বিদেশে অবস্থিত দেশের দূতাবাস, হাইকমিশন ও উপহাইকমিশনে কর্মরত রাষ্ট্রদূত ও কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময় যৌন হয়রানি, আর্থিক অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ উঠে। অভিযোগ প্রমাণিত হলেও বেশিরভাগ ঘটনায় শাস্তি হয় না। বড়জোর বিদেশের দূতাবাস থেকে দেশে ফিরিয়ে আনা বা কখনো কখনো অন্য দেশে অবস্থিত দেশীয় দূতাবাসে অভিযুক্তকে বদলি করার মধ্যে ‘শাস্তি’ সীমাবদ্ধ থাকে। যা প্রায় সময় বিদেশে দেশের ভাবমূর্তিতে আঘাত হানে। যথাযথ শাস্তি না হওয়ায় আপত্তিকর ও অসম্মানজনক ঘটনাও থামছে না। মত ও পথের অনুসন্ধানে এসব তথ্য বেরিয়ে এসেছে।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তিনজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে মত ও পথকে বলেন, কোনো অভিযোগে দেশের কূটনীতিক, রাষ্ট্রদূত ও দূতাবাস কর্মকর্তাদেরকে ঢাকায় ফিরিয়ে আনার পর ‘অধিকতর তদন্তের’ দায়িত্ব পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের। এর মাধ্যমে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে যথাযথ শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া গেলে এ ধরনের অভিযোগ বন্ধ হতো, দেশের ভাবমূর্তির জন্যও তা শুভকর হতো। দূতাবাস কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ নতুন কিছু নয়। শাস্তি না হওয়ায় যুগের পর যুগ ধরে এভাবে চলে আসছে।
জানা গেছে, যৌন নিপীড়নের সবশেষ সুনির্দিষ্ট অভিযোগ উঠে ভারতের কলকাতার বাংলাদেশের উপহাইকমিশনের কূটনীতিক মুহাম্মদ সানিউল কাদেরের বিরুদ্ধে। এর ভিত্তিতে গত ২৬ জানুয়ারি তাঁকে ঢাকায় ফিরিয়ে আনা হয়। তাঁর বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের তদন্ত চলছে। বিষয়টি নিয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা সংবাদমাধ্যমের কাছে ‘লুকোছাপার কৌশল’ অবলম্বন করছেন। কেউ মুখ খুলছেন না। অভিযুক্ত সানিউলও প্রচারমাধ্যমকে এড়িয়ে চলছেন।
ভারতীয় প্রচারমাধ্যমের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশটির এক নারীর সঙ্গে বাংলাদেশ উপহাইকমিশনের রাজনৈতিক সচিব সানিউল কাদেরের বেশ কিছু ‘অশ্লীল চ্যাট ও ভিডিও’ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। ভিডিওতে ‘আপত্তিকর, অশালীন’ অবস্থায় তাঁকে ওই নারীর সঙ্গে নাচতে দেখা যায়। এ ঘটনা ঘিরে দেশটির নেটিজেনদের মধ্যে তোলপাড় সৃষ্টি হয়। সানিউলের সঙ্গে ওই নারী হোয়াটসঅ্যাপে নিয়মিত যোগাযোগ করতেন। তাঁর সঙ্গে তিনি ‘নগ্ন ভিডিও চ্যাট’ করতেন। সম্প্রতি ওই নারী কলকাতার উপহাইকমিশনে ‘প্রমাণসহ’ অভিযোগ করেন। তাতে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও হাইকমিশনের কর্মকর্তারা যথেষ্ট ‘বিব্রত’ হন।
তথ্যমতে, দূতাবাসের কার্যক্রম পরিচালনায় ব্যর্থতা, আর্থিক অনিয়ম, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের শীর্ষ কয়েক নেতা সম্পর্কে কটূক্তি, ব্যক্তিগত অসদাচরণ ও যৌন নিপীড়নের অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় ২০১৪ সালের জুলাইয়ে লেবাননে রাষ্ট্রদূত গাউসুল আজম সরকারকে, ২০১১ সালে জাপানে নিযুক্ত তখনকার রাষ্ট্রদূত মুজিবর রহমান ভূঁইয়াকে, ২০১২ সালে ফিলিপাইনে নিযুক্ত রাষ্ট্রদূত মাজেদা রফিকুননেসাকে এবং ২০১৩ সালে জার্মানি থেকে রাষ্ট্রদূত মসউদ মান্নানকে দেশে ফিরিয়ে আনা হয়। অনৈতিক কর্মকাণ্ড ও নিয়মানুযায়ী রাষ্ট্রপতির অনুমতি না নিয়ে বিদেশিকে বিয়ে করায় ২০১০ সালে উজবেকিস্তানে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত হাসিব আজিজকে ঢাকায় ফিরিয়ে আনা হয়। দীর্ঘদিন তাঁকে ‘বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা’ (ওএসডি) রাখার পর ২০১৩ সালে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়। বাকিদের ‘শাস্তি’ সীমাবদ্ধ থাকে দূতাবাস থেকে দেশে ফিরিয়ে আনার মধ্যে।
জানা গেছে, যৌন হয়রানির প্রতিকার চাওয়ায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় নারী কর্মকর্তাকে বরখাস্ত করার ঘটনাও ঘটেছে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা এক পুরুষ সহকর্মীর বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ এনে বিচার চেয়েছিলেন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সহকারী সচিব মঞ্জু মনোয়ারা। চার বছরে তিনি অভিযোগের বিচার পাননি। উল্টো ‘অসদাচরণের অভিযোগে’ এনে তাঁকে বরখাস্ত করে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ২০২০ সালের জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে। এ বিষয়ে তখন মন্ত্রণালয়ের আদেশে বলা হয়, ‘ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের প্রতি উদ্ধত আচরণের ও সব পর্যায়ের কর্মকর্তাদের প্রতি ক্রমাগত দুর্ব্যবহারের কারণে’ তাঁর বিরুদ্ধে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
বরখাস্তের আগে উচ্চ আদালতে সহকর্মীর বিরুদ্ধে যৌন নির্যাতনের অভিযোগে রিট দায়ের করেন মঞ্জু মনোয়ারা। মন্ত্রণালয়ে ‘বিচার না পেয়ে’ তিনি আদালতের দ্বারস্থ হন বলে তখন অভিযোগ করেন। রিট আবেদনের প্রেক্ষিতে আদালত তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দেন। প্রতিবেদন চাওয়ার কয়েক ঘণ্টার মাথায় ওই নারী কর্মকর্তাকে বরখাস্ত করে মন্ত্রণালয়। তবে মন্ত্রণালয়ের আদেশে যৌন হয়রানির কোনো বিষয় উল্লেখ ছিল না। টোকিওতে বাংলাদেশ দূতাবাস ও মুম্বাইয়ে বাংলাদেশ উপহাইকমিশনে কর্মরত থাকার সময় ‘তিনি মিশনের কর্মকাণ্ডে বিঘ্ন সৃষ্টি করেন’ বলে উল্লেখ করা হয় বরখাস্তের আদেশে। ২০১৫ সালে দূতাবাস টোকিওতে প্রথম সচিব হিসেবে কর্মরত অবস্থায় পররাষ্ট্র সচিবের কাছে তাঁর সহকর্মী, দূতাবাসের কাউন্সেলর মোহাম্মদ নুরে আলমের বিরুদ্ধে যৌন নিপীড়নের লিখিত অভিযোগ করেন মনোয়ারা।
ওই অভিযোগপত্রে তাঁর দাবি ছিল, ‘নিপীড়নের ভয়াবহতা চরম আকার ধারণ করে যখন ২০১৫ সালের ১২ জুন মোহাম্মদ নুরে আলম আমাকে গর্ভকালীন অবস্থায় শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করার হুমকি দেন। এতে আমি প্রচণ্ড ভয়, মানসিক আঘাত পাই। যার পরিপ্রেক্ষিতে ওই বছরের ১৯ জুলাই আমার গর্ভস্থ সন্তানের হৃদস্পন্দন বন্ধ হয়ে যায়।’ তিনি দাবি করেন, সেই অভিযোগের পরে তাঁকে টোকিও থেকে মুম্বাই মিশনে বদলি করা হয়। তিনি মুম্বাই মিশনে যোগ দেননি। পরে তিনি যখন যোগ দেন, তখন তাঁকে মিশন ভবনে ঢুকতে দেওয়া হয়নি।
অভিযোগপত্রে মঞ্জু উল্লেখ করেন, পরে তাঁকে মুম্বাই মিশনের একটি কক্ষে আটকে রেখে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করা হয়। এর ফলে তিনি অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন। এরপর ২০১৫ সালের ১১ নভেম্বর তাঁকে ঢাকায় ফিরিয়ে এনে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রশাসন বিভাগে সংযুক্ত করা হয়।