বিশাল এক ‘থ্যাংকলেস মিশন’ নিয়ে সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রে গেছেন ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর। জো বাইডেন হোয়াইট হাউসের দায়িত্ব নেয়ার পর সেখানে কোনো ভারতীয় মন্ত্রীর এটাই প্রথম সফর। ভারতের জন্য যথাসম্ভব করোনা টিকা জোগাড়ের চ্যালেঞ্জ নিয়ে এই সফরে গেছেন জয়শঙ্কর।
করোনা মহামারির দ্বিতীয় ঢেউয়ের ভয়াবহ তাণ্ডব মাত্র সামলে ওঠার চেষ্টা করছে ভারত। সেখানে দৈনিক দুই লক্ষাধিক আক্রান্ত আর চার হাজারের বেশি মৃত্যুর ট্র্যাজেডি আরও ভয়ঙ্কর করে তুলেছে টিকার প্রচণ্ড সঙ্কট। সফরকালে যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ কর্মকর্তা ও টিকা উৎপাদকদের সঙ্গে দেখা করার কথা ভারতীয় মন্ত্রীর। জো বাইডেন চাহিদাসম্পন্ন দেশগুলোকে যে আট কোটি টিকা দিতে চেয়েছেন, জয়শঙ্কর সেখান থেকে যত বেশি সম্ভব বাগিয়ে নেয়ার চেষ্টা করবেন, তা নিশ্চিত।
ভারতীয়রা নিজেরা প্রচুর টিকা উৎপাদন করলেও আজ তাদের মধ্যেই এর সঙ্কট ভয়াবহ। সেখানে গত এপ্রিলের তুলনায় মে মাসে টিকাদানের হার অর্ধেকে নেমে গেছে। ইতোমধ্যে দেশটিতে ১০ লাখের বেশি মানুষ করোনায় মারা গেছে বলে ধারণা করা হয়। যদিও সরকারি হিসাব বলছে, ভারতে এ পর্যন্ত করোনায় মৃতের সংখ্যা ৩ লাখ ১৫ হাজার, তবে সেটি প্রকৃত সংখ্যার তুলনায় একেবারেই নগণ্য বলে বিশ্বাস বিশেষজ্ঞদের।
করোনা টিকার পথ ধরে ভারত বহুদূর গেছে- ব্যাপক হম্বিতম্বি করা বিশ্বের রক্ষাকর্তা ‘ভ্যাকসিন গুরু’ থেকে আজ অন্যের দুয়ারে টিকার জন্য হাত পাতছে। বিশ্বের বৃহত্তম টিকা উৎপাদক হয়ে অন্যের কাছে টিকা চাওয়া ভারতের জন্য মোটেও সহজ নয়। এক্ষেত্রে শান্তশিষ্ট জয়শঙ্কর বিষয়টিতে যথেষ্ট আভিজাত্য ধরে রাখার চেষ্টা করবেন অবশ্যই।
সম্প্রতি বেশ দয়ালু সুরে কথা বলতে শুরু করেন ভারতের এ মন্ত্রী। হুভার ইনস্টিটিউটের এক সভায় তিনি সব দেশকে ‘বৈশ্বিক মঙ্গল’র জন্য ‘জাতীয় স্বার্থ’র বাইরে চিন্তা করার কথা বলেছেন। ভারতীয় মন্ত্রীর মুখে এ ধরনের শব্দ হাস্যকরই বটে! কারণ ভারতীয়দেরই টিকা জাতীয়তাবাদ এবং নরেন্দ্র মোদির ফাঁকা আওয়াজের কারণে শুধু ভারতেই তীব্র টিকা সঙ্কট তৈরি হয়নি, এতে টিকার জন্য ভারতের ওপর নির্ভরশীল দেশগুলোকেও মারাত্মক হুমকিতে ফেলেছে।
ভারত এখন নিজেদের লোকদের অগ্রাধিকার দেয়ার জন্য অন্য দেশে টিকা রফতানি বন্ধ করে রেখেছে, যার অর্থ অন্যদের প্রাপ্য টিকা হাতিয়ে নিচ্ছে তারা। এতে দরিদ্র দেশগুলোর টিকাপ্রাপ্তি নিশ্চিতে শুরু করা কোভ্যাক্স কর্মসূচি বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। ফলে প্রাণঘাতী এ মহামারি আরও দীর্ঘায়িত হওয়ার ঝুঁকি তৈরি হয়েছে।
আজকের যে টিকা সঙ্কট বিশ্বের সবচেয়ে অরক্ষিত দেশগুলোকে চোখ রাঙাচ্ছে, তার শেকড় পাওয়া যায় ভারতের জন্য সময়মতো পর্যাপ্ত টিকা কেনায় নরেন্দ্র মোদির উদাসীনতার মধ্যে। ভারতে মহামারি শুরুর কয়েক মাস পরেই ২০২০ সালের আগস্টে মোদি ঘোষণা দেন, তারা ইতোমধ্যে টিকা বিতরণের পরিকল্পনা নিয়ে ফেলেছেন। কিন্তু টিকা কেনার প্রথম অর্ডার দিতে তার সময় লেগে যায় ২০২১ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত। ফলাফল এপ্রিলে যখন পূর্ণশক্তিতে মহামারির দ্বিতীয় ঢেউ ভারতে আছড়ে পড়ে, তখন দেশটির মাত্র ০.৫ শতাংশ মানুষ দুই ডোজ করে টিকা নিয়েছেন। এর হার বর্তমানে ৩ দশমিক ১ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। বিশ্বের আর কোনো নেতা টিকার ব্যাপারে এত বেশি কথা বলে এত কম কাজ করেননি। তার জন্য আজ ভুক্তভোগী শুধু ভারতীয়রাই নন, বিশ্বের অন্য প্রান্তের লোকেরাও।
অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা উৎপাদন করছে ভারতের সিরাম ইনস্টিটিউট। চলতি বছর কোভ্যাক্সের জন্য ২০০ কোটি ডোজ সরবরাহের কথা ছিল তাদের। কিন্তু গত মার্চ থেকে টিকা পাঠানো বন্ধ রেখেছে সিরাম। চলতি বছরের শেষ ছাড়া তা আবার শুরু করা সম্ভব হবে না বলে জানিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। টিকার জন্য দেশে এবং দেশের বাইরে থেকে ক্রমাগত চাপের মুখে লন্ডন পাড়ি জমিয়েছেন সিরামের সিইও আদর পুনেওয়ালা।
বিশ্বের জন্য সিরামের টিকা সরবরাহ বন্ধ থাকায় অনিশ্চয়তায় পড়েছে স্বল্প ও নিম্ন-মধ্যম আয়ের অন্তত ৯২টি দেশ। এসব দেশ টিকার জন্য কোভ্যাক্সের ওপর ভরসা করছিল। এ অবস্থায় তারা টিকার নতুন সরবরাহকারী খুঁজে পেলেও তা হাতে পৌঁছাতে আরো কয়েক মাস লেগে যাবে। সিরামের এই পিছুটানের মানে জুন মাস শেষে কোভ্যাক্স অন্তত ১৯ কোটি ডোজের ঘাটতিতে থাকবে।
ভারতের সবচেয়ে কাছের প্রতিবেশী বাংলাদেশ, নেপাল এবং শ্রীলঙ্কাও এই টিকা সঙ্কটে ভুক্তভোগী হচ্ছে। নেপালে সংক্রমণের উচ্চহার আর টিকার সামান্য মজুতের কারণে পরিস্থিতি ক্রমেই ভয়াবহ হয়ে উঠছে। দেশটি সিরামের কাছ থেকে ২০ লাখ ডোজ কিনেছিল। কিন্তু মাত্র ১০ লাখ ডোজ দিয়েই পাঠানো বন্ধ করে দিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। বাকি দেশগুলোর ঘটনাও প্রায় একই রকম।
টিকাপ্রাপ্তি নিয়ে অসম লড়াই বন্ধের লক্ষ্যে কোভ্যাক্স চালু করা হয়েছিল। এ কার্যক্রমের কেন্দ্রে ছিল বিশ্বের বৃহত্তম টিকা উৎপাদক সিরাম ইনস্টিটিউট। তাদের অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা উৎপানের অনুমতি দেয়া হয়েছিল দরিদ্র দেশগুলোকে সরবরাহ করার শর্তে। কিন্তু ভারত সরকারের নিষেধাজ্ঞার কারণে আজ অন্য দেশগুলোর টিকাপ্রাপ্তিতে সুবিচারের আশা হাওয়ায় মিলিয়ে যেতে বসেছে।
সূত্র: টাইম