হেফাজতে ইসলামের ২৩ শীর্ষ নেতা ও ৩০টি প্রতিষ্ঠানের তালিকা ধরে অনিয়ম ও দুর্নীতির তদন্ত শুরু করেছেন গোয়েন্দারা। তদন্তে নেমে পুলিশ ৩শ ডোনারের আয়ের উৎস খুঁজে দেখার পাশাপাশি মাদ্রাসাগুলো পরিচালনায় বিশৃঙ্খল অবস্থার চিত্র ফুটে উঠেছে।
হেফাজত নিয়ন্ত্রিত মাদ্রাসাগুলো পরিচালনায় দেশের বাইরে ও ভেতর থেকে যেসব অনুদান এসেছে তার পরিমাণ এবং কোথায় কীভাবে এসব অর্থ ব্যয় হয়েছে তার হিসাব নেই। অনুদানের অর্থ মাদ্রাসার ব্যাংক হিসাবে জমা হওয়ার কথা থাকলেও বহু মাদ্রাসার ব্যাংক হিসাবই খোলা হয়নি। ফলে অনুদানের অর্থ জমা হয় হেফাজত নেতাদের ব্যক্তিগত ব্যাংক হিসাবে। পুলিশ ইতোমধ্যেই ২৩ জন শীর্ষ হেফাজত নেতা এবং ৩০টি প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসাবের তথ্য চেয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকের ফিন্যান্সিয়াল ইউনিটের কাছে।
৩০টি প্রতিষ্ঠানের প্রায় সবই নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জ এবং চট্টগ্রাম এলাকার। হেফাজত নিয়ন্ত্রিত সব মাদ্রাসায়ই পর্যায়ক্রমে তদন্ত চালানো হবে।
শীর্ষ পর্যায়ের এক গোয়েন্দা কর্মকর্তা গণমাধ্যমকে বলেন, হেফাজত নিয়ন্ত্রিত মাদ্রাসাগুলোতে দেশের বাইরে থেকে অনেক অনুদান আসে। দেশের ভেতরের নির্দিষ্ট-অনির্দিষ্ট ব্যক্তিরা প্রকাশ্য-গোপনে অনেক টাকা-পয়সা দান করে। এসব টাকা-পয়সার কোনো হিসাব নেই মাদ্রাসাগুলোতে। প্রতিষ্ঠানের অর্থিক ব্যবস্থাপনা খুবই বিশৃঙ্খল। বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানেরই ব্যাংক হিসাব নেই। যেসব জায়গা থেকে টাকা-পয়সা এসেছে সেসব বিষয়ে অনুসন্ধানে অনেক তথ্য জানা যাচ্ছে। কিন্তু কোন কোন খাতে এসব অর্থ ব্যয় করা হয়েছে সেসব বিষয়ে সুনির্দিষ্ট তথ্য পাওয়া যাচ্ছে না।
ডিবির উপকমিশনার আসাদুজ্জামান বলেন, মাদ্রাসাভিত্তিক যেসব অনুদান আসে তার একটি বড় অংশ যায় হেফাজত নেতাদের পকেটে। আর হেফাজতকেন্দ্রিক আন্দোলন-নাশকতায় যে অর্থ ব্যয় হয় তা আসে মাদ্রাসা এবং হেফাজত নেতাদের কাছ থেকে। যারা মাদ্রাসায় ডোনেট করেন তাদের বিষয়ে আমরা খোঁজখবর রাখছি। আমরা বেশ কয়েকজনের নাম পেয়েছি। মামুনুলের ব্যাংক হিসাবেও মোটা অঙ্কের লেনদেনের তথ্য পাওয়া গেছে। অনুদানের অর্থ অরাজকতামূলক কাজেও ব্যয় হয়েছে।
তিনি বলেন, তালিকা ধরে আমাদের অনুসন্ধান চলছে।
যেসব হেফাজত নেতার বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু হয়েছে তারা হলেন- হেফাজতে ইসলামের সদ্য বিলুপ্ত কমিটির আমির (বর্তমানে আহ্বায়ক) আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরী, খেলাফত মজলিসের আমির মাওলানা ইসমাইল নুরপূরী, সাবেক যুগ্ম মহাসচিব ও খেলাফত মজলিসের মহাসচিব মাওলানা মামুনুল হক, পীর চরমোনাই ও ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের আমির এবং বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশের সহ-সভাপতি সৈয়দ মুহাম্মদ রেজাউল করিম, ইসলামী অন্দোলন বাংলাদেশের নায়েবে আমির মুফতি সৈয়দ ফয়জুল করিম, ইসলামী অন্দোলন বাংলাদেশের মহাসচিব অধ্যক্ষ মাওলানা ইউনুছ আহমাদ, কওমি মাদ্রাসার সর্বোচ্চ শিক্ষা বোর্ড আল হাইআতুল উলিয়ার চেয়ারম্যান ও বেফাকুল মাদরিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশের সভাপতি মাওলানা মাহমুদুল হাসান, হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের বিলুপ্ত কমিটির সহ-সভাপতি এবং বেফাকুল মাদরিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশের মহাপরিচালক মুহাম্মদ মাহফুজুল হক, বাংলাদেশ ইমাম ও মুসল্লি ঐক্য পরিষদ ডেমরার সদস্য সচিব মাওলানা মাহমুদুল হাসান সিরাজী, বাংলাদেশ ইমাম ও মুসল্লি ঐক্য পরিষদ (কদমতলী) নেতা মাওলানা আব্দুল আলিম সাইফি, বাংলাদেশ ইমাম ও মুসল্লি ঐক্য পরিষদ শ্যামপুরের মাওলানা আব্দুল হক, হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের অর্থ সম্পাদক (বিলুপ্ত কমিটির) মুনির হোসাইন কাসেমী।
হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের নায়েবে আমীর (বিলুপ্ত কমিটির) ব্রাহ্মণবাড়িয়া দারুল আকরাম মাদ্রাসার পরিচালক মাওলানা সাজিদুর রহমান, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জ বেড়াতলা মাদ্রাসার পরিচালক হাফেজ জোবায়ের আহাম্মদ আনসারী, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইল উচালিয়া মাদ্রাসার পরিচালক মাওলানা জহিরুল ইসলাম, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সুহিলপুর দারমা মাদ্রাসার পরিচালক মাওলানা মেরাজুল ইক কাশেমী, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাটাই দক্ষিণ বিরাসা মাদ্রাসার পরিচালক আবু তাহের, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার জামিয়া ইউনুসিয়া মাদ্রাসার ছাত্র/সভাপতি জিয়া উদ্দিন জিয়া, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার জামিয়া ইউনুসিয়া মাদ্রাসার পরিচালক ও হেফাজতের জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক মুফতি মোবারক উল্লাহ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ইসলামপুর মাদ্রাসার পরিচালক বোরহান উদ্দিন কাশেমী, ব্রাহ্মণবাড়িয়া জামিয়া ইউনুসিয়া মাদ্রাসার শিক্ষা সচিব আল্লামা আশেক এলাহী, ব্রাহ্মণবাড়িয়া কাজীপাড়া সৈয়দুন্নেছা মাদ্রাসার পরিচালক মাওলানা হাফেজ ইদ্রিস এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়া অষ্টগ্রাম বাজার মাদ্রাসার পরিচালক মাওলানা বোরহান উদ্দিন।
প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সিদ্ধিরগঞ্জ থানাধীনই ১১টি। এগুলো হচ্ছে- সানারপাড় নিমাই কাশারীর জামিয়াতুল আবরার হাফিজিয়া মাদ্রাসা, সিদ্ধিরগঞ্জের সানারপাড় নয়া আটি কিসমত মার্কেটে অবস্থিত আশরাফিয়া মহিলা মাদ্রাসা, সানারপাড় আব্দুল আলী দারুস সালাম হিফজুল কোরআন মাদ্রাসা, মাদানীনগরের মাওলানা শাইখ ইদরীম আল ইসলামী, মাদানীনগরের আল-জামিয়াতুল ইসলামিয়া দারুল উলুম মাদ্রাসা, নিমাই কাশারীর আল জামিয়াতুল ইসলামিয়া নুরুল কোরআন মাদ্রাসা, মুত্তিনগর নয়াআটি ইফয়জুল উলুম মুহিউছঊন্নাহ আরাবিয়্যাহ মাদ্রাসা, ভূইয়াপাড়া জামিয়া মোহাম্মদীয়া মাদ্রাসা, সাইনবোর্ড জামিয়াতুল ইব্রাহিম মাদ্রাসা, মারকুজুল তাহরিকে খাতমি নবুওয়াত কারামাতিয়া উলুম মাদ্রাসা এবং সিদ্ধিরগঞ্জ সুমিলপাড়া নুরে মদিনা দাখিল মাদ্রসা।
এছাড়া হেফাজত নিয়ন্ত্রিত চট্টগ্রাম এলাকার মাদ্রাসাগুলো হচ্ছে-দাঁতমারা তালিমুল কোরআন ইসলামিয়া মাদ্রাসা, দাঁতমারা ছোট বেতুয়ার সিরাজুল উলুম মাদ্রাসা, ভুজপুর কাজিরহাট আল জামিয়া ইসলামিয়া এমদাদুল ইসলাম মাদ্রাসা, পশ্চিম ভুজপুর আল মাহমুদ ইসলামিয়া বালক/বালিকা মাদ্রাসা, ভুজপুর পশ্চিম আধারমানিক বড়বিল আল মাদ্রসাতুল ইসলামিয়া আ-রাবিয়া হেফজখানা ও এতিমখানা বালক/বালিকা মাদ্রাসা, উত্তর নিশ্চিন্তপুর তালীমুল কুরআন বালক-বালিকা মাদ্রাসা ও এতিমখানা, পটিয়া আল-জামিয়া আল ইসলামিয়া মাদ্রাসা, পটিয়া হাফিজিয়া তালীমুল কুরআন মাদ্রাসা ও এতিমখানা, পটিয়া আশিয়া এমদাদুল উলুম মাদ্রাসা হেফজখানা ও এতিমখানা, ভুজপুর উত্তর বারমাসিয়া হাফেজুল উলুম ইসলামিয়া মাদ্রাসা, হাটহাজারী ফতেপুরের একটি মাদ্রাসা, হাটহাজারীর জামিয়া আহদিয়া দারুল উলুম মুঈনুল ইসলাম (হাটহাজারী বড় মাদ্রাসা), হাটহাজারী মেখল জামিয়া ইসলামিয়া হামিউস সুন্নাহ, হাটহাজারী জামিয়া ইসলামিয়া ক্বাসেমুল উলুম, হাটহাজারীর ফতেপুর জামিয়া হামিদিয়া নাছেরুল ইসলাম মাদ্রাসা, ফটিকছড়ির বাবুনগর আজিজুল উলুম মাদ্রাসা, ফটিকছড়ির আল জামিয়াতুল কোন আনিয়া তালিমুদ্দিন হেফজখানা ও এতিমখানা, ফটিকছড়ির নাজিরহাট আল জামেয়াতুল আরবিয়া নাসিরুল ইসলাম মাদ্রাসা এবং ফটিকছড়ির জাফতনগর হাফেকজুল উলুম মাদ্রাসা ও এতিমখানা।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) প্রধান ও ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) অতিরিক্ত কমিশনার একেএম হাফিজ আক্তার বলেন, হেফাজতের একাধিক নেতা এবং বেশকিছু মাদ্রাসার বিষয়ে জোরালো অনুসন্ধান চলছে। তিন শতাধিক ডোনারের (অর্থদাতা) নাম পাওয়া গেছে। বিদেশ থেকে অনেক অর্থ এসেছে। এসব অর্থ মাদ্রাসার ব্যাংক হিসাবে জমা হওয়ার কথা থাকলেও তা জমা হয়েছে নেতাদের ব্যক্তিগত ব্যাংক হিসাবে। এসব টাকা হেফাজতকেন্দ্রিক আন্দোলনে ব্যয় করা হয়েছে বলেও রিমান্ডে থাকা হেফাজত নেতারা জানিয়েছেন। এক প্রশ্নের উত্তরে এ গোয়েন্দা কর্মকর্তা বলেন, এখনই এ বিষয়ে বিস্তারিত বলা সম্ভব নয়। অনুসন্ধান শেষে বিস্তারিত জানানো হবে। তিনি বলেন, ডিবির অনুসন্ধানে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে পরে সিআইডি তদন্ত করবে।