বিজয়ের সুবর্ণজয়ন্তী: অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রায় অদম্য নারী!

মত ও পথ রিপোর্ট

নারী

আজ বৃহস্পতিবার (১৬ ডিসেম্বর), মহান বিজয়ের সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন করছে সমগ্র বাঙালি জাতি। ঠিক পঞ্চাশ বছর আগে ১৯৭১ সালের এই দিনে পাকিস্তানি শোষকদের নিপীড়নের শৃঙ্খল ভেঙে মহান স্বাধীনতাযুদ্ধে বিজয় লাভ করে বাঙালি। এই পঞ্চাশ বছরে বাংলাদেশ শুধুই অর্জনের গল্প লিখেছে। লিখেছে নারীর অধিকার, ক্ষমতায়ন ও উন্নয়নের অভাবনীয় গল্পও।

যদিও ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের ট্র্যাজেডি, স্বৈরশাসনসহ নানা প্রতিবন্ধকতা ছিল। তবে এসব বাধা ডিঙিয়ে অর্থনীতি, উন্নয়ন, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবায় বাংলাদেশ এগিয়েছে ক্রমবর্ধমান গতিতে। উন্নয়নের নানা সূচকে বাংলাদেশ এখন দক্ষিণ এশিয়ায় প্রথম সারিতে অবস্থান করছে। এসব সূচকে নারীর অগ্রযাত্রাও চোখে পড়ার মতো। বাংলাদেশের নারীরা এখন প্লেন চালাতে পারেন। নারীর হাতে ট্রেন চলছে। পোশাকখাতসহ বিভিন্ন অর্থনৈতিক সূচকের চাকা ঘোরাচ্ছেন নারী শ্রমিকরাই। বিজয়ের এই পঞ্চাশ বছরে এসে বাংলাদেশের এমন অগ্রযাত্রা নিয়ে ঈর্ষা করছে বিশ্ব সম্প্রদায়।

universel cardiac hospital

সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, দেশের রপ্তানি আয়ের শতকরা ৮০ ভাগ আসে তৈরি পোশাকশিল্প থেকে। পোশাকশিল্পের আয় থেকেই বাংলাদেশের অর্থনীতির চলমান অগ্রযাত্রা। বিশ্বমন্দা আর করোনা মহামারির দুর্যোগকালে এই পোশাকখাত এগিয়ে নিয়েছে অর্থনীতিকে।

এই পোশাকশিল্প দেশের অর্থনীতির বড় খাত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বড় নিয়ামক হয়ে উঠেছে নারীর উপার্জন ও ক্ষমতায়নে। গ্রামীণ অর্থনীতিতে নারীর যে অবদান, তার মধ্যে নারী পোশাক শ্রমিকরা সবচেয়ে এগিয়ে। অশিক্ষিত, অল্পশিক্ষিত নারীরা এ খাতে শ্রম দিয়ে নিজের ভাগ্য যেমন বদলেছেন, তেমনি দেশের অর্থনীতি চাঙ্গা করছেন অনবরত।

এশিয়ান সেন্টার ফর ডেভেলপমেন্টের (এসিডি) জরিপ অনুযায়ী, দেশের মোট ৪২ লাখ ২০ হাজার পোশাক শ্রমিকের মধ্যে নারীর সংখ্যা ২৪ লাখ ৯৮ হাজার। এই খাতে নিয়োজিত নারী দেশের শিল্পখাতে নিয়োজিত মোট নারী কর্মীর ৭০ শতাংশ।

নারীর অগ্রযাত্রায় আরেক সিঁড়ি প্রবাসী আয়। আশির দশকের গোড়ার দিকে প্রবাসে গিয়ে শ্রম দেন বাংলাদেশের শ্রমিকরা। শুরুতে প্রবাসী শ্রমবাজারে পুরুষের একচেটিয়া দখল থাকলেও সময়ের ব্যবধানে নারীরাও যুক্ত হতে থাকেন।

জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর তথ্য মতে, ১৯৯১ সাল থেকে ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত মোট ৯ লাখ ৩৫ হাজার ৪৬৬ জন নারী প্রবাসে কাজ করতে গেছেন। প্রবাসী আয় প্রাপ্তির দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বে সপ্তম। প্রবাসে বাংলাদেশি শ্রমিকদের মধ্যে নারীর সংখ্যা এক লাখ ২১ হাজার ৯২৫, যা মোট সংখ্যার ১২ দশমিক ৯ শতাংশ। এই সংখ্যা দিনকে দিন বাড়ছেই।

স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে কৃষির যে উন্নয়ন, তাতেও নারীর ভূমিকা অগ্রগণ্য। আদি কৃষিতে নারী যেমন শ্রম দিয়েছে, বর্তমানেও নারী তেমনি শ্রম দিয়েছে। কৃষি তথ্য সার্ভিসের মতে, দেশে কর্মক্ষম নারীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক শ্রম দেন কৃষিতে। নারী শ্রমশক্তির ৭১ দশমিক ৫ শতাংশ নিয়োজিত কৃষিকাজে। বিবিএসের ২০১৮ সালের তথ্য মতে, দেশের কৃষি খাতে নিয়োজিত ৯০ লাখ ১১ হাজার নারী৷

দেশের অর্থনীতির আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ খাত হচ্ছে চা। বৈদেশিক আয়েও বিশেষ অবদান রাখছে চা। চা বাগানগুলোতে এক লাখ ২২ হাজার শ্রমিকের মধ্যে ৭০ শতাংশই নারী।

শিক্ষায় নারীর এখন সমান পদযাত্রা। প্রাথমিক থেকে শুরু করে উচ্চশিক্ষায় নারী প্রথম সারিতে অবস্থান করছে। শিক্ষা বিস্তারেও নারী অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে। প্রাথমিক শিক্ষকদের মধ্যে ৬০ শতাংশ নারী, যা বহু আগেই সীমা অতিক্রম করছে। তবে শিক্ষা খাতের অন্যান্য শাখায় নারীর অংশগ্রহণ নগণ্য বলে বিভিন্ন প্রতিবেদনে প্রকাশ পেয়েছে।

সেবা খাতে ৩৭ লাখ শ্রমিক কর্মরত, যা মোট শ্রমের ৭ দশমিক ২ শতাংশ। অন্যদিকে ২০২০ সালে নার্সিং ও মিডওয়াইফারি অধিদপ্তরের পিএমআইএস তথ্য অনুযায়ী, দেশে পুরুষ নার্সের সংখ্যা মাত্র ৯ দশমিক ৪ শতাংশ৷ অর্থাৎ ৯০ দশমিক ৬ শতাংশই নারী। এটি নারীর অগ্রযাত্রায় বিশেষ পরিবর্তন বলে মনে করা হয়।

নারীরা পুলিশ এবং জনপ্রশাসন বিভাগেও বিশেষভাবে অংশ নিচ্ছে, যা স্বাধীনতার সার্থকতাকে আরও অর্থবহ করে তুলছে। পুলিশের এক হিসাব অনুযায়ী, পুলিশের বিভিন্ন ইউনিটে কর্মরত নারীর সংখ্যা ১৫ হাজার ১৬৩ জন। তাদের মধ্যে উপ-মহাপরিদর্শক (ডিআইজি) দুজন, অ্যাডিশনাল ডিআইজি তিনজন, পুলিশ সুপার ৭১ জন, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ১০৯ জন ও সহকারী পুলিশ সুপার ১০০ জন৷ এছাড়া পরিদর্শক ১০৯, উপ-পরিদর্শক (এসআই) ৭৯৭, সার্জেন্ট ৫৮ জন, সহকারী উপ-পরিদর্শক (এএসআই) এক হাজার ১০৯ জন, নায়েক ২১১ জন এবং ১২ হাজার ৫৯৪ জন কনস্টেবলও নারী৷

অন্যদিকে প্রশাসন ক্যাডারে বর্তমানে ২৬ শতাংশ নারী কর্মরত। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের এক হিসাব অনুযায়ী, ১৪৯ জন ইউএনও ছাড়াও বর্তমানে ১০ জন জেলা প্রশাসক (ডিসি), ৩৮ জন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (এডিসি) এবং ১৭৩ জন সহকারী কমিশনার (ভূমি) পদে নারী দায়িত্ব পালন করছেন৷ এছাড়া সচিবের মধ্যে ১১ জন নারী৷ ৫১১ জন অতিরিক্ত সচিবের মধ্যে নারী ৮৩ জন, ৬৩৬ জন যুগ্ম-সচিবের মধ্যে ৮১ জন নারী৷

এছাড়া নারীরা বিভিন্ন কারখানার কাজে অংশ নিচ্ছে পুরুষের পাশাপাশি। ২০১৮ সালে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, কারখানায় ২১ লাখ এক হাজার ৮৩০ জন নারী শ্রমিক রয়েছে, পুরুষ শ্রমিকের সংখ্যা ১৯ লাখ ৯৫ হাজার ৫৫৭ জন৷

বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) ২০২০ সালের এক গবেষণায় বলা হয়, মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) নারীর অবদান প্রায় ২০ শতাংশ। এর সঙ্গে সংসারের ভেতর ও বাইরের কাজের মূল্য ধরলে তাদের অবদান বেড়ে দাঁড়াবে ৪৮ শতাংশ। এমন সূচক এবং জরিপ থেকে প্রতীয়মান যে, দেশের সার্বিক উন্নয়নে নারী এবং পুরুষের অবদান প্রায় সমানে সমান।

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল বলছিলেন, ‘উদ্যম আর সাহসিকতায় বাঙালি নারী যে আত্মপরিচয় তুলে ধরতে সক্ষম, তা বিশ্বের অনেক দেশের নারীই পারেনি। এখানে নারীর পায়ে শিকল পরানো, নারীর ক্ষমতায়নে বাধা প্রতি পদে পদে। তবু নারীর অগ্রযাত্রাকে দমানো যায়নি। মুক্তিযুদ্ধ থেকে শুরু করে দেশ-সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রে নারীর অসামান্য অবদান রয়েছে। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে বাধা পেরিয়ে নারী কীভাবে এগিয়ে যেতে পারে, তার হাজারো গল্প তৈরি হয়েছে এখানে।’

বাংলাদেশ মহিলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট সালমা আলী নারী উন্নয়ন এবং প্রবাসী নারী শ্রমিকদের নিয়ে কাজ করছেন দীর্ঘদিন ধরে। তিনি বলেন, ‘শত বাধা আর প্রতিকূলতা এড়িয়ে নারী যেভাবে এগিয়ে চলছে, তা রীতিমতো বিস্ময় বলে মনে করি। নারীর সমস্যা এবং উন্নয়ন নিয়ে কাজ করছি দীর্ঘদিন থেকে। খুব কাছ থেকে দেখছি, নারীরা কী প্রত্যয় নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে।’

তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের নারীরা মানসিকভাবে অত্যন্ত সবল। তাকে রাজনীতি, পরিবার এবং সমাজ দুর্বল করে দেয়। উপার্জন এবং ক্ষমতায়নে নারীর অংশ বাড়লেই প্রকৃত উন্নয়ন হবে। নারীর উন্নয়নে পুরুষকে যেমন সহযোগী হতে হবে, তেমনি নারীর উন্নয়নে নারীকেও সহযোগী হতে হবে।

শেয়ার করুন