বাংলাদেশের পোশাকখাতে নিয়োজিত লাখ লাখ কর্মীর সুরক্ষায় নতুন চুক্তিতে সম্মতি দিয়েছে বিশ্বের নামিদামি অন্তত ৮০টি ব্র্যান্ড। এরই মধ্যে চুক্তিটিতে সই করেছে কয়েকটি প্রতিষ্ঠান। বাকিরা আগামী কয়েক সপ্তাহের মধ্যে সই করবে বলে আশা করা হচ্ছে।
গত বুধবার (১ সেপ্টেম্বর) প্রভাবশালী ব্রিটিশ দৈনিক দ্য গার্ডিয়ানের এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়েছে।
জানা গেছে, মার্কস অ্যান্ড স্পেনসার, জন লুইস, আসোস, এইচঅ্যান্ডএম, জারার মালিক ইন্ডিটেক্স, নিউ লুকসহ ৮০টির বেশি প্রতিষ্ঠান আইনত বাধ্যতামূলক চুক্তিতে সম্মতি জানিয়েছে। এতে সইয়ের অপেক্ষায় রয়েছে প্রাইমার্ক, নেক্সট, জেডি স্পোর্টসের মতো ব্র্যান্ডগুলো। অবশ্য রানা প্লাজা ট্রাজেডির পর পোশাককর্মীদের সুরক্ষা সংক্রান্ত যে চুক্তি হয়েছিল, তাতে দুই শতাধিক প্রতিষ্ঠান সই করেছিল। সঙ্গে ছিল খুচরা ও পোশাক কারখানা শ্রমিকদের প্রতিনিধিত্বকারী দুটি ইউনিয়নও (ইউনি গ্লোবাল এবং ইন্ডাস্ট্রিঅল)।
২০১৩ সালে রানা প্লাজা ট্র্যাজেডিতে এক হাজার ১৩৪ জন নিহত হওয়ার পর সই হয়েছিল মূল চুক্তিটি, যা ‘বাংলাদেশ অ্যাকর্ড’ নামে পরিচিত। গত মে মাসে শেষ হয় এ চুক্তির মেয়াদ। নতুন চুক্তি নিয়ে আলোচনা চলায় পরে পুরোনো চুক্তির মেয়াদ আরও তিন মাস বাড়ানো হয়। গত ৩১ আগস্ট শেষ হয়েছে সেই মেয়াদও।
দ্য গার্ডিয়ানের খবর অনুসারে, রানা প্লাজায় প্রাইমার্কের এক সাপ্লাইয়ারের কারখানা ছিল। পরে দুর্ঘটনায় ভুক্তভোগীদের ক্ষতিপূরণ হিসেবে মোটা অর্থ দিয়েছে ব্রিটিশ প্রতিষ্ঠানটি। প্রাইমার্ক জানিয়েছে, বাংলাদেশের পোশাকর্মীদের সুরক্ষায় নতুন চুক্তিতে সই করার লক্ষ্য রয়েছে তাদের এবং তারা এই মুহূর্তে নথিপত্র পর্যালোচনা করছে। প্রতিষ্ঠানটির ভাষ্য, নতুন চুক্তির জন্য সমঝোতা শেষ হওয়ায় আমরা খুশি।
পুরোনো বা মূল চুক্তিতে বলা হয়েছিল, বাংলাদেশে গার্মেন্টস কারখানাগুলোতে স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা সংক্রান্ত শর্ত লঙ্ঘন হলে কারখানাগুলোর পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট ব্র্যান্ডগুলোকেও আইনি বিচারের মুখোমুখি হতে হবে। দ্য গার্ডিয়ানের তথ্যমতে, ২০১৩ সাল থেকে বাংলাদেশের গার্মেন্টগুলো ৩৮ হাজারের বেশিবার পরিদর্শন করা হয়েছে এবং প্রায় ২০০ কারখানা দুর্বল নিরাপত্তা ব্যবস্থার কারণে চুক্তি থেকে বাদ পড়েছে।
বুধবার ব্রিটিশ পত্রিকাটি জানিয়েছে, গত ২৪ ঘণ্টায় যুক্তরাজ্যের বেশ কিছু ব্র্যান্ড ‘পোশাক ও বস্ত্র শিল্পে স্বাস্থ্য এবং নিরাপত্তার জন্য আন্তর্জাতিক চুক্তি’তে সই করেছে। নতুন চুক্তিতে আইনি বাধ্যবাধকতার উপাদান এবং ২০১৩ সাল থেকে নানা শর্ত, মজুরি ও নিরাপত্তায় যে উন্নতি হয়েছে তা বিপন্ন হতে পারে বলে ইউনিয়ন নেতারা উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন, এ কারণেই চুক্তি সংক্রান্ত সমঝোতা প্রক্রিয়া এতো দীর্ঘায়িত হচ্ছে।
এছাড়া, ব্র্যান্ডগুলো পোশাককর্মীদের সুরক্ষা সংক্রান্ত এ চুক্তি বাংলাদেশের বাইরে অন্তত আরও একটি দেশে কার্যকর করতে চাচ্ছে। এতে স্বাক্ষরকারী প্রতিষ্ঠানগুলো আগামী ছয় মাসের মধ্যে বৈঠক করে নির্ধারণ করবে, সেটি কোন দেশ হবে এবং সেখানে আগামী দুই বছরের মধ্যেই পরিবর্তন আনার লক্ষ্য নেওয়া হয়েছে। নতুন চুক্তির মেয়াদ শেষ হবে ২০২৩ সালের অক্টোবর মাসে।
ইউনি গ্লোবাল ইউনিয়নের মহাসচিব ক্রিস্টি হফম্যান বলেন, বৈশ্বিক পোশাক শিল্পের কর্মীদের জন্য আজ একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নেওয়া হলো। আন্তর্জাতিক চুক্তিতে সই করার সময় ব্র্যান্ড ও খুচরা বিক্রেতারা বাংলাদেশে কারখানাগুলোর নিরাপত্তা নিশ্চিতের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে এবং কমপক্ষে আরেকটি পোশাক উৎপাদনকারী দেশে জরুরিভিত্তিতে প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা কর্মসূচি চালু করতে সম্মত হয়েছে।
তিনি বলেন, আমরা অত্যন্ত আনন্দিত যে, বিশ্বব্যাপী অনেক খুচরা বিক্রেতা ও ব্র্যান্ড আন্তর্জাতিক চুক্তিতে সই করেছে এবং এর মাধ্যমে তাদের সরবরাহ ব্যবস্থায় নিয়োজিত পোশাককর্মীদের নিরাপত্তার দায়িত্ব নিয়েছে। আমরা যত দ্রুত সম্ভব এ চুক্তিতে আরও স্বাক্ষরকারীদের স্বাগত জানাতে চাই।
অবশ্য দেশের পোশাকখাতে আরএমজি সাসটেইনেবিলিটি কাউন্সিল (আরএসসি) ছাড়া অন্য কোনো সংস্থার নিরাপত্তা পর্যবেক্ষণ সংক্রান্ত কাজ করার অনুমোদন নেই বলে জানিয়েছে তৈরি পোশাক শিল্প ও রপ্তানিকারক সমিতি (বিজিএমইএ)। সংস্থাটি বলছে, ‘স্টিচিং বাংলাদেশ অ্যাকর্ড ফাউন্ডেশন’ এবং প্রস্তাবিত ‘ইন্টারন্যাশনাল অ্যাকর্ড ফর হেলথ অ্যান্ড সেফটি ইন দ্য টেক্সটাইল অ্যান্ড গার্মেন্টস ইন্ডাস্ট্রি ফাউন্ডেশন’ নামে দুটি সংস্থার সঙ্গে আরএসসির কোনো সম্পৃক্ততা নেই। সংস্থা দুটি বাংলাদেশ সরকারের অনুমতি না পাওয়া পর্যন্ত প্রত্যক্ষ অথবা পরোক্ষভাবে বাংলাদেশে কোনো কাজ করতে পারবে না। গত রোববার (২৯ আগস্ট) বিজিএমইএ’র একাধিক সূত্র জাগো নিউজকে এ তথ্য নিশ্চিত করে।
এর আগে, গত শুক্রবার (২৭ আগস্ট) বিখ্যাত ফ্যাশন ও লাইফস্টাইল ম্যাগাজিন ভোগ’র এক প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশের পোশাকখাতে নিয়োজিত কর্মীদের অধিক সুরক্ষা দিতে ঐক্যবদ্ধ হচ্ছে আন্তর্জাতিক ফ্যাশন ব্র্যান্ডগুলো। তাদের নতুন চুক্তিতে শুধু পোশাক কারখানার অবকাঠামোগত উন্নয়নই নয়, থাকছে কর্মীদের স্বাস্থ্য, নিরাপত্তার পাশাপাশি জীবিকা নিশ্চিতের শর্তও। এরই মধ্যে এইচঅ্যান্ডএম, জারার মতো নামিদামি বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান এই চুক্তিতে সই করেছে। ১ সেপ্টেম্বর থেকে নতুন ‘টেক্সটাইল এবং গার্মেন্টস শিল্পে স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তার জন্য আন্তর্জাতিক চুক্তি’ কার্যকর হবে বলেও জানানো হয় ওই প্রতিবেদনে।
এর প্রতিক্রিয়ায় দেশের তৈরি পোশাক মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ বলেছে, আন্তর্জাতিক অ্যাকর্ড গঠনের ঘোষণা দিয়ে জারি করা সংবাদ বিজ্ঞপ্তিটি অনেকের মধ্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করতে পারে, যা এই শিল্পের অংশীজনদের মধ্যে সম্পর্কের অবনতি ঘটাতে পারে। এই সংবাদ বিজ্ঞপ্তিকে একটি স্বাধীন সংস্থাকে অবমাননা করার প্রয়াস হিসেবে দেখা যেতে পারে; যে সংস্থাটিকে কি-না উপরোক্ত চুক্তিবদ্ধ পার্টিগুলো (আন্তর্জাতিক অ্যাকর্ড ফাউন্ডেশন) নিয়ন্ত্রণ অথবা তত্ত্বাবধান করার ক্ষমতা রাখে না।
বিজিএমইএ সভাপতি ফারুক হাসান জানান, সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের তত্ত্বাবধান ও অনুমোদনক্রমে সরকারের অনুমতি নিয়ে একটি স্বাধীন, অলাভজনক সংস্থা হিসেবে অ্যাকর্ডের কার্যক্রমগুলো পরিচালনার জন্য গঠিত হয়েছিল আরএসসি। ২০২০ সালের ৩১ মে অ্যাকর্ডের কার্যক্রম শেষ হয়। পরবর্তীকালে আরএসসি ২০২০ সালের ১ জুন থেকে বাংলাদেশের পোশাক কারখানাগুলোর নিরাপত্তা সামগ্রিকভাবে পর্যবেক্ষণের দায়িত্ব গ্রহণ করে।
তিনি বলেন, আরএসসির উদ্দেশ্য হচ্ছে, একটি অভিন্ন কোড অব কন্ডাক্ট প্রণয়নের মাধ্যমে সাধারণ নিরাপত্তা প্লাটফর্ম হিসেবে পোশাক কারখানাগুলোর জন্য টেকসই পরিবেশ সৃষ্টি করা। শিল্পের গর্বের অর্জনগুলো ধরে রাখা এবং সেই সঙ্গে নিরাপত্তা কার্যক্রমগুলো অব্যাহত রাখার জন্য কমপ্লায়েন্স প্রতিপালন নিশ্চিত করা। নিরাপত্তা বিষয়গুলোতে কারখানার কোনো প্রকার শিথিলতা অথবা এ বিষয়ে কারখানাকে কোনো প্রকার ছাড় দেওয়া হবে না। যদিও সার্টিফিকেশন প্রদানের বিষয়ে আরএসসি আশানুরূপ অগ্রগতি অর্জনে পিছিয়ে রয়েছে, তবে এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে আরএসসি সর্বাত্মক চেষ্টা করছে।
বিজিএমইএর মতে, সব স্টেকহোল্ডারের সমান প্রতিনিধিত্ব নিয়ে আরএসসি গঠিত হয়, যা একটি স্বাধীন প্লাটফর্ম। অ্যাকর্ড ২০১৩-এর প্রটোকলগুলো আরএসসিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এসব পদক্ষেপের মাধ্যমে আরএসসি তার যোগ্যতা ও কার্যকারিতার প্রমাণ রেখেছে।
বিজিএমইএ সভাপতি আরও বলেন, আরএসসি বোর্ড কেবল স্টেকহোল্ডারদের কাছেই জবাবদিহি করতে বাধ্য। এটি একটি অনন্য প্রতিষ্ঠান, যা বোর্ডের সবার সম্মতিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণের মাধ্যমে কাজ করে, যেখানে একটি বা দুটি গ্রুপ কোনোভাবেই এর কার্যক্রম প্রভাবিত করতে পারে না। আরএসসি তার সার্বিক কার্যক্রমের জন্য সরকারের কাছে জবাবদিহি করতে বাধ্য, কারণ সরকার আমাদের পোশাক কারখানার নিরাপত্তা কমপ্লায়েন্স এবং অভিযোগ পর্যবেক্ষণের অনুমতি দিয়েছে। বাংলাদেশের দুই গুরুত্বপূর্ণ উন্নয়ন সহযোগী আইএলও ও ইইউ আরএসসি গঠনের শুরু থেকেই তাদের অনুমোদন দিয়েছে।