দুই সপ্তাহ আগেও দেশে করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) সংক্রমণের হার ছিল ৩ শতাংশের নিচে। শুক্রবার তা ২৩ শতাংশের বেশি। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, ২৪ ঘণ্টায় দেশে করোনাভাইরাসে সংক্রমণের হার ২৩ দশমিক ২৮ শতাংশ। অর্থাৎ কোভিড পরীক্ষা করিয়েছেন এমন প্রতি চারজনে একজনের মধ্যে এ ভাইরাস শনাক্ত হয়েছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের একজন কর্মকর্তা বলেন, যাদের পরীক্ষা করা হচ্ছে তাদের মধ্যে থেকে এখন ২৩ শতাংশের বেশি শনাক্ত হচ্ছে। এর বাইরেও অনেকেই আছে, যারা পরীক্ষা করছে না। তাই চিত্রটা কল্পনা করলে ভয় না জেগে পারে না।
এমন পরিস্থিতি সা,নে এসে হাজির হওয়ার পরও দেশে মানুষের মধ্যে সামাজিক দূরত্ব আর স্বাস্থ্যবিধি মানা হচ্ছে কম।
এভাবে চলতে থাকলে আর শনাক্তের হার বাড়তে থাকলে শুধু কোভিড রোগীদের চিকিৎসার জন্য নতুন নতুন হাসতাপাল করার প্রয়োজন হতে পারে বলে মনে করছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। তাই বর্তমানে করোন সংক্রমণের হার কমানোর দিকে মনোযোগ দেওয়াই জরুরি বলে মনে করছে সংস্থাটি।
বৃহস্পতিবার সকাল আটটা থেকে শুক্রবার সকাল আটটা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় ২৯ হাজার ৩৩৯ জনের নমুনা পরীক্ষা করা হয়। এর মধ্যে কোভিড পজিটিভ এসেছে ৬ হাজার ৮৩০ জনের। নমুনা পরীক্ষা বিবেচনায় রোগী শনাক্তের হার ২৩ দশমিক ২৮ শতাংশ। আর এ সময়ে করোনায় সংক্রমিত হয়ে মারা গেছেন ৫০ জন।
গত বছরের ৮ মার্চ দেশে প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হয়। এরপর দীর্ঘ সময় ধরেই অল্প সংখ্যক মানুষে এ ভাইরাসে সংক্রমিত হয়েছিল। ওই বছরের পুরো মার্চ মাসে শনাক্ত হয়েছিল মাত্র অর্ধশতক মানুষ। এপ্রিলের শুরুতেও শতকের নিচে ছিল করোনা শনাক্ত।
এরপর দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ চূড়ায় (পিক) উঠেছিল জুন-জুলাই মাসে। ওই সময়ে, বিশেষ করে জুনের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে জুলাই মাসের মাঝামাঝি পর্যন্ত প্রতিদিন গড়ে তিন থেকে চার হাজার রোগী শনাক্ত হতো। সেবার একদিন সর্বোচ্চ শনাক্ত পাঁচ হাজারে উঠেছিল। আগস্টের তৃতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত রোগী শনাক্তের হার ২০ শতাংশের ওপরে ছিল। এরপর থেকে নতুন রোগীর পাশাপাশি শনাক্তের হারও কমতে শুরু করে।
চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে দেশে প্রায় নিয়ন্ত্রণে এসে যাওয়া করোনাভাইরাস এরপর হঠাৎ করেই ঘুরে দাঁড়ায়। তীব্রভাবে হানা দিয়েছে এর দ্বিতীয় ঢেউ। গত কয়েক দিন ধরে চার হাজারের বেশি শনাক্ত হয় প্রতিদিন । বৃহস্পতিবার দেশে করোনা শনাক্ত হয় ৬ হাজার ৪৬৯ জন। তার আগের দিন শনাক্ত হয়েছিলেন ৫ হাজার ৩৫৮ জন। শুক্রবার শনাক্ত হলো ৬ হাজার ৮৩০ জন। এমন পরিস্থিতিতে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আরেকটি চূড়ার (পিক) দিকে যাচ্ছে দেশের সংক্রমণ পরিস্থিতি।
২০১৯ সালের শেষ দিকে চীনের উহানে প্রথম করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ধরা পড়ে। গত বছরের ৮ মার্চ দেশে প্রথম করোনা রোগী শনাক্তের ঘোষণা আসে। দেশে প্রথম করোনায় সংক্রমিত ব্যক্তির মৃত্যুর ঘোষণা আসে ১৮ মার্চ। এ পর্যন্ত দেশে মোট ৬ লাখ ২৪ হাজার ৫৯৪ জনের করোনার সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছে। এর মধ্যে মারা গেছেন ৯ হাজার ১৫৫ জন।
রাজধানীর পরিস্থিতি
দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণের হার সবচেয়ে বেশি রাজধানী ঢাকায়। এর জন্য নাগরিকদের স্বাস্থ্যবিধি না মেনে চলাকে দুষছেন বিশেষজ্ঞরা। নগরীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে ঢাকা টাইমসের প্রতিবেদকরা যে চিত্র পেয়েছেন তাতে বলা যায়, নাগরিকদের মধ্যে করোনাভাইরাসের সতর্কতা এখনো অনেক কম। মানুষের মধ্যে করোনা নিয়ে যেন এখনো তেমন ভয় কাজ করছে না।
রাজধানীর মিরপুর, মোহাম্মদপুর, বাড্ডা, যাত্রাবাড়ি, কারওয়ান বাজার এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, সকল বয়সীদের মধ্যেই স্বাস্থ্যবিধি মানায় অনীহা রয়েছে। প্রতিদিন রাতে কারওয়ান বাজারে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে সবজি আসে। ঢাকার বাইরে থেকে সবজি নিয়ে আসা পাইকার, কারওয়ান বাজারের আড়ৎদার ও ঢাকার পাইকারি ব্যবসায়ীদের রাতেভর কর্মযজ্ঞ চলে কারওয়ান বাজার এলাকায়। অথচ সেখানে নেই কোনো সামাজিক দূরত্ব বা বিন্দুমাত্র স্বাস্থ্যবিধি।
দিনের বেলায়ও প্রায় একই চিত্র দেখা গেছে কারওয়ান বাজার এলাকা জুড়ে। অফিসপাড়ার লোকজন বাদে কাউকেই সেভাবে মাস্ক ব্যবহার করতে দেখা যায়নি।
মিরপুর ও মোহাম্মদপুরের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, তুলনামূলক দরিদ্র মানুষের বসবাস এমন জায়গায় সামাজিক দূরত্ব বা স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ করা হচ্ছে না। চায়ের দোকানে মানুষের আড্ডা চলছে ঘণ্টার পর ঘণ্টা।
একই চিত্র দেখা গেছে, উত্তর বাড্ডা, মধ্য বাড্ডা, রামপুরা, বনশ্রী এলাকায়। স্বাস্থ্যবিধির একেবারেই প্রতিপালন করা হচ্ছে না কামরাঙ্গীর চর, হাজারীবাগ, রায়ের বাজার এলাকায়।
পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে চলমান অমর একুশে বইমেলার প্রতিদিনের সময় কমিয়ে মাত্র সাড়ে তিন ঘণ্টা করা হয়েছে। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে রাত আটটার পর করপোরেশন এলাকার দোকানপাট বন্ধের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। কিন্তু দিনভর দোকানপাটে স্বাস্থ্যবিধি কিংবা সামাজিক দূরত্ব মানার বালাই নেই।
গণপরিবহন ও লঞ্চের আসন সংখ্যার অর্ধেক যাত্রী পরিবহন করলেও মাস্ক ছাড়াই যাত্রী চলাচল করতে দেখা যাচ্ছে। আজ করোনা পরিস্থিতির মধ্যে মেডিক্যাল ভর্তি পরীঢক্ষা অনুষ্ঠিত হওয়া, পরীক্ষার হলের বাইরে সামাজিক দূরত্ব ও স্বাস্থ্যবিধি লঙ্ঘন করে অভিভাবকদের অবস্থান করার বিষয়টি সমালোচনার ঝড় তুলেছে। এছাড়া বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদের সামনে হেফাজতে ইসলামের বিক্ষোভেও লঙ্ঘন হয়েছে স্বাস্থ্যবিধি।
চট্টগ্রামের সংক্রমণের হার ২০ শতাংশের বেশি
বন্দরনগরি চট্টগ্রামে গত ২৪ ঘন্টায় ২ হাজার ৫৩৫টি নমুনা পরীক্ষা করে নতুন করে করোনা আক্রান্ত হয়েছেন ৫১৮ জন। শনাক্তের হার ২০ দশমিক ৪৩ শতাংশ।
এসময়ে করোনায় একজনের মৃত্যু হয়েছে। এনিয়ে চট্টগ্রামে মোট করোনা আক্রান্ত দাঁড়িয়েছে ৪০ হাজার ৮০১ জন।
শুক্রবার সিভিল সার্জন কার্যালয় থেকে প্রকাশিত প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, এইদিন কক্সবাজার মেডিক্যাল কলেজ ল্যাবসহ চট্টগ্রামে ৭টি ল্যাবে নমুনা পরীক্ষা করা হয়। নতুন আক্রান্তদের মধ্যে নগরে ৪৩৬ জন এবং উপজেলায় ৮২ জন।
কী বলছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর
বর্তমান পরিস্থিতিতে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে সংক্রমণের হার আরও অনেক বাড়বে বলে মনে করছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরর মুখপাত্র রোবেদ আমেন ঢাকা টাইমসকে জানান, সংক্রমণের হার কমানোরে দিকে দৃষ্টি দিতে হবে। এ ক্ষেত্রে আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার অনেক দায়িত্ব থাকবে বলেও জানান তিনি।
রোবেদ আমেন বলেন, সংক্রমণ না কমালে যত কিছুই করা হোক না কেন লাভ হবে না। এটা তো সারা দুনিয়াই কাভার দিতে পারছে না। সংক্রমণ কমানো ছাড়া কোনো উপায় নাই। এটার জন্য যে ব্যবস্থা নেয়া দরকার সেগুলো ১৮ দফার মধ্যে বলা হয়েছে। যারা প্রশাসনের কাজে আছেন, যারা আইনের কাজে আছেন, তাদের দায়িত্ব অনেক বেশি থাকবে।
কোভিড পরীক্ষা করার সক্ষমতা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রয়েছে। কিন্তু পরীক্ষা করে যাদের কোভিড পজিটিভ আসছে তাদের চিকিৎসা দেয়ার মতো হাসপাতাল বাড়াতে হবে জানিয়ে রোবেদ আমেন বলেন, ভাইরাসটা দুই থেকে চারজন, চার থেকে আটজন, আট থেকে ১৬ জন এভাবেই সংক্রমিত হয়। যাদের পরীক্ষা করা হচ্ছে তাদের মধ্যে থেকে ২৩ শতাংশের বেশি শনাক্ত হচ্ছে। এর বাইরেও তো অনেকেই আছে, যারা পরীক্ষা করছে না। বৈজ্ঞানিকভাবে এমনটাই হওয়ার কথা- ভাইরাস যখন একজনের থেকে একজন সংক্রমিত হবে, এখন এভাবেই বাড়বে।
যে হারে রোগী বাড়ছে তার বিপরীতে কোভিড হাসপাতালের সংখ্যা অপ্রতুল। বর্তমান পরিস্থিতি এমন ইঙ্গিত দিচ্ছে যে, নতুন নতুন হাসপাতাল বানাতে হবে শুধু কোভিড চিকিৎসার জন্য।
এ বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এ মুখপাত্র বলেন, এভাবে বাড়লে সোজা হিসেব আমাদের যা হাসপাতাল আছে, তা পূর্ণ হয়ে যাবে। অন্যান্য যে হাসপাতালগুলো নন কোভিড আছে, এমনও হতে পারে সেগুলোকে কোভিডে ট্রান্সফার করার প্রয়োজন হতে পারে। নতুন নতুন হাসপাতাল করার প্রয়োজন হতে পারে। আমাদেরকে এখন সেগুলোর ব্যবস্থা করতে হবে।
বসুন্ধরা একটা হাসপাতাল করেছিল। সেগুলো আবার সচল করা যায় কি না তা ভাবতে হবে বলে মনে করে অধিদপ্তর। যে হাসপাতাল বন্ধ করা হয়েছিল যেমন লালকুটি, সেগুলো আবার চালু করা যায় কি না, যাতে রোগী যারা আসবে তাদের যত দূর সম্ভব সেবাটা দেয়া যায়।