সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এএমএস কিবরিয়া হত্যাকাণ্ডের ১৭ বছর পূর্ণ হলো আজ ২৭ জানুয়ারি। এ উপলক্ষে বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করেছে আওয়ামী লীগ, অঙ্গসংগঠন ও কিবরিয়া স্মৃতি পরিষদ।
হত্যাকাণ্ডের সাড়ে ৯ বছর পর সম্পূরক চার্জশিট দাখিলের মাধ্যমে বিচার কাজ শুরু হলেও আজও এ হত্যার বিচার শেষ হয়নি। ফলে বিচার নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন নিহতের স্বজনরা।
২০০৫ সালের ২৭ জানুয়ারি বিকেলে হবিগঞ্জ সদর উপজেলার বৈদ্যের বাজারে ঈদ পরবর্তী এক জনসভা শেষে ফেরার পথে গ্রেনেড হামলায় নিহত হন তৎকালীন হবিগঞ্জ-৩ আসনের সংসদ সদস্য সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এএমএস কিবরিয়া। এ হামলায় শাহ এএমএস কিবরিয়ার ভাতিজা শাহ মনজুরুল হুদা, আওয়ামী লীগ নেতা আব্দুর রহিম, আবুল হোসেন এবং সিদ্দিক আলীও প্রাণ হারান। আহত হন কমপক্ষে শতাধিক নেতাকর্মী।
ঘটনার রাতেই হবিগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট আবদুল মজিদ খান বাদী হয়ে হত্যা ও বিস্ফোরক আইনে দুটি মামলা করেন। মামলার তদন্তে নামে দেশি-বিদেশি বিভিন্ন সংস্থা। তবে মামলাটির তদন্ত দলীয় বিবেচনায় হতে থাকে।
সিআইডির তৎকালীন সহকারী পুলিশ সুপার মুন্সি আতিকুর রহমান মামলাটি তদন্ত করে ১০ জনের বিরুদ্ধে ওই বছরের ২০ মার্চ ১ম অভিযোগপত্র দাখিল করেন। অভিযোগপত্র দেওয়ার পর মামলার বাদী অ্যাডভোকেট আবদুল মজিদ খান ২০০৬ সালের ৩ মে সিলেট দ্রুত বিচার আদালতে নারাজি আবেদন করেন। আদালত তার আবেদন খারিজ করলে ১৪ মে তিনি হাইকোর্টে আপিল করেন।
আপিলের প্রেক্ষিতে হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ সরকারের প্রতি ‘কেন অধিকতর তদন্ত করা যাবে না’ মর্মে রুল জারি করেন। এই রুলের বিরুদ্ধে ২০০৬ সালের ১৮ মে লিভ টু আপিল করে সরকার। আপিল বিভাগ সরকারের আপিল খারিজ করে দেন। এরপর ফখরুদ্দীন আহমদের নেতৃত্বাধীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর এ মামলার অধিকতর তদন্ত শুরু হয়। দায়িত্ব দেওয়া হয় সিআইডির সহকারী পুলিশ সুপার রফিকুল ইসলামকে। দীর্ঘ তদন্ত শেষে তিনি ২০১১ সালের ২০ জুন আরও ১৪ জনকে আসামি করে এই আলোচিত মামলার অধিকতর তদন্তের অভিযোগপত্র দাখিল করেন। কিবরিয়া হত্যাকাণ্ডের সাড়ে ৬ বছর পর লুৎফুজ্জামান বাবর, মুফতি হান্নানসহ ২৪ জনকে আসামি করে অধিকতর তদন্তের অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়।
২০১১ সালের ২৮ জুন কিবরিয়ার স্ত্রী আসমা কিবরিয়া চার্জশিটের ওপর হবিগঞ্জ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে নারাজি আবেদন করেন। আবেদনের প্রেক্ষিতে মামলার মূল নথি সিলেট দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে থাকায় বিচারক রাজিব কুমার বিশ্বাস উপনথির মাধ্যমে আবেদনটি সিলেটে পাঠানোর নির্দেশ দেন।
২০১২ সালের ৫ জানুয়ারি হত্যাকাণ্ডের অধিকতর তদন্তের অভিযোগপত্রের নারাজি আবেদন গ্রহণ করেন সিলেটের দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের বিচারক দিলীপ কুমার বণিক। তিনি সিনিয়র পুলিশ অফিসারের মাধ্যমে মামলার অধিকতর তদন্তের জন্য নির্দেশ দেন।
এরপর সিআইডির এএসপি মেহেরুন নেছা দীর্ঘ তদন্ত শেষে সাড়ে ৯ বছর পর ২০১৪ সালের ১৩ নভেম্বর হবিগঞ্জের সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট রোকেয়া আক্তারের আদালতে কিবরিয়া হত্যা মামলার তৃতীয় সম্পূরক অভিযোগপত্রে নতুন ১১ জনকে অন্তর্ভুক্ত করে ৩৫ জনের বিরুদ্ধে চার্জশিট দাখিল করেন। অন্তর্ভুক্ত আসামি হলেন- সিলেট সিটি করপোরেশনের মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী, হবিগঞ্জ জেলা বিএনপির তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক জি কে গউছ, বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার সাবেক রাজনৈতিক উপদেষ্টা হারিছ চৌধুরী, মুফতি আব্দুল হাই, মুফতি তাজ উদ্দিন, মুফতি সফিকুর রহমান, মোহাম্মদ আলী, বদরুল, মহিবুর রহমান, কাজল আহমেদ ও হাফেজ ইয়াহিয়া।
এরপর ২০১৫ সালের জুনে মামলাটি সিলেট দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে হস্তান্তর করা হয়। সেখানে মামলার বিচার কাজ শুরু হয়েছে। চলছে সাক্ষ্যগ্রহণ।
মোট ৩২ আসামির মধ্যে অন্য একটি মামলায় ৩ আসামির ফাঁসি কার্যকর হয়েছে। সম্প্রতি হারিছ চৌধুরী লন্ডনে মারা গেছেন। এখন ২৮ জন আসামি রয়েছেন। এর মধ্যে জামিনে আছেন ১২ জন। পলাতক রয়েছেন ৬ জন এবং হাজতে আছেন ১০ জন। বর্তমানে সিলেটে মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ চলছে। এখন পর্যন্ত ৪৪ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ করা হয়েছে।
এ বিষয়ে আব্দুর রহিমের স্ত্রী আছিয়া খাতুন বলেন, হত্যাকাণ্ডের ১৭ বছর হয়ে গেল, কিন্তু বিচারের মুখ দেখলাম না। জানি না আমার স্বামীর হত্যার বিচার দেখতে পারব কিনা। বিচার দেখতে পারলে হয়তো আমার স্বামীর আত্মার শান্তি পাবে।
হবিগঞ্জ সদর উপজেলার লস্করপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মাহবুবুর রহমান হিরু বলেন, কিবরিয়া হত্যাকাণ্ড আমাদের জন্য কলঙ্কজনক। এই হত্যাকাণ্ডের বিচার আমরা চাই। আমরা আশাবাদী বর্তমান সরকারের আমলেই এর বিচার হবে এবং হত্যাকারীদের ফাঁসি নিশ্চিত করা হবে। আমরা এ বিচার দেখতে চাই।
মামলার বাদী হবিগঞ্জ-২ আসনের সংসদ সদস্য আব্দুল মজিদ খান বলেন, বিভিন্ন কারণে মামলার দীর্ঘসূত্রতা ঘটেছে। আমি আশাবাদী বর্তমান সরকারের আমলেই এই চাঞ্চল্যকর মামলার বিচার হবে এবং প্রকৃত দোষীরা শাস্তি পাবে।
শাহ এএমএস কিবরিয়ার ছেলে ড. রেজা কিবরিয়া বলেন, দুই বছর বিএনপি, দুই বছর তত্ত্বাবধায়ক সরকার ও আওয়ামী লীগ ১৩ বছরে সুষ্ঠু তদন্ত করতে পারেনি এবং করতে চায়নি। আমরা হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদ্ঘাটন করব এবং বাংলার মাটিতে কিবরিয়া হত্যার বিচার হবে। সেই দিন বেশি দূরে নয়।
তিনি বলেন, এই মূহূর্তে বিচারের সম্ভাবনা নেই। তিনটি চার্জশিট দেওয়া হয়েছে তিনটিই মিথ্যা। যদি কেউ এই বিচারাধীন মামলা শেষ করতে চায়, তাহলে কোনো লোভ হবে না। মামলায় অনেক রাজনৈতিক ব্যক্তিকে দোষারোপ করা হয়েছে। যা আমি বিশ্বাস করি না। খুব শিগগিরই আসল দোষীদের বিচার হবে এবং আমরা সুষ্ঠু বিচার পাব।
সিলেট দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের পাবলিক প্রসিকিউটর সারওয়ার আহমেদ আব্দাল বলেন, কিবরিয়া হত্যাকাণ্ডের সাক্ষ্যগ্রহণ চলমান রয়েছে। এখন পর্যন্ত ৪৪ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ হয়েছে। মামলার আসামিরা বিভিন্ন স্থানে থাকায় এবং সাক্ষীদের আনতে দেরি হওয়ায় বিচার শেষ হতে সময় লাগছে। তবে আমরা আশাবাদী দ্রুত সময়ের মধ্যেই কিবরিয়া হত্যার বিচার হবে।