বিজয়ের সুবর্ণজয়ন্তীতে স্বাধীনতাবিরোধী সাম্প্রদায়িক মৌলবাদী চক্রের সব ষড়যন্ত্র-চক্রান্ত রুখে দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গড়ে তোলার দৃঢ় প্রত্যয়ের মধ্য দিয়ে রাজধানীতে বর্ণাঢ্য বিজয় শোভাযাত্রা করেছে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ।
শনিবার বিশাল এই শোভাযাত্রায় লাখো মানুষের কণ্ঠে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী অপশক্তির চূড়ান্ত পতন ঘটানোর পাশাপাশি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত উন্নত-সমৃদ্ধ সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠার শপথও উচ্চারিত হয়েছে জোরেশোরে।
স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ও জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী ‘মুজিববর্ষ’ উপলক্ষে এই বিজয় শোভাযাত্রার আয়োজন করা হয়েছিল। ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যান সংলগ্ন ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন প্রাঙ্গণে সংক্ষিপ্ত সমাবেশ শেষে শনিবার বিকেলে শোভাযাত্রা শুরু হয়। বিভিন্ন সড়ক ঘুরে ধানমণ্ডির ঐতিহাসিক বঙ্গবন্ধু ভবন প্রাঙ্গণে গিয়ে এর সমাপ্তি ঘটে।
গত ২০১৯ সালে আওয়ামী লীগের জাতীয় সম্মেলনের সমাবেশের পর এই সময়ে মধ্যে এটাই ছিল বড় ধরণের গণমজায়েত। এর আগে বিজয় দিবস উপলক্ষে প্রতি বছরই রাজধানীতে বর্ণাঢ্য বিজয় শোভাযাত্রা করে আসছে ক্ষমতাসীন দলটি। তবে করোনার প্রকোপের কারণে গত বছর শোভাযাত্রা হয়নি। এই কারণে এবারের বিজয় শোভাযাত্রায় নেতাকর্মী ও সাধারণ মানুষ ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনা ও বিজয়ের আমেজে অংশ নিয়েছেন। ফলে বিজয় শোভাযাত্রায় মানুষের ঢল নামে।
এর আগে দুপুর ১২টার পর থেকেই থেকেই রাজধানীর সব থানা, ওয়ার্ড ও ইউনিটসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনসহ সমমনা ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক ও পেশাজীবী সংগঠনের হাজার হাজার নেতাকর্মী-সমর্থক অসংখ্য ছোট-বড় মিছিল সহকারে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের সামনে জড় হতে শুরু করেন। বিপুলসংখ্যক মুক্তিযোদ্ধা ও সাধারণ মানুষের পাশাপাশি রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার এমপি ও জনপ্রতিনিধিদের নেতৃত্বে অসংখ্য নেতাকর্মীও সমবেত হন। একপর্যায়ে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ও ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন ছাড়াও মৎস্য ভবন, হাইকোর্ট, রমনা এবং শাহবাগসহ আশপাশের এলাকা জনারণ্যে পরিণত হয়।
এই অবস্থায় দুপুর ২টা থেকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান সংলগ্ন ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনের সামনে খোলা ট্রাকের ওপর তৈরি মঞ্চে শোভাযাত্রাপূর্ব সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। এই সমাবেশে সভাপতিত্ব ও শোভাযাত্রার উদ্বোধন করেন আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য আমির হোসেন আমু।
এ সময় দেশে চলমান উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখতে জাতীয়-আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র প্রতিহত করতে সকলকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানিয়ে আমির হোসেন আমু বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাঙালি জাতি আজ পৃথিবীর বুকে একটি সমৃদ্ধশালী জাতি ও উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। তবে ষড়যন্ত্র থেমে নেই, এখনো ষড়যন্ত্র চলছে। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক এই সকল ষড়যন্ত্রকে পদদলিত করে শেখ হাসিনার নেতৃত্বেই বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ে উঠবে।
দলের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য মতিয়া চৌধুরী বলেন, সকল ষড়যন্ত্র, হত্যা-খুনের রাজনীতি অতিক্রম করে আওয়ামী লীগ বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দুর্বারগতিতে এগিয়ে যাচ্ছে। ইনশাআল্লাহ বাংলাদেশ এগিয়েই যাবে।
সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক বলেন, বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন পূরণে কাজ করে যাচ্ছেন তারই কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আজকে আমাদের শপথ ও প্রত্যয়- উন্নয়নের এই ধারা অব্যাহত রাখা।
যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ বলেন, লন্ডনে বসে তারেক জিয়ারা এখনো ষড়যন্ত্র করছে। তারেক জিয়াকে অবিলম্বে দেশে ফিরিয়ে বিচারের রায় কার্যকর করতে হবে।
যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি বলেন, শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আমরা সব অপশক্তিকে রুখে দিয়ে এগিয়ে যাবো। আজকের দিনে এটাই আমাদের শপথ।
যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক এবং তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ বলেন, জঙ্গিবাদ, সাল্ফপ্রদায়িক শক্তি ও স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তিকে চূড়ান্তভাবে পতন করাই হোক আজকের দিনে সকলের প্রত্যায়।
সমাবেশে আরও বক্তব্য রাখেন আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য অ্যাডভোকেট জাহাঙ্গীর কবির নানক, আব্দুর রহমান, রাজশাহী সিটি করপোরেশনের মেয়র এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটন, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আফম বাহাউদ্দিন নাছিম, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলাম, দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস, আওয়ামী লীগ নেতা আহমদ হোসেন, বিএম মোজাম্মেল হক, মির্জা আজম, আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন, এসএম কামাল হোসেন, অ্যাডভোকেট আফজাল হোসেন, শফিউল আলম চৌধুরী নাদেল, অ্যাডভোকেট মৃণাল কান্তি দাস, আবু আহমেদ মন্নাফী, শেখ বজলুর রহমান, হুমায়ুন কবির, হেদায়েতুল ইসলাম স্বপন, কাজী মোর্শেদ হোসেন কামাল, মিরাজ উদ্দিন, গোলাম আশরাফ তালুকদার, নাজিম উদ্দিন আহমেদ, আজিজুল হক রানা প্রমুখ।
সমাবেশে শেষে বিকেল পৌনে ৪টায় শোভাযাত্রা বের হয়। দলের কেন্দ্রীয় নেতারা পায়ে হেঁটে শোভাযাত্রায় অংশগ্রহণ ও নেতৃত্ব দেন। শোভযাত্রার অগ্রভাগে ছিল বিশালআকৃতির গাঢ় লাল-সবুজের জাতীয় ও দলীয় পতাকা। বিভিন্ন এলাকা থেকে শোভাযাত্রায় যোগ দিতে আসা নেতাকর্মী এবং সব বয়সী সুসজ্জিত মানুষের প্রায় সবার হাতেও ছিল রংবেরঙের ছোট ছোট পতাকা, বেলুন, প্ল্যাকার্ড ও ফেস্টুন। অনেকের হাতে ছিল জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনাসহ জাতীয় চার নেতার প্রতিকৃতি। কেউ কেউ এসেছিলেন আওয়ামী লীগের নির্বাচনী প্রতীক নৌকা নিয়ে। আর সংগঠনগুলো এসেছিল স্বস্ব ব্যানার নিয়ে। মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিলের সাবেক ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব সফিকুল বাহার মজুমদার টিপুর নেতৃত্বে বিপুলসংখ্যক বীর মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের অংশগ্রহণ ছিল চোখে পড়ার মতো।
নানা স্লোগানে মুখরিত মানুষ পায়ে হেঁটে এবং ট্রাক ও মোটরসাইকেলের বহর নিয়ে শোভাযাত্রায় যোগ দেন। অনেকেই ঘোড়ার গাড়িতে চেপে আর ঢাকঢোল ও বাদ্যযন্ত্রের বাজনা বাজিয়ে ও নেচে-গেয়ে পরিবেশকে উৎসবমুখর করে রাখেন। শোভাযাত্রায় কয়েকটি হাতির উপস্থিতি এবং খোলা ট্রাকে মুক্তিযোদ্ধার সাজে ট্যাংক ও বন্দুক উঁচিয়ে মুক্তিযুদ্ধের পটভূমি উপস্থাপন ছিল চোখে পড়ার মতো। কেউ কেউ প্রতীকী যুদ্ধাপরাধী ও রাজাকার-আলবদর সাজিয়ে ও বিচারের ডিসপ্লে প্রদর্শনের মাধ্যমে ঘৃণার বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছেন। মাইকে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণসহ স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের উদ্দীপনামূলক গানও প্রচার করা হয়েছে। এ সময় সংলগ্ন রাস্তাগুলোর দু’পাশে দাঁড়িয়ে এবং আশপাশের উঁচু ভবনগুলোতে সমবেত হয়ে হাজারো জনতা করতালির মাধ্যমে শোভাযাত্রাকে স্বাগত জানিয়েছেন। কেউ কেউ মিছিলে একাত্ম হয়েছেন।
শোভাযাত্রাটি শাহবাগ, এলিফ্যান্ট রোড, সায়েন্স ল্যাবরেটরি, কলাবাগান ও রাসেল স্কয়ার হয়ে ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের ঐতিহাসিক বঙ্গবন্ধু ভবন প্রাঙ্গণে ঘিরে শেষ হয়। বিকেল ৫টায় এই শোভাযাত্রা ধানমণ্ডি ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধু ভবনের সামনে পৌছনোর পরও শোভাযাত্রার শেষভাগ এলিফেন্ট রোডে অবস্থান করছিল।
এদিকে, আওয়ামী লীগের এ বিজয় শোভাযাত্রাকে ঘিরে দুপুর থেকে রাত পর্যন্ত মৎস্য ভবন, জাতীয় প্রেস ক্লাব, কাকরাইল, শাহবাগ, মিরপুর রোডসহ নগরজুড়ে তীব্র যানজট দেখা গেছে। শনিবার ছুটির দিনে এই শোভাযাত্রা আয়োজিত হলেও নগরজুড়ে এই যানজটে মানুষকে ব্যাপক দুর্ভোগে পড়তে হয়েছে।