বাংলাদেশে টাকার পাখা গজিয়েছে

আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরী

আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরী
আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরী। ফাইল ছবি

কথায় বলে ‘কারও পৌষ মাস এবং কারও সর্বনাশ।’ পৃথিবীর অধিকাংশ দুর্যোগেই দেখা যায়, লক্ষ-কোটি মানুষের সর্বনাশ হয়; কিন্তু কিছু মানুষ তা থেকে লাভবান হয়। ঢাকার কাগজের খবর, করোনার বছরে বাংলাদেশে কোটিপতি বেড়েছে ১১ হাজার ৬৪৭ জন। খবরটা পড়ে বিস্মিত হইনি। ব্রিটিশ আমলের অবিভক্ত বাংলাদেশে বাংলা পঞ্চাশের দুর্ভিক্ষে মানুষ মারা গিয়েছিল ৫০ লাখ। তখন কোটিপতি নয় লক্ষপতিই ছিল বড়লোক হওয়ার মাপকাঠি। পঞ্চাশের দুর্ভিক্ষে অনেক লক্ষপতি তৈরি হয়েছিল। তবে বর্তমানের মতো এত হাজারে হাজারে নয়। তখনও দুর্নীতি ছিল; কিন্তু তার জোয়ার এমন বাঁধভাঙা ছিল না।

তখন ব্রিটিশ ভাইসরয়ের খাদ্য উপদেষ্টা ছিলেন জওলাপ্রসাদ শ্রীবাস্তব। তিনি তার রিপোর্টে বলেন, পঞ্চাশের দুর্ভিক্ষে যে ৫০ লাখ লোক মারা গেছে, তাদের মাথাপিছু প্রতিটি মৃত্যুতে অসাধু খাদ্য ব্যবসায়ীরা লাভ করেছেন এক হাজার টাকা করে। এটা তো প্রায় একশ বছর আগের কথা। বর্তমানে দুর্ভিক্ষে অনুরূপ মৃত্যু ঘটলে অসাধু খাদ্য ব্যবসায়ীরা মাথাপিছু মৃত্যুতে হাজার টাকা নয়, লক্ষাধিক টাকা লাভ করতেন। তারা লক্ষপতি নয়, কোটিপতি হতেন। বাংলাদেশে এবার করোনার বছরে যা হয়েছে।

অর্থনীতিবিদরা এখন গবেষণায় মেতেছেন, এত দ্রুত এগারো হাজারের বেশি নতুন কোটিপতি সৃষ্টি হলো কীভাবে? এই গবেষণা নিয়ে আলোচনার আগে আফগানিস্তানের একটি ঘটনা বলি। আমেরিকান সেনারা সন্ত্রাস দমনের নামে গোটা কাবুল শহরকে ধ্বংস করার পর যখন হাজার হাজার আফগান নর-নারী দেশ ছেড়ে পালাচ্ছে, তখন একদল নতুন মানুষ ঢুকছিল কাবুলে। এদের মধ্যে ব্রিটিশ, মার্কিন, ভারতীয়, জাপানি- বহু জাতের মানুষ ছিল।

তাঁবেদার সরকারের প্রেসিডেন্ট ও এই নবাগতদের জন্য ব্লু-জোন নাম দিয়ে দ্রুত অভিজাত এলাকা গড়ে তোলা হয়। এই অভিজাত এলাকার নিরাপত্তার জন্য পাহারায় থাকে মার্কিন ও ব্রিটিশ সেনারা। কাবুলের এই ব্লু-জোনে ঢুকলে বোঝা যেত না এর বাইরে কী ধ্বংসস্তূপ বিরাজ করছে। গৃহহারা, নিকট স্বজন হারানো মানুষের আর্তনাদে যখন কাবুল শহর পূর্ণ, তখন শহরটির এই ব্লু-জোনে নাইট ক্লাবে মদের আসর বসতো। জুয়ার আসর বসতো। বিভিন্ন দেশের সুন্দরী তরুণীরা নাচের আসরে নাচতো। ক্লায়েন্টদের গ্লাসে মদ ঢেলে দিত।

আমি পাস্ট টেন্সে কথাগুলো লিখলাম। কারণ সম্প্রতি কাবুল থেকে মার্কিন ও ব্রিটিশ সৈন্য অপসারণের পর ব্লু-জোনের অবস্থা কী জানি না। তবে বিভিন্ন দেশের নবাগত ভদ্রলোকদের যে কথা বলেছি, তারা দেশটি ত্যাগ করেছেন কিনা তাও জানি না। কাবুল এবং বিভিন্ন শহরে আমেরিকান অস্ত্রের দাপটে যখন অসহায় মানুষ মরছে, তখন কাবুলের সেনা পাহারাবেষ্টিত অংশে নবাগত বিদেশিরা হোটেলে বসে মদপান ও সুন্দরী নর্তকীর নৃত্য উপভোগের সঙ্গে আর কী করতেন, তা নিয়ে একটি সচিত্র কার্টুন বেরিয়েছিল আমেরিকারই একটি বামপন্থি সাপ্তাহিকে। আমি সেই কার্টুনে বিদেশিদের কথোপকথনের কিছু অংশের বাংলা তরজমা এখানে তুলে ধরছি।

এক জাপানি ভদ্রলোক তার মার্কিন পার্টনারকে বলছেন, বন্ধু, একটা গুড নিউজ আছে। নর্থ কাবুলের বাবে আনজাম এলাকায় সন্ত্রাসীদের তল্লাশিতে গিয়ে আমাদের সৈন্যরা ধ্বংস করে দিয়েছে। মার্কিন ভদ্রলোক বললেন, তাহলে সিভিলিয়ান ক্যাজুয়ালটি নিশ্চয় অনেক? জাপানি ভদ্রলোক বললেন, আমরা কনস্ট্রাকশন কোম্পানির এজেন্ট। আমাদের ক্যাজুয়ালটি গুনতে নেই। যত ধ্বংস তত কনস্ট্রাকশন। আমাদের কাজের এরিয়া বেড়ে গেল। কনস্ট্রাকশন খরচও। নিট মুনাফা থ্রি টু ফোর মিলিয়ন ডলার হবে। মার্কিন ভদ্রলোক বিস্ময়ের সঙ্গে বললেন, জেসাস! জাপানি ভদ্রলোক বললেন, আরও একটি খুশির খবর আছে। মার্কিন ভদ্রলোক বললেন, সেটা আমি জানি। ইন্ডিয়ান কনস্ট্রাকশন কোম্পানি তালেবানদের হাতে মার খাওয়ার পর আফগান মুল্লুক থেকে উইদড্র করে চলে যাচ্ছে। তারা এখানে আর কাজ করবে না। জাপানি ভদ্রলোক বললেন, আমাদের এক পাওয়ারফুল কমপিটিটর বাজার থেকে চলে গেল। হুররে! আসুন সেলিব্রেট করি। দু’জনকে পরিচারিকা মদের গ্লাস এগিয়ে দিল, দুজনে গেলাসে গেলাসে ঠোকাঠুকি করে বললেন- চিয়ার্স। ব্লু-জোনের বাইরে থেকে তখনও মার্কিন বোমায় বিধ্বস্ত অঞ্চল থেকে আহত ও নিহতদের কান্নার শব্দ ভেসে আসছিল।

আমি জানি না এই খবরটা ‘ওয়ালস্ট্রিট জার্নালে’ বেরিয়েছিল কিনা। তবে একটি মার্কিন পত্রিকাতেই বেরিয়েছিল। তার বরাত দিয়ে বেরিয়েছে দিল্লির এক ভারতীয় পত্রিকায়। তাতে বলা হয়েছে, আফগান যুদ্ধে হাজার হাজার নরনারী ও শিশু মারা গেছে। আমেরিকায় মিলিয়নেয়ারের সংখ্যা বেড়েছে তিন গুণ। অফশোর ব্যাংকগুলোতে বিভিন্ন শাখায় বিভিন্ন অ্যাকাউন্টে টাকা জমে স্তূপ হয়েছে। কাবুলে শুধু ধ্বংসযজ্ঞ সৃষ্টি করেই পশ্চিমা জগতের লোকেরা ধনবান হয়নি, তালেবান ও মুজাহেদিনদের দ্বারা দুই হাজার বছর আগের বুদ্ধমূর্তি এবং অন্যান্য দুর্লভ ঐতিহাসিক দ্রব্য লুট করিয়ে তা ইউরোপ আমেরিকার বাজারে বিক্রি করে লাখ লাখ ডলার তারা কামিয়েছে। মজার খবর এই যে, ইরাকের বাগদাদ দখলের পর এক মার্কিন প্যারাট্রুপার প্রেসিডেন্ট সাদ্দামের টয়লেট-কুশনটি লুট করেছে।

মার্কস বলেছিলেন, সব দেশের বুর্জোয়া চরিত্র অভিন্ন। বাংলাদেশের পাতি বুর্জোয়ারা তার প্রমাণ দিয়েছে করোনার এই প্রায় দু’বছরে। ভুয়া হাসপাতাল তৈরি করে, করোনা শনাক্তকরণের নামে ভুয়া সার্টিফিকেট বিক্রি করে, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে যোগসাজশে ভ্যাকসিন আনার ব্যাপারে নানা দুর্নীতি করে অনেক নব্য ধনী তৈরি হয়েছে। কিন্তু এত তাড়াতাড়ি দেশে নব্য ধনীর সংখ্যা ১১ হাজারের বেশি হয়ে গেল কী করে? এই নব্য ধনীরা আবার কোটিপতি।

গত বৃহস্পতিবার (২৯ জুলাই) সৌভাগ্যক্রমে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর আতিউর রহমানের সঙ্গে টেলিফোনে আলাপ হলো। তার গভর্নরগিরির আমলে দেশের অর্থনীতিতে একটা গতিশীলতা এসেছিল। তার সুফল পেয়েছিল দেশের প্রান্তিকজনও। এটা দেশের অসাধু আমলাচক্রের সহ্য হয়নি। তারা তাকে চক্রান্ত করে সরিয়েছেন। তার বিরুদ্ধে চক্রান্ত এখনও চলছে। যা হোক পুরোনো কথায় যাব না। সাবেক গর্ভনর একজন অর্থনীতিবিদও। তাকে দেশে এই করোনাকালীন বছরে ভরা বর্ষায় কৈ মাছের উজানের মতো এত কোটিপতি গজাল কী করে তার কারণ জিজ্ঞাসা করলাম। তিনি বললেন, এই কোটিপতিরা করোনার আগেই কোটিপতি হওয়ার কাছাকাছি ছিলেন। করোনার সময়ে ক্লাবে-পার্টিতে টাকা খরচ করতে পারেননি। বড় বড় রেস্টুরেন্টে মদের আসরে বসতে পারেননি। ব্যাংকে টাকা জমিয়ে তারা দ্রুত কোটিপতি হয়ে গেছেন।

আমার অনুজপ্রতিম অর্থনীতিবিদ ড. মীর্জ্জা আজিজুল ইসলাম (সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা) বলেছেন, ‘করোনার সময়ে এত বেশি কোটিপতি আমানতকারীর ব্যাংকের অ্যাকাউন্টে আমানত বৃদ্ধি অস্বাভাবিক ব্যাপার। এর একটা ভালো দিক- টাকাটা বিদেশে না গিয়ে দেশে থাকায় ভবিষ্যতে তা বিনিয়োগের কাজে লাগবে।’ তবে দেশের দরিদ্রের সংখ্যা বৃদ্ধি করেই যে এই ধনীর সংখ্যা বৃদ্ধি- এটা তিনি স্বীকার করেছেন। বলেছেন, ‘দারিদ্র্য অলরেডি বেড়েছে বলেই এত বেশি কোটিপতি হয়েছে।’

প্রশ্নটা দেশের ব্যাংকে কোটিপতি আমানতকারীর সংখ্যা বৃদ্ধির নয়। প্রশ্নটা হচ্ছে এই অর্থের উৎস কী? লকডাউনের জন্য বড়লোকেরা ক্লাবে-পার্টিতে যেতে পারেননি। বিদেশে হলিডে করতে যেতে পারেননি- এটাই এই অর্থের একমাত্র উৎস নয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের উচিত এই অর্থের সন্ধান খতিয়ে দেখা। অনেক অর্থনীতিবিদও সেই কথা বলছেন। দেশে ধনী-গরিবের বৈষম্য বর্তমানে এত বেড়েছে যে, এই অর্থের মধ্যে রয়েছে গরিবের রক্ত নিংড়ানো অর্থও। আগে যারা হুন্ডি করে এবং অন্যান্য নানা উপায়ে বিদেশে টাকা পাচার করতেন, করোনার কারণে তারা সেটা পারেননি, সেটা দেশি ব্যাংকে তাদের আমানত বৃদ্ধির একটা বড় কারণ হতে পারে।

অর্থনীতিবিদরা স্বীকার করেছেন, করোনার জন্য সরকার যেসব বড় ছাড় দিয়েছে, সেই কারণে একশ্রেণির ব্যবসায়ী অত্যন্ত লাভবান হয়েছেন। এছাড়া করোনার ক্ষতি পোষানোর জন্য সরকারের দেওয়া প্রণোদনা ঋণ অনেক সুবিধাভোগী ব্যবসায় না খাটিয়ে ব্যাংকে জমা রেখেছেন ভবিষ্যতের আরাম-আয়েশের জন্য। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক আরেক গভর্নর সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেছেন, ‘কোটিপতির সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার ফলে দেশে ইনকাম ডিসপ্যারিটি বা আয়বৈষম্য দারুণভাবে বেড়েছে। করোনায় অনেকের বেতন কমে গেছে। চাকরি হারিয়েছেন অনেকেই। ছোট উদ্যোক্তারা ঋণ চেয়েও পাচ্ছেন না।’ সাবেক গর্ভনরের কথা থেকে স্পষ্ট, করোনার জন্য সরকার যেসব ছাড় বা প্রণোদনার অর্থ দিয়েছে, তা দিয়ে তেলা মাথায় তেল দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ ছোট উদ্যোক্তাদের চাইতে বড় এবং ধনী ব্যবসায়ীরা ছাড় এবং প্রণোদনার অর্থ দুটোই বেশি পেয়েছেন এবং তাদের অনেকে আবার সেই অর্থ ব্যাংকে রেখে নব্য কোটিপতি হয়েছেন।

আমি অর্থনীতিবিদ নই। তবু আমার ধারণা, করোনার জন্য দেশ থেকে বিদেশে অবাধে টাকা পাচার আপাতত বন্ধ হওয়াই কোটিপতির সংখ্যা বৃদ্ধির একটি বড় কারণ। ধনী ব্যক্তিরা হোটেলে-ক্লাবে গিয়ে করোনার কারণে ভোগবিলাসে মত্ত হতে পারেননি বলে ব্যাংকে তাদের আমানত ভারি হয়েছে, এটা কোটিপতির সংখ্যা বৃদ্ধির একটা বড় কারণ বলে আমার মনে হয় না। যারা ঢাকার বিভিন্ন চিহ্নিত ক্লাবে গিয়ে আমোদ-ফুর্তি করেন, করোনা যে তাদের জন্য কোনো বাধা নয়, তার প্রমাণ সম্প্রতি চিত্রাভিনেত্রী পরীমণিকে নিয়ে মধ্যরাতের বেলেল্লাপনা।

করোনার বছরের নতুন কোটিপতিদের এই অলস অর্থের উৎস কী তা যেমন বাংলাদেশ ব্যাংকের তদন্ত করে জানা উচিত, তেমনি দেশের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোরও এই ব্যাপারে তৎপরতা প্রয়োজন। একদিকে করোনায় মানুষ মরছে, অর্থনীতি ধ্বংসের পথে, অন্যদিকে একশ্রেণির মানুষ মার্চেন্ট অব ডেথ বা মৃত্যু ব্যবসায়ী সেজে রাতারাতি কোটিপতি হচ্ছেন, তাদের ব্যাংক ব্যালান্স ক্রমেই স্ম্ফীত হচ্ছে, তা হতে পারে না।

লন্ডন, ২৯ জুলাই, বৃহস্পতিবার, ২০২১

শেয়ার করুন