‘চায়ের কাপে তুফান’ বলে একটি কথা প্রচলিত আছে। সম্প্রতি বাংলাদেশে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ দলের সাধারণ সম্পাদক এবং সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের ও বিরোধী দল বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের পাল্টাপাল্টি বক্তব্য মিডিয়া থেকে জেনে এই কথাটি মনে পড়ল। দুই নেতাকেই সবিনয়ে জিজ্ঞেস করি, বাংলাদেশে সুস্থ রাজনীতির কি কোনো অস্তিত্ব আছে যে তাঁরা রাজনৈতিক বিতণ্ডায় নেমেছেন? মির্জা ফখরুল তরুণদের আন্দোলনে জেগে উঠতে বলেছেন। তিনি কি একবারও পেছনে ফিরে দেখেছেন তাঁদের সঙ্গে একজনও সজাগ কিংবা সচেতন তরুণ আছে কি না? তরুণদের দলে রাখার জন্য তাঁরা যে ছাত্রদল ও যুবদল গঠন করেছিলেন, এই দুটি দলের নেতারা দেশে ক্ষমতার হাতবদল হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দল বদল করেছেন।
কথাটা স্বীকার করে গেছেন আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক প্রয়াত সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম তাঁর মৃত্যুর কিছু আগে। তিনি বলেছিলেন, ‘বিএনপির ছাত্রদলের নেতাকর্মীরা দলে দলে ছাত্রলীগে ঢুকেছেন। ছাত্রলীগের পরিচয়ে তাঁরা অবাধে দৌরাত্ম্য চালিয়ে যাচ্ছেন। বদনাম হচ্ছে ছাত্রলীগের। ছাত্রলীগের আগে কোনো দুর্নাম ছিল না।’ সৈয়দ আশরাফের এই বক্তব্য যে কত সত্য আজ তা পদে পদে বোঝা যাচ্ছে। তাই মির্জা ফখরুলের কাছে সবিনয়ে অনুরোধ জানাই, তিনি এই তরুণদের তাঁর দলে ফিরিয়ে নিন। দেখুন, এই তরুণদের ঘুম থেকে জাগিয়ে কোনো আন্দোলনে নামাতে পারেন কি না!
এই তরুণরা ক্ষমতার মৌচাক ছাড়বে না। যদি মির্জা ফখরুলের ডাকে ছাড়ে এবং আন্দোলনে নামে, তাহলে সে আন্দোলন হবে রাজপথে সন্ত্রাস, লুটপাট ও বাস-ট্রাকে আগুন লাগানো এবং নিরীহ মানুষের গায়ে আগুন লাগিয়ে হত্যা করা। দেশের মানুষ বিএনপির এই আন্দোলন প্রতিরোধ করেছে এবং পুলিশ ও র্যাব তা সাফল্যের সঙ্গে দমন করেছে। মির্জা ফখরুলরা চাইলেও এই ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটাতে পারবেন না। বরং নিজেরাই তাঁরা দীর্ঘকালের রাজনৈতিক নিদ্রা (Political slum) বা নিষ্ক্রিয়তা, যাকে বলা যেতে পারে ‘আসহাবে কাহাফের ঘুম’ তা থেকে জেগে উঠুন। সহিংসতা নয়, ষড়যন্ত্র নয়, দলের একটা আদর্শ ও নির্দিষ্ট লক্ষ্য স্থির করুন। সেই লক্ষ্যের ভিত্তিতে দেশের সাধারণ মানুষের কাছে বিকল্প রাজনৈতিক কর্মসূচি তুলে ধরুন। বিলাতে পলাতক ‘সিন্দবাদের দৈত্যের’ কবল থেকে দলকে মুক্ত করুন। খালেদা জিয়ার রুগণ স্বাস্থ্যকে রাজনীতির মূলধন করে তাঁর সুচিকিৎসার ব্যবস্থা করুন।
বিএনপির সামনে এখনো অনেক সম্ভাবনা। দেশে একটি গণতান্ত্রিক বিরোধী দল নেই; না ডান, না বাম। বিএনপির জন্ম থেকেই স্বাধীনতার শত্রু, বিশেষ করে জামায়াতের সঙ্গে হাত মিলিয়ে দেশ থেকে স্বাধীনতার ভিত্তিগুলোই ধ্বংস করার চেষ্টা করেছে। স্বাধীনতার আদর্শ রক্ষা পায়, দেশে গণতন্ত্রের ভিত্তি শক্ত হয় এমন কোনো কর্মসূচি দেশের মানুষের সামনে তুলে ধরেনি। ফলে দলটি প্রকৃত রাজনৈতিক দল হিসেবে গড়ে ওঠেনি। জামায়াতের সঙ্গে জোট পাকিয়ে হয়েছে ষড়যন্ত্র ও সন্ত্রাসের একটি দল। আদর্শবাদী তরুণরা এই দলের দিকে এগিয়ে আসেনি।
তবু বিএনপি এখনো দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম রাজনৈতিক দল। নির্বাচন করে এই দলটি ক্ষমতায়ও গেছে। এখন তারা দীর্ঘকাল ক্ষমতায় নেই। তাতে ক্ষতি নেই। শক্তিশালী বিরোধী দল গঠন করে তারা দেশকে সেবা করতে পারে। জনগণের পাশে থেকে তাদের দাবিদাওয়ার ভিত্তিতে আন্দোলন গড়ে তুলতে পারে। সরকারের ভুলত্রুটিগুলো গঠনতান্ত্রিকভাবে তুলে ধরতে পারে। তারপর সময় হলে জনগণই তাদের ক্ষমতায় বসাবে।
শেখ হাসিনা টানা তিন দফা ক্ষমতায় আছেন। তাতে তাদের এত গাত্রজ্বালা কেন? তারাও তো আওয়ামী লীগকে ২১ বছর জোর খাটিয়ে ক্ষমতার বাইরে রেখেছিল। বারবার শেখ হাসিনার প্রাণনাশের চেষ্টা করেছে। জাতির পিতাকে অস্বীকার করেছে। তা না করে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ সামনে রেখে তারা গণতান্ত্রিক পথে থাকলে এত দিনে জনগণই তাদের ক্ষমতায় বসাত। দেশে সুস্থ দ্বিদলীয় গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা গড়ে উঠত। আমেরিকায় প্রেসিডেন্ট পদে এফ ডি রুজভেল্ট তিন দফা নির্বাচিত হয়েছেন। তারপর জনগণের ইচ্ছায় সংবিধান সংশোধন করে চতুর্থ দফা প্রেসিডেন্ট পদে তাঁকে বসাতে হয়েছে। তাঁর মৃত্যুর পরও তাঁর ভাইস প্রেসিডেন্ট ট্রুম্যান দুই দফা প্রেসিডেন্ট পদে ছিলেন। তাতে কী হয়েছে? আমেরিকায় গণতন্ত্র কী ভেঙে পড়েছে, না বিরোধী রিপাবলিকান দল ক্ষমতার জন্য অস্থির হয়ে আন্দোলনের নামে সহিংস নীতি গ্রহণ করেছিল, না দেশের শত্রুদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে একটার পর একটা ষড়যন্ত্রের পথ ধরেছিল? প্রায় ৩০ বছর ক্ষমতার বাইরে থেকে আমেরিকার রিপাবলিকান পার্টি ভেঙে পড়েনি। আবার ক্ষমতায় এসেছে।
মির্জা ফখরুলরা বলতে পারেন, আওয়ামী লীগ সরকারের কঠোর দমননীতির জন্য বিএনপি গণতান্ত্রিক পথে আন্দোলনে নামতে পারছে না। এ ব্যাপারে সুধীজনের জবাব হলো বিএনপির অভিযোগ যদি সত্য হয়, তাহলে তাদের কাছেই জিজ্ঞাসা হলো, পাকিস্তান আমলে দেশে ফুলের মালা গলায় নিয়ে বঙ্গবন্ধু ও অন্য নেতারা কি গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার আন্দোলন করেছিলেন, না জেল-জুলুম-মৃত্যুদণ্ড উপেক্ষা করে আন্দোলন করেছিলেন? ঘরে বসে মুঠোফোনে কর্মীদের নির্দেশ দিয়ে আন্দোলন হয় না।
খালেদা জিয়া ও তাঁর পুত্র ক্ষমতার অপব্যবহার, দুর্নীতি, সন্ত্রাস দ্বারা দেশে এমন ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি করেছিলেন, সে জন্য শুধু দুর্নীতির কারণে কয়েক বছর কারাদণ্ড নয়, সারা জীবনের জন্য তাঁদের সম্ভবত কারাদণ্ড হওয়া উচিত ছিল। জাতির পিতার স্মৃতির প্রতি অসম্মান প্রদর্শন এবং তাঁর মৃত্যু দিবসকে অবমাননা করার জন্য নিজের ভুয়া জন্মদিন উদ্ভাবনের কারণে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে তাঁকে আরো কঠোর দণ্ড দেওয়া উচিত ছিল। আর্জেন্টিনায় ইসাবেলা পেরন তাঁর স্বামীর নাম ভাঙিয়ে ক্ষমতায় বসে জনগণের ওপর যে ভয়াবহ অত্যাচার চালিয়েছিলেন, তার ফলে তাঁর বিরুদ্ধে গণ-অভ্যুত্থান ঘটেছিল। ইসাবেলা দেশ ছেড়ে পালিয়েছিলেন। কিন্তু তাঁকে বিদেশ থেকে ধরে এনে আর্জেন্টিনার আদালত সারা জীবনের কারাদণ্ড দিয়েছিলেন। তাঁর তুলনায় অনেক বেশি অত্যাচার চালিয়েও খালেদা জিয়া আওয়ামী সরকারের কাছে অনেক ভালো ট্রিটমেন্ট পাচ্ছেন। কারাগারে কাজের লোক নিয়ে থাকার সুবিধা পেয়েছেন। এখন দণ্ডিত আসামি হয়েও ঘরে বসে নিজের রুগণ স্বাস্থ্যের সেবা নিচ্ছেন। পুত্র তারেক পীড়িত মাতা এবং দলের ভাঙা অবস্থাকে উপেক্ষা করে বিদেশে বসে শাহি জীবন যাপন করছেন। বাহ, তারেক বাহ! তাঁর দল ঘরে বসে মুঠোফোন হাতে অথবা ভার্চুয়ালি তরুণদের আন্দোলনে নামার ডাক দিচ্ছে। বাহ, বিএনপি বাহ!
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের আমার ছোট ভাইয়ের মতো। ছাত্রজীবনে তাঁর নেতৃত্বশক্তি এবং বঙ্গবন্ধুর আদর্শের প্রতি নিষ্ঠার প্রমাণ আমি পেয়েছি। তাই সৈয়দ আশরাফের পর শেখ হাসিনা যখন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে তাঁকে বেছে নেন তাতে খুশি হয়েছিলাম। অতীতে দলে যে ‘বেনোজল’ ঢুকেছিল ওবায়দুল কাদের তা দূর করতে পারবেন ভেবেছিলাম। তিনি দলকে সুসংগঠিত করার উদ্যোগও নিয়েছিলেন। কিন্তু সহসা ভয়াবহ রোগ এসে তাঁকে আক্রমণ করে। তিনি অবশ্য মৃত্যুর মুখ থেকে উঠে এসেছেন এবং দলের হাল আবার ধরেছেন। তবে এই দল পুনর্গঠনে তাঁর সময় লাগবে।
তিনি তাঁর দল সম্পর্কে সম্প্রতি যে কথা বলেছেন তা কোনো নতুন কথা নয়। তিনি বলেছেন, ‘রাজনীতিতে বিএনপির ভ্রান্তি এবং পথভ্রষ্টতা নিয়ে এরই মধ্যে বিএনপির কর্মী-সমর্থকরা এবং সমর্থক বুদ্ধিজীবীরাও (সম্ভবত ডা. জাফরুল্লাহর হেনস্তা হওয়ার দিকে ইঙ্গিত করেছেন) এ নিয়ে মুখ খুলতে শুরু করেছেন। বিএনপির সর্বস্তরের কিছু নেতাকর্মী আওয়ামী লীগে যোগদানের জন্য তলে তলে যোগাযোগ করছেন।’
আওয়ামী লীগ নেতা এখানে একটু ভুল বলেছেন। বিএনপির মধ্যম ও তৃণমূল পর্যায়ের বহু নেতাকর্মী এরই মধ্যে আওয়ামী লীগে ঢুকে বসে আছেন। বড় বড় পদও বাগিয়ে নিয়েছেন। সৈয়দ আশরাফ যখন ছাত্রলীগে ছাত্রদলের নেতাকর্মীদের অনুপ্রবেশের কথা বলেছিলেন, ঠিক সেই সময় বিএনপির মধ্যম ও তৃণমূল স্তরের অনেক নেতাকর্মীর আওয়ামী লীগে অনুপ্রবেশ শুরু হয়। ‘চিলড্রেন অব জিয়াউর রহমান’ নামে পরিচিত দুর্নীতিবাজ নব্য ধনী ও ব্যবসায়ীদের প্রতিপত্তি দেখা দেয় আওয়ামী লীগে। এ ব্যাপারে আওয়ামী লীগকে বহু সতর্কবাণী শোনানো হয়েছে। আওয়ামী লীগ কান দেয়নি। আওয়ামী লীগের দুর্নামের পালা তখন থেকে শুরু।
ওবায়দুল কাদেরকে সবিনয়ে জানাই, আওয়ামী লীগে বিএনপির নেতাকর্মীরা ঢুকেছেন অথবা ঢুকছেন তাতে আমি ভীত নই। অন্তত তাঁরা স্বাধীনতার শত্রু নন এবং তাঁদের প্রতিষ্ঠাতা মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। কিন্তু আওয়ামী লীগে এখন যারা এসে ভিড় জমাচ্ছে এবং দীর্ঘদিন ধরেই এই কাজটি করছে তারা হচ্ছে স্বাধীনতার শত্রু এবং দেশদ্রোহী ও সন্ত্রাসী জামায়াতের অসংখ্য নেতাকর্মী। তৃণমূল পর্যায়ের আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব বর্ণচোরা জামায়াতিদের কবলে চলে গেছে। দলের তৃণমূলেও তাঁদের ব্যাপক অনুপ্রবেশ ঘটেছে।
আওয়ামী লীগের দীর্ঘ সংগ্রামী জীবনের ইতিহাস ও ঐতিহ্য আজ ধ্বংসের মুখে। দলের মূলধন বলতে শেখ হাসিনার ব্যক্তিত্ব, নেতৃত্ব ও সাহসিকতা। আওয়ামী লীগ এখনই সতর্ক না হলে এই মূলধনও তারা ধরে রাখতে পারবে না। ওবায়দুল কাদেরকে তাই সবিনয়ে সকাতরে অনুরোধ জানাই, বিএনপির নেতাকর্মীদের আওয়ামী লীগে অনুপ্রবেশ সম্পর্কে আলোচনায় ‘চায়ের পেয়ালায় তুফান’ না তুলে স্বাধীনতার শত্রু, বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সবচেয়ে বড় শত্রু জামায়াতি ও হেফাজতিদের আওয়ামী লীগে অনুপ্রবেশ এবং দলের সর্বস্তরে প্রভাব বিস্তার সম্পর্কে সতর্ক হোন। দলকে বাঁচান, দেশকে বাঁচান।