সম্প্রতি আলোচনা-সমালোচনার তুঙ্গে থাকা কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক সংগঠন হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের নতুন একটি অঙ্গ সংগঠন করার পরিকল্পনা হয়েছিল। ভেতরে ভেতরে সংগঠনটির নাম ও রূপরেখাও ঠিক করা হয়। ‘যুব হেফাজত’ নামে সংগঠনটির যাত্রা শুরুর প্রস্তুতিও ছিল। আর এটি বাস্তবায়নের প্রধান দায়িত্বে ছিলেন বুধবার গ্রেফতার হওয়া হেফাজতের (সদ্যবিলুপ্ত কমিটির) শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক বিষয় সম্পাদক মুফতি হারুন ইজহার।
বৃহস্পতিবার আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একটি সূত্র এই তথ্য জানিয়েছে।
এর আগে বুধবার দিবাগত রাতে নাশকতার মামলায় চট্টগ্রাম থেকে র্যাবের হাতে গ্রেপ্তার হন হেফাজত নেতা মুফতি হারুন ইজহার।
সূত্রটি বলছে, মুফতি হারুন ইজহার কওমি মাদ্রাসায় ‘মানহাজি’ নামে একটি গ্রুপের সূচনা করেন। সেখানে হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের অঙ্গ সংগঠন হিসেবে ‘যুব হেফাজত’ করার একটি প্রস্তাব পেশ করেন। সাম্প্রতিক সময়ে মুফতি হারুন ইজহার ‘গাজওয়াতুল হিন্দ’- এর সূচনা হয়েছে বলেও বিবৃতি দেন। এসময় তিনি জিহাদ ফরজ হয়েছে বলেও ঘোষণা দেন।
তবে কীভাবে সংগঠনটি (যুব হেফাজত) চলবে, কী তাদের কার্যক্রম হবে- সেসব বিষয়ে এখনো বিস্তারিত জানতে পারেনি সূত্রটি।
- আরও পড়ুন >> মাননীয় মন্ত্রী দয়া করে এসব প্রশ্নের একটু ব্যাখ্যা দিবেন কী?
- আরও পড়ুন >> ‘হেফাজত নেতা হারুন ইজাহার হাটহাজারীর সহিংসতার মদদদাতা’
এদিকে মুফতি হারুন ইজহারের বাবা মুফতি ইজহারুল ইসলাম চৌধুরী ইসলামী ঐক্যজোটের একাংশের সভাপতি। এছাড়া তিনি হেফাজতের সদ্যবিলুপ্ত কমিটির নায়েবে আমির ছিলেন।
গত ২৫ এপ্রিল রাত সাড়ে ১১টার দিকে হেফাজতের নেতা জুনায়েদ বাবুনগরী কেন্দ্রীয় কমিটি বিলুপ্ত ঘোষণা করেন। এর কয়েক ঘণ্টা পর পাঁচ সদস্যের আহ্বায়ক কমিটি ঘোষণা করা হয়।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বলছে, হেফাজত নেতা মুফতি হারুন ইজহারের মাদ্রাসা ঘিরে একসময় গড়ে উঠেছিল আন্তঃদেশীয় জঙ্গিদের ঘাঁটি। সেখান থেকেই ২০০৯ সালে ঢাকাস্থ মার্কিন দূতাবাস ও ভারতীয় হাইকমিশনারের ওপর হামলার ছক হয়েছিল। এছাড়া ২০১৩ সালের ১০ জুলাই চট্টগ্রামের লালখান বাজার মাদ্রাসায় ভয়াবহ গ্রেনেড বিস্ফোরণে তিনজন নিহত হয়। এই ঘটনার সঙ্গেও জড়িত ছিলেন হারুন ইজহার।
সূত্রটি বলছে, হেফাজতের এই নেতার বিরুদ্ধে বিভিন্ন থানায় অন্তত ১৮টি মামলা রয়েছে।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ আগমনকে কেন্দ্র করে ২৫, ২৬ ও ২৭ মার্চ ব্রাহ্মণবাড়িয়া-হাটহাজারীসহ দেশজুড়ে যে সহিংস ঘটনা ঘটেছে, এসব নাশকতার পেছনে জড়িত থাকার অভিযোগে অন্তত ৩৫ জন হেফাজত নেতা গ্রেফতার হয়েছেন। গ্রেফতারের তালিকায় আছেন সংগঠনটির আরও দুই শতাধিক নেতা।
২০১০ সালের ১৯ জানুয়ারি চট্টগ্রাম থেকে হেফাজতের যাত্রা শুরু। চট্টগ্রামের হাটহাজারী মাদ্রাসার তৎকালীন মহাপরিচালক প্রয়াত আল্লামা শাহ আহমদ শফী সংগঠনটির প্রতিষ্ঠা করেন।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সূত্রটি জানায়, চট্টগ্রামের লালখান বাজারে অবস্থিত (পাহাড়ের পাদদেশে) জামিয়াতুল উলুম আল-ইসলামিয়া মাদ্রাসা ঘিরে গড়ে উঠেছিল আন্তঃদেশীয় জঙ্গিদের ঘাঁটি। যেখান থেকে ২০০৯ সালের শেষ দিকে ঢাকাস্থ মার্কিন দূতাবাস ও ভারতীয় হাইকমিশনার হামলার ছক তৈরি হয়েছিল। এ হামলার পরিকল্পনা করেছিল ভারতে নিষিদ্ধ ঘোষিত ইসলামি জঙ্গি সংগঠন লস্কর ই-তৈয়্যবা। এই জঙ্গিগোষ্ঠীর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন হারুন ইজহার। ২০০৯ সালের শেষ দিকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী জানতে পারে, যেকোনো সময় ঢাকাস্থ দুটি দূতাবাসে জঙ্গি হামলা হতে পারে। একটি টেলিফোন কলের সূত্র ধরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী জানতে পারে, হামলার ছক মুফতি ইজহারের মাদ্রাসায় বসেই করা হয়েছিল।
পরে গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে পুলিশ মাদ্রাসাটিতে অভিযান চালিয়ে, ইজহারপুত্র হারুন ইজহার এবং দক্ষিণ ভারতীয় সংগঠন লস্কর-ই-তৈয়্যবার সদস্য ভারতীয় নাগরিক শহিদুল, সালাম, সুজন ও আল আমিন ওরফে মইফুলকে গ্রেফতার করা হয়।
মাদরাসায় ভয়াবহ গ্রেনেড হামলা
২০১৩ সালের ১০ জুলাই চট্টগ্রামের লালখান বাজার মাদ্রাসায় ভয়াবহ গ্রেনেড বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। এতে তিনজন নিহত হয়। আহত হয় বেশ কয়েকজন। এ ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে ২০১৩ সালের অক্টোবরে ইজহারপুত্র মুফতি হারুনকে তার দেহরক্ষী জুনায়েদসহ গ্রেফতার করা হয়। মাদ্রাসার যে কক্ষে বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে, তার পাশের কক্ষেই ছিল মুফতি হারুন ইজহারের কার্যালয়। বিস্ফোরণের পরপর তিনি পালিয়ে যান। পরবর্তী সময়ে পুলিশ কক্ষটি তল্লাশি করে চারটি তাজা গ্রেনেড এবং বিপুল পরিমাণ গ্রেনেড তৈরির সরঞ্জাম উদ্ধার করে।
এছাড়া রুমটি তল্লাশি করে বিস্ফোরক তৈরিতে ব্যবহৃত ১৮ বোতল এসিড পাওয়া যায়। এ ঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে নগরীর খুলশী থানায় বিস্ফোরক ও এসিড আইনে পৃথক দুটি মামলা হয়। সেই দুটি মামলাই মুফতি ইজহার ও ছেলে হারুনকে আসামি করা হয়।
হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের নেতা হারুন ইজহারের বিরুদ্ধে নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন জেএমবির সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ রয়েছে। তিনি দীর্ঘদিন কারাগারেও ছিলেন।
জিহাদ ফরজ হয়েছে বলে ঘোষণা
সম্প্রতি মুফতি হারুন ইজহার জিহাদ ফরজ হয়েছে বলে ঘোষণা দেন। এ নিয়ে তিনি বেশ কিছু ভিডিও ইউটিউবে আপলোড করেন। এছাড়া ‘গাজওয়াতুল হিন্দ’- এর সূচনা হয়েছে বলে তিনি বিভিন্ন বক্তব্যে দাবি করেন।
সারাদেশে তার মতাদর্শের বেশ কিছু অনুসারী রয়েছে। কয়েক মাস আগে চট্টগ্রামের ফটিকছড়ির নাজিরহাট বড় মাদ্রাসা নিয়ে গণ্ডগোলের সময় হারুন ইজহারকে আটক করেছিল পুলিশ। এ সময় হাটহাজারী মাদ্রাসা থেকে ছাত্ররা বেরিয়ে সড়কে আন্দোলন গড়ে তুললে পুলিশ তাকে ছেড়ে দেয়।