন রকম তথ্য জানা যায়। ‘যশোহর খুলনার ইতিহাস’ প্রণেতা সতীশ চন্দ্র মিত্র এ মন্দির স্থাপনা সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্য উল্লেখ করেছেন। তাতে বলা হয়, ১৫৬০-৮০ সাল পর্যন্ত রাজা লক্ষ্মণ সেনের রাজত্বকালে তিনি স্বপ্নে আদিষ্ট হয়ে ঈশ্বরীপুর এলাকায় একটি মন্দির নির্মাণ করেন। মন্দিরটি নির্মাণের পর সেটি বন্ধ রাখারও নির্দেশ দেয়া হয়। দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার কারণে মন্দিরটি জঙ্গলাকীর্ণ হয়ে ওঠে। সে সময় শ্যামনগরের ধুমঘাট ছিল বাংলার ১২ ভূঁইয়ার এক ভূঁইয়া রাজা প্রতাপাদিত্যের রাজধানী। রাজা প্রতাপাদিত্য এসময় দেখতে পান, ওই জঙ্গল থেকে এক আলোকরশ্মি বেরিয়ে আসছে। তিনি তখন মন্দিরটি খোলার নির্দেশ দেন। মন্দিরটি খুলেই সেখানে দেখা মেলে চন্ডভৈরবের আবক্ষ শিলামূর্তি। তখন থেকে সেখানে পূজা-অর্চনা শুরু হয়।
ইতিহাসের তথ্য অনুযায়ী আরও জানা যায়, দক্ষ রাজার কনিষ্ঠ কন্যার নাম ছিল সতীবালা। তিনি জন্ম থেকে মহাদেবের পূজারিণী ছিলেন। একপর্যায়ে তিনি স্বেচ্ছায় মহাদেবকে বিবাহ করেন। এতে দক্ষ রাজার ঘোর আপত্তি ছিল। এক অনুষ্ঠানে দক্ষ রাজার উপস্থিতিতে মহাদেব আসেন। কিন্তু মহাদেব রাজাকে তার শ্বশুর বলে পরিচয় দেননি। এতে তিনি চরম অপমানবোধ করেন। পরে শুরু করেন দক্ষযজ্ঞ। এতে সতীবালা ও মহাদেব নিমন্ত্রিত ছিলেন না। এতে অপমান বোধ করেন সতীবালা। কিছুক্ষণ পরেই সতীবালা দেহত্যাগ করেন।
এ খবর পেয়ে কৈলাস থেকে দ্রুতবেগে নেমে আসেন মহাদেব। তিনি দক্ষ রাজার মুণ্ডু কর্তন করে বলির জন্য নিয়ে আসা ছাগলের মুণ্ডু কেটে সেখানে বসিয়ে দিয়ে দক্ষযজ্ঞ লণ্ডভণ্ড করে দেন। পরে তিনি মৃত স্ত্রী সতীবালাকে কাঁধে নিয়ে কৈলাস পাহাড়ে চলে গিয়ে ক্ষোভে ও দুঃখে ব্রহ্মান্ড ধ্বংস করার পরিকল্পনা করেন। এ খবর পেয়ে ব্রহ্ম ও নারায়ণ সিদ্ধান্ত নিলেন মহাদেবকে ঠান্ডা করতে হলে তার কাছ থেকে সতীবালার মৃতদেহ সরিয়ে নিতে হবে। সে অনুযায়ী ত্রিশূল দিয়ে সতীবালাকে ৫১ খণ্ড করে ত্রিশূলে ঘোরানো হয়। এর একখণ্ড এসে পড়ে বাংলাদেশের সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগর উপজেলার ঈশ্বরীপুর গ্রামে। সেখানেই প্রতিষ্ঠিত হয় যশোরেশ্বরী কালীমন্দির। অপর খণ্ডগুলো পশ্চিমবঙ্গের কালীঘাট, আফগানিস্তান, পাকিস্তানসহ বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়েছিল।