বৈশ্বিক উষ্ণতা বাড়ার ফলে হিমবাহের বরফ গলছে, সমুদ্রপৃষ্ঠের পানির উচ্চতা বাড়ছে, নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হচ্ছে। একদিকে খরায় ফসল পুড়ছে, অন্যদিকে ফসল-মানুষ-ঘরবাড়ি বন্যায় ভাসছে। এমনকি অনেক উন্নত দেশ দাবানলে জ্বলছে। এসবই জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব। উন্নত দেশগুলো ক্ষতিকর গ্রিনহাউজ গ্যাস নির্গমনের জন্য বেশি দায়ী। উন্নয়নশীল দেশ মাথাপিছু কার্বন নিঃসরণের জন্য যত না দায়ী, তার চেয়ে ফল ভোগ করছে বেশি। জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাব মোকাবিলায় চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ছে বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার বহু দেশ।
বৈশ্বিক উষ্ণতা বাড়ার ফলে হিমবাহের বরফ গলছে, সমুদ্রপৃষ্ঠের পানির উচ্চতা বাড়ছে, নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হচ্ছে। একদিকে খরায় ফসল পুড়ছে, অন্যদিকে ফসল-মানুষ-ঘরবাড়ি বন্যায় ভাসছে। এমনকি অনেক উন্নত দেশ দাবানলে জ্বলছে। এসবই জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব। উন্নত দেশগুলো ক্ষতিকর গ্রিনহাউজ গ্যাস নির্গমনের জন্য বেশি দায়ী। উন্নয়নশীল দেশ মাথাপিছু কার্বন নিঃসরণের জন্য যত না দায়ী, তার চেয়ে ফল ভোগ করছে বেশি। জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাব মোকাবিলায় চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ছে বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার বহু দেশ।
জলবায়ু পরিবর্তন কৃষি, খাদ্য নিরাপত্তা এবং মানুষের স্বাস্থ্যের ওপর যথেষ্ট প্রভাব ফেলে। জলবায়ু পরিবর্তন কৃষিকে ধ্বংস করতে শুরু করেছে। বিশ্বের অনেক অঞ্চলে খাদ্য নিরাপত্তাকে হুমকির মুখে ফেলেছে। জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক হুমকি সৃষ্টি করেছে। অনেক উন্নয়নশীল দেশের মতো দক্ষিণ এশিয়ার কৃষক এখন পরিবর্তিত জলবায়ুর প্রভাব মোকাবিলায় হিমশিম খাচ্ছে। ক্রমবর্ধমান তাপমাত্রা, বৃষ্টিপাতের ধরন পরিবর্তন এবং হিমবাহের দ্রুত গলন দক্ষিণ এশিয়ায় কৃষি ও খাদ্য নিরাপত্তার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। বৈশ্বিক উষ্ণতা একই সঙ্গে কোভিড-১৯ খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার বিদ্যমান চ্যালেঞ্জগুলোকে আরও বাড়িয়ে তুলেছে। কোভিড-১৯ ও জলবায়ু পরিবর্তনের দ্বৈত প্রভাব দক্ষিণ এশিয়ার খাদ্যব্যবস্থাকে মারাত্মক হুমকির মধ্যে ফেলেছে। কর্মহীন হয়ে পড়েছে বহু মানুষ। কয়েকটি গবেষণায় তুলে ধরা হয়েছে- দক্ষিণ এশিয়া জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চলগুলোর একটি।
এ অবস্থায় খাদ্য নিরাপত্তা, জনস্বাস্থ্য এবং জলবায়ু পরিবর্তনকে সমন্বিতভাবে সমাধান করা প্রয়োজন, যাতে খাদ্য উৎপাদন, জলবায়ু অভিযোজন ও প্রশমিত হয়। ফসলের ফলন মূলত জলবায়ুর ওপর নির্ভরশীল। তাপমাত্রা ওঠানামার ফলে ফলনের তারতম্য ঘটে। তাপমাত্রা ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস বৃদ্ধির ফলে গমের ফলন ৫ থেকে ১০ শতাংশ হ্রাস পায়। জলবায়ু পরিবর্তনসংক্রান্ত ইন্টার-গভর্মেন্টাল প্যানেল (আইপিসিসি) অনুসারে, দক্ষিণ এশিয়ায় ২০৫০ সালের মধ্যে গড় তাপমাত্রা ০.৮৮ থেকে ৩.১৬ ডিগ্রি বৃদ্ধি পাবে। অন্যান্য গবেষণায়ও তাপমাত্রায় বড় ধরনের পরিবর্তন লক্ষ করা গেছে। তাপমাত্রার পরিবর্তনের পাশাপাশি বৃষ্টিপাতের ধরনেরও পরিবর্তন হয়। বৈশ্বিক উষ্ণায়নের ফলে কীটপতঙ্গ ও উদ্ভিদের রোগের বিস্তার এবং ফসলের কীটপতঙ্গ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে, যা ফলনেও প্রভাব ফেলবে। তাপমাত্রা বৃদ্ধি হিন্দুকুশ হিমালয় অঞ্চলে হিমবাহের গলনকে ত্বরান্বিত করেছে। হিমালয় হিমবাহের দ্রুত গলন বিভিন্নভাবে নিম্নাঞ্চলগুলোকে প্লাবিত করবে। ফলে দক্ষিণ এশিয়ার বৃহৎ অংশে কৃষি ও খাদ্য নিরাপত্তা আরও হুমকির মধ্যে পড়বে।
জলবায়ু পরিবর্তন ও ভূমিসংক্রান্ত বিশেষ প্রতিবেদন (আইপিসিসি, ২০১৯) অনুসারে, সেচ সুবিধা কম থাকায় দক্ষিণ এশিয়াসহ অনেক অঞ্চলে ফসলের ফলনের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। বিশেষ করে চারটি প্রধান ফসলের উৎপাদনে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব বেশি। ফসলগুলো হলো-গম, ধান, ভুট্টা ও সয়াবিন। গবেষক গোলাম রসুল ৫২টি গবেষণার (২০২১) ফলাফল পর্যালোচনায় দেখতে পান জলবায়ু পরিবর্তনে দক্ষিণ এশিয়ার সব ফসলের উৎপাদনের গড় পরিবর্তন ২০৫০ সালের মধ্যে প্রায় ৮ শতাংশ হতে পারে; বিশেষ করে ভুট্টা ও সরগমের ফলন হ্রাস পেয়ে যথাক্রমে ১৬ ও ১১ শতাংশ হতে পারে। দক্ষিণ এশিয়ার কয়েকটি দেশে বৃষ্টিনির্ভর কৃষিতে ফসলের ফলন উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেতে পারে। ইন্টারন্যাশনাল ফুড পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট (আইএফপিআরআই) পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, ২০০০ সালের তুলনায় ২০৫০ সালের মধ্যে দক্ষিণ এশিয়ায় জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে গমের ফলন ৫০ শতাংশ, ধানের ফলন ১৭ শতাংশ এবং ভুট্টার ফলন ৬ শতাংশ হ্রাস পাবে। মোট কথা, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ফসলের উৎপাদনের ওপর সামগ্রিক নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।
গ্লোবাল ক্লাইমেট রিস্ক ইনডেক্স অনুযায়ী, ১৯৯৯ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে দুর্যোগে দক্ষিণ এশিয়া সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। প্রতি বছর জলবায়ু পরিবর্তনজনিত দুর্যোগের মুখোমুখি বিশ্বের মোট জনসংখ্যার ৬৪ শতাংশ দক্ষিণ এশিয়ায় বাস করে। এ অঞ্চলে জলবায়ু বিপর্যয়ের উল্লেখযোগ্য অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রভাব পড়েছে। বিশ্বব্যাংকের মতে, জলবায়ু পরিবর্তন ২০৩০ সালের মধ্যে ৬ কোটি ২০ লাখ দক্ষিণ এশীয়কে চরম দারিদ্র্যের দিকে ঠেলে দিতে পারে। এডিবির ২০১৭ সালের রিপোর্ট অনুসারে, শুধু বন্যার কারণে ২০৩০ সালের মধ্যে বার্ষিক ২১৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার খরচ হতে পারে। গ্লোবাল সেন্টার অন অ্যাডাপ্টেশন (জিসিএ) ২০২০-এর মতে, গত ৩০ বছরে জলবায়ু-সংক্রান্ত দুর্যোগগুলো দক্ষিণ এশিয়ার ১ কোটি ৭০ লাখ মানুষকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে এবং ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ১২৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। গত চার দশকে ভারত ও পাকিস্তানে প্রতি ৩ বছর অন্তর একবার খরা হয়েছে। বাংলাদেশ ও নেপালেও ঘন ঘন খরা দেখা দেয়। দক্ষিণ এশিয়ায় বৃষ্টিপাত এবং বৃষ্টিপাতের ধরনে ক্রমবর্ধমান পরিবর্তনশীলতার সঙ্গে বৃষ্টিনির্ভর কৃষির ঝুঁকি অনেকগুণ বেড়ে যায়।
জলবায়ু পরিবর্তনে শুধু ফসলের ক্ষতি নয়, মানুষের স্বাস্থ্যের ওপরও এর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাব পড়ে। বিশেষ করে নিু ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোতে। বন্যা, খরা ও ঘূর্ণিঝড়ের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ দক্ষিণ এশিয়ায় বিদ্যমান জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দিয়েছে। যেমন-জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে মানুষের শ্বাসযন্ত্র ও কার্ডিওভাসকুলার রোগের প্রাদুর্ভাব বেড়ে যায়। পাশাপাশি খরা, বন্যা, তাপপ্রবাহ, ঝড় ও দাবানলের কারণে মৃত্যু, আঘাতপ্রাপ্তি এবং মানসিক অসুস্থতাও বাড়ে। গবেষণায় বলা হয়েছে, তাপমাত্রা ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস বৃদ্ধির ফলে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে ডায়রিয়া রোগের হার ৫.৬ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে। ল্যানসেট সংক্রামক রোগের জার্নালের এক নিবন্ধ নিশ্চিত করেছে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সংক্রমণ রোগ বেড়ে যেতে পারে, যার মধ্যে ডেঙ্গি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন স্থানে ম্যালেরিয়া ও ডেঙ্গিজ্বরের প্রকোপ বেড়েছে।
সম্প্রতি এক আন্তর্জাতিক গবেষণায় দেখা যায়, চরম উষ্ণতার কারণে মানুষের মধ্যে অসুস্থতা ও মৃত্যু বাড়ছে। বাংলাদেশের মানুষের কর্মক্ষমতাও কমে যাচ্ছে। তাপমাত্রার দ্রুত বৃদ্ধির তালিকায় সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দেশের মধ্যে শীর্ষে ভারতের পরই রয়েছে বাংলাদেশ। গবেষকরা বলেছেন, বাংলাদেশের তাপমাত্রা বৃদ্ধির পেছনে বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির প্রভাব ৩৭ শতাংশ, বাকি ৬৩ শতাংশের পেছনে রয়েছে স্থানীয় কারণ। চরম উষ্ণতার কারণে বিশ্বের মোট জনসংখ্যার চার ভাগের এক ভাগ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বৈশ্বিক উষ্ণতা এবং কোভিড-১৯ খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার বিদ্যমান চ্যালেঞ্জগুলোকে আরও বাড়িয়ে তুলেছে।
এ প্রেক্ষাপটে শুরু হয়েছে বিশ্বের সর্ববৃহৎ জলবায়ু সম্মেলন কপ-২৬। উল্লেখ্য, কনফারেন্স অব দ্য পার্টিজকে সংক্ষেপে বলা হয় কপ। এবারের সম্মেলন চলছে যুক্তরাজ্যের স্কটল্যান্ডের গ্লাসগোতে। ২০১৫ সালে প্যারিস জলবায়ু সম্মেলনের পর এটিই বিশ্বের সবচেয়ে বড় জলবায়ু সম্মেলন। বৈশ্বিক উষ্ণতা বাড়ার গতি কমাতে বিশ্বজুড়ে কার্বন নিঃসরণের হার নির্ধারণের ক্ষেত্রে এ সম্মেলন অনেক গুরুত্বপূর্ণ। জাতিসংঘ বিশ্বের ২০০টি দেশকে পরিবেশের কার্বন নিঃসরণ কমাতে ২০৩০ সাল পর্যন্ত তাদের কর্মপরিকল্পনা কী, তা গ্লাসগোর সম্মেলনে জানাতে বলেছে।
বিজ্ঞানীরা বলেন, শিল্পবিপ্লব-পূর্ববর্তী পৃথিবীর তাপমাত্রার তুলনায় তাপমাত্রা বৃদ্ধি ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে রাখতে পারলে জলবায়ু পরিবর্তনের বিপর্যয়কর প্রভাব থেকে বাঁচা যাবে। উন্নয়নশীল দেশের জন্য ক্ষতিপূরণ হিসাবে ধনী দেশগুলো ২০২০ সালের মধ্যে বছরে ১০০ বিলিয়ন ডলার দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। কিন্তু এ প্রতিশ্রুতি রক্ষা করা হয়নি। সম্প্রতি জাতিসংঘও এ কথা বলেছে। জলবায়ু পরিবর্তন তহবিল জোগাড় যেমন জরুরি, তেমনি এসব অর্থ ঠিকমতো ব্যবহার করাও জরুরি-বলেছেন কপ-২৬ এর প্রেসিডেন্ট ব্রিটিশ এমপি অলোক শর্মা। তিনি আরও বলেছেন, ২০৫০ সালের মধ্যে পৃথিবীর জন্য ক্ষতিকর কার্বন নিঃসরণ একবারে নামিয়ে আনার জন্য এ সম্মেলন খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
সম্প্রতি বাংলাদেশের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ব্রিটিশ দৈনিক দ্য ফিন্যান্সিয়াল টাইমসে একটি নিবন্ধ লিখেছেন। এতে তিনি গত কয়েক দশকে শুধুই প্রতিশ্রুতির জন্য উন্নত দেশগুলোর প্রতি অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বিশ্বনেতাদের কাছে প্রতিশ্রুতিগুলোকে কাজে পরিণত করার দাবিও জানিয়েছেন। তার মতে, পশ্চিমা নেতারা যদি কথাগুলো শোনেন, সক্রিয় হন এবং বিজ্ঞান তাদের কাছে যা দাবি করে তা দৃঢ়ভাবে কাজে লাগান, তাহলে কপ-২৬কে সফল করার এখনো সময় আছে। সম্মেলনের সফলতার ওপরই অনেকটা নির্ভর করছে বিপর্যয় থেকে পৃথিবীকে বাঁচানোর চেষ্টা কতটা কাজ করবে। যার ফলে আগামী দিনগুলোতে আমাদের নিত্যদিনের জীবনযাপনে বড় রকমের পরিবর্তন আসতে পারে।
লেখক : কৃষি অর্থনীতিবিদ; সাবেক ন্যাশনাল কনসালটেন্ট, এফএও