ঋণ ও ক্ষুধায় কাতর এক আফগান মা নিজের নাড়িছেঁড়া ধন দুই মেয়েশিশুকে আগেই বিক্রি করে দিয়েছেন। তিনবেলা শুধু কয়েকমুঠো ভাতের জন্য! তবু তাঁর ও পরিবারের অন্য সদস্যদের থালায় প্রতিদিন এখন ভাত জোটে না। অভাব-অনটন আর ক্ষুধার মরণযন্ত্রণা সইতে না পেরে এবার ওই মা নিজের একটা কিডনি বিক্রি করে দিয়েছেন। যে কয়েকদিন বেঁচে থাকা যায়, সেই কয়েকদিন যেন অন্তত উপোস করতে না হয়! জীবন ওই মায়ের কাছে কী আশ্চর্যরকমের নির্মম! জীবনের বাকি দিনগুলোতে তিনি কয়েকমুঠো ভাত খেয়ে ক্ষুধা মেটাতে পারবেন কি?
প্রশ্নটির উত্তরের আগে ওই আফগান মায়ের সঙ্গে পরিচিত হওয়া যাক। তাঁর নাম দেলারম রহমতি। বৈশ্বিক সংবাদমাধ্যম ‘দ্য গার্ডিয়ান’ তাঁর অনটন ও খাবারের সংগ্রামপীড়িত জীবন নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। এতে বলা হয়, চার বছর আগে আফগানিস্তানের বাদগিস প্রদেশের ভিটেমাটি ছাড়তে হয়েছিল দেলারম রহমতির পরিবারকে। এরপর ঠাঁই হয় হেরাতের বস্তিতে। আট সন্তানের মুখে খাবার জোগাতে দিশেহারা অবস্থা তাঁর। ক্ষুধার জ্বালায় কয়েক মাস আগে দুই মেয়েকে বিক্রি করে দিতে বাধ্য হয়েছেন তিনি।
রহমতি দ্য গার্ডিয়ানকে বলেন, ‘অচেনা মানুষের কাছে মেয়েদের বেচে দিয়েছি। ওদের একজনের বয়স আট, আরেকজনের ছয়।’ প্রাপ্তবয়স্ক হলে রহমতির ওই দুই মেয়েকে তুলে দিতে হবে অচেনা ক্রেতাদের হাতে। দুইলাখ আফগান মুদ্রায় (বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় এক লাখ ৬৪ হাজার টাকা) দুই মেয়েকে বিক্রি করে হাতে কিছু অর্থ পেয়েছেন বটে। কিন্তু তাতে রহমতির সংসারের কোনো উন্নতি হয়নি। দুইছেলের চিকিৎসায় সে অর্থও দেখতে না দেখতেই শেষ।
রহমতির একছেলে পক্ষাঘাতগ্রস্ত, অন্যজন মানসিক অসুস্থতায় ভুগছে। তাঁর অসুস্থ স্বামীর জন্যও নিয়মিত ওষুধ কিনতে হয়। নিরুপায় হয়ে মেয়েদের ভবিষ্যৎ বিক্রি করার যন্ত্রণা মিটতে না মিটতেই দেড় লাখ আফগান মুদ্রায় নিজের ডান কিডনি বিক্রি করেন রহমতি। কিডনির অস্ত্রোপচারের পর থেকে তিনি নিজেও অসুস্থ। কিন্তু, চিকিৎসকের কাছে যাওয়ার মতো টাকা-পয়সা তাঁর কাছে নেই। এর মধ্যেই তাঁকে জোগাড় করতে হচ্ছে অসুস্থ দুই ছেলের হাসপাতালের খরচ। লাগছে স্বামীর জন্য ওষুধও। প্রচণ্ড শীতের মধ্যেই খরা ও করোনার প্রকোপে কাজ হারানো রহমতির পরিবারে কোনো আশার আলো নেই বললেই চলে। রহমতি বলেন, ‘ঋণ আর ক্ষুধার জ্বালায় আমার কিডনি বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছি।’
তালেবানশাসিত আফগানিস্তানে এমন রহমতিদের সংখ্যা অনেক বলে জানাচ্ছে ‘দ্য গার্ডিয়ান’। বিবিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এক টুকরো রুটির জন্য পথে পথে ঘুরছে আফগান শিশুরা। অর্থনৈতিক ভরাডুবির কারণে দেশটির অসংখ্য শিশু তাদের পরিবারকে সাহায্য করার জন্য কাজ করতে বাধ্য হচ্ছে। এ সংখ্যা আগের চেয়ে ক্রমেই বাড়ছে। তালেবান দেশটির ক্ষমতা দখলের আগেও, কয়েক হাজার আফগান শিশু ভয়াবহ দারিদ্র্যের কারণে কাজে নামতে বাধ্য হয়েছিল। তবে, তালেবান ক্ষমতায় আসার পর থেকে আন্তর্জাতিক তহবিল আসা অনেকাংশে বন্ধ হয়ে গিয়েছে। নিষেধাজ্ঞাও আরোপ করা হয়েছে। ফলে বেকারত্ব ক্রমেই বাড়ছে।
জাতিসংঘ বলছে, ‘সাম্প্রতিক ইতিহাসের সবচেয়ে সংকটময় পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে আফগানিস্তান। অর্থনৈতিক ধসের সঙ্গে রয়েছে মানবিক সংকটও।’ জাতিসংঘের উন্নয়ন সংস্থা সতর্ক করেছে, আফগানিস্তান সর্বজনীন দারিদ্র্যের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে। স্থানীয় সম্প্রদায় ও তাদের অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে জরুরি প্রচেষ্টা ছাড়া দেশটির জনসংখ্যার ৯৭ শতাংশ দারিদ্র্যসীমার নিচে ডুবে যাওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে।
২০২১ সালের আগস্টে তালেবান আফগানিস্তানের ক্ষমতা দখলের পর থেকে দেশটির ওপর জারি করা অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার খাঁড়ায় ভগ্নদশা আফগানিস্তানের অর্থনীতির। স্তব্ধ হয়ে যায় দেশটির অর্থনৈতিক কার্যক্রম। দেশটির ভঙ্গুর অর্থনীতির পুরোটাই বৈদেশিক সহায়তানির্ভর। সাম্প্রতিক রাজনৈতিক অস্থিরতা অনিশ্চয়তায় ফেলে দিয়েছে আর্থিক সহায়তাগুলোকেও। আটকে দেওয়া হয়েছে দেশটির বৈদেশিক মুদ্রার মজুদও। ফলে অনেকটা খালি হাতেই সরকার গঠন করেছে তালেবান। সেইসঙ্গে কোভিড মহামারি ও খরার প্রকোপে কর্মহীন আফগানিস্তানের বহু মানুষ। হু হু করে মুদ্রাস্ফীতি বৃদ্ধির জেরে আকাশ ছুঁয়েছে খাদ্যসামগ্রীর দাম। আর এর চরম প্রভাব পড়েছে রহমতির মতো মানুষের ওপর। নিজেদের কিডনি বিক্রি করাই অনেকের কাছে অর্থ সংস্থানের অন্যতম পথ হয়ে দাঁড়িয়েছে।